ঢাকা, শনিবার   ০৪ মে ২০২৪,   বৈশাখ ২১ ১৪৩১

সামরিক জাদুঘরে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি

তবিবুর রহমান

প্রকাশিত : ০৬:৩৯ পিএম, ১৭ ডিসেম্বর ২০১৭ রবিবার | আপডেট: ০৯:৩৯ পিএম, ১৭ ডিসেম্বর ২০১৭ রবিবার

সামরিক জাদুঘরে নির্মাণাধীন স্থাপনা

সামরিক জাদুঘরে নির্মাণাধীন স্থাপনা

বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাস। এ বাহিনী জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে কাজ করেও ব্যাপক সুনাম অর্জন করেছে। সামরিক বাহিনীর এমন নানা সাফল্যের নিদর্শন ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন স্মৃতি নিয়ে রাজধানীর বিজয় সরণিতে বাংলাদেশ সামরিক জাদুঘর স্থাপন করা হয়েছে।

১৯৮৭ সালে এই সামরিক জাদুঘরটি মিরপুর সেনানিবাসে স্থাপন করা হয়েছিল। পরে স্থানের গুরত্ব এবং দর্শকদের চাহিদার কথা বিবেচনা করে ১৯৯৯ সালে জাদুঘরটি স্থায়ীভাবে বিজয় সরণিতে স্থানান্তর করা হয়।

এ জাদুঘরে মুক্তিযুদ্ধের সময় সামরিক বাহিনীর সদস্যদের ব্যবহৃত রাইফেল, বন্দুক, মর্টারশেল, হাতব্যাগ, টুপি, চশমা, মানিব্যাগ ও ইউনিফর্ম রাখা হয়েছে। এছাড়া রয়েছে বেল্ট, টাই, স্টিক, ডায়েরি, বই, পরিচয়পত্র, কলম, মেডেল, খাবারের প্লেট, পানির মগ, পানির গ্লাস, রেডিও, শার্ট, প্যান্ট, র্যাংক ব্যাজসহ টিউনিক সেট (বিশেষ পোশাক), ক্যামেরা, পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স, লোহার হেলমেট, হ্যান্ড মাইক, রক্তভেজা প্যান্ট-শার্টসহ আরো অনেক কিছু।

অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে এমএম রাইফেল, মর্টার, মর্টার শেল, সার্চ লাইট, রায়ট রাবার শেল, রিভলবার, এলএমজি, মেশিনগান, এমএম এলএমজি, বোর রিভলবার,  বোর শটগান, এমএম এসএমজি প্রভৃতি।

তাছাড়া জাদুঘরের দেয়ালজুড়ে সেঁটে দেওয়া হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা সামরিক সদস্যদের যুদ্ধের সময়ের ডায়েরি, হাতে লেখা বিভিন্ন বার্তা, আলোকচিত্র ও পোস্টার। এই জাদুঘরটি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। সামরিক জাদুঘরের গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়বে ট্যাংক পি টি-৭৬। রাশিয়ার তৈরি এই ট্যাংকটি পানিতেও ভেসে চলতে সক্ষম। এই ট্যাংকটি ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া এলাকা থেকে বাংলাদেশ বাহিনী কর্তৃক পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর নিকট হতে উদ্ধার করা হয়।

সামরিক জাদুঘরের মাঠের উত্তর ও পূর্ব দিক দিয়ে সুসজ্জিতভাবে সাজানো রয়েছে আরও ১৬টি ট্যাংক ও কামান। এগুলো খোলা আকাশের নীচে রাখা আছে। মাঠের পূর্ব প্রান্ত দিয়ে সারিবদ্ধভাবে প্রদর্শিত হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত ১০৫/৫২ সি এম ক্রুপ গান, ১৯৭৩ সালে মিসর কর্তৃক আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে ব্যবহৃত ব্যারেল ১০০ মি. মি. ট্যাংক গান, অষ্টাদশ শতাব্দীর ছয়টি ছোট-বড় কামান।

মাঠের উত্তর-পশ্চিম দিকে প্রদর্শিত হচ্ছে মোটরলঞ্চ ‘এম এল সূর্যোদয়’। এটি জাপান সরকার অনুদান হিসেবে দিয়েছিল। মূল ভবনের দোতলায় রয়েছে ৮টি গ্যালারি। প্রথম গ্যালারিতে হাত-কুঠার, তীর, ধনুকসহ পুরনো যুগের অস্ত্রশস্ত্র প্রদর্শিত হচ্ছে। দ্বিতীয় গ্যালারিতে রয়েছে ডিবিবিএল গান, এসবিবিএল গান, বিশেষ ব্যক্তিবর্গের ব্যবহৃত হাতিয়ারসহ যুদ্ধাস্ত্র।

তৃতীয় গ্যালারিতে রয়েছে এলএমজি, এসএমজিসহ মাঝারি ধরনের অস্ত্র। চতুর্থ গ্যালারিতে রয়েছে মর্টার, স্প্যালো, এইচএমজিসহ ভারী অস্ত্র। পঞ্চম গ্যালারিতে সর্বসাধারণের জন্য প্রদর্শিত হচ্ছে সশস্ত্র বাহিনীর শীত ও গ্রীষ্মকালীন পোশাক পরিচ্ছদ, র‌্যাঙ্ক ব্যাজ ও ফিতা।

ষষ্ঠ গ্যালারিতে প্রদর্শিত হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের দলিল, সেক্টর কমান্ডারদের পোর্ট্রেট, কিছু ব্যবহার্য সামগ্রী। সপ্তম গ্যালারির নাম দেয়া হয়েছে ‘বিজয় গ্যালারি’। এতে সশস্ত্র বাহিনীর যেসব ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধে জীবন দিয়েছেন তাদের পোর্ট্রেট ও সংক্ষিপ্ত জীবনী প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। অষ্টম গ্যালারিতে রয়েছে সাবেক সব সেনাপ্রধানের তৈলচিত্র, বীরশ্রেষ্ঠ ও বীরপ্রতীকদের নামের তালিকা। ভবনের নীচতলায় প্রদর্শিত হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল এম এ জি ওসমানী যে গাড়িটি নিয়ে বিভিন্ন যুদ্ধ এলাকা পরিদর্শন করেন সেই জিপ। এর পাশাপাশি রয়েছে গোলন্দাজ বাহিনী কর্তৃক ব্যবহৃত ১৪.৫ মি. মি. কোয়াড বিমান বিধ্বংসী কামান, ১২০ মি. মি. মর্টার ব্রান্ডেট এ এম ৫০, ১৯৭১ সালে পাকিস্তান বাহিনীর ব্যবহৃত ৬ পাউন্ডার ট্যাংক বিধ্বংসী কামান, ১০৬ মি. মি. রিকয়েললেস রাইফেল। আরও আছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে উদ্ধারকৃত স্টাফ কার মার্সিডিজ বেঞ্জ ও সিলিন্ডার ২০০০ সি সি। সামরিক জাদুঘরের বিশেষ আকর্ষণ ‘মুজিব কর্নার’। এটি মূল ভবনের নীচতলায় পশ্চিম পাশের কক্ষে সম্প্রতি স্থাপন করা হয়েছে। এখানে স্বাধিকার আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি বিজড়িত ৩০টি অঙ্কিত আলোকচিত্র স্থান পেয়েছে। এছাড়া ‘ইতিহাস দর্পণ’ নামে একটি আইটি কর্নার আছে এ জাদুঘরে। এখানে দুটি রুমের মধ্যে একটি ১১টি আকর্ষণীয় টাচ স্কিন কম্পিউটারের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত চলচ্চিত্র এবং দুর্যোগপূর্ণ মুহূর্তে করণীয় এবং অন্যটিতে বড় স্ক্রিনে ‘১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস’ নামের এক ঘন্টা ৫০ মিনিটের চলচ্চিত্র প্রদর্শন করা হয়।

সামরিক জাদুঘরের ‘ইতিহাস দর্পণ’ কর্মকর্তা আমিন জানান, এখন বিজয়ের মাস এ কারণে এখানে প্রতিদিন ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার লোক আসবে।

দর্শনার্থীর সম্পর্কে তিনি বলেন, নতুন ভবনের নির্মাণ কাজ শুরু হওয়ার পর থেকে লোকজন আসা কমে যায়। তবে এর কাজ শেষ হলে এখানে আবার আসবে ।

তিনি একটু ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সারাদেশের সরকারি কর্মকর্তারা সপ্তাহে দুই দিন ছুটি পায়। আমরা ছুটি পাই মাত্র একদিন। এটা একটা বৈষম্য। তিনি জানান, যে নতুন ভবনের নির্মাণ কাজ চলছে, সেখানে সামরিক বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধার আরও অনেক ইতিহাস সংযুক্ত করা হবে। এ সময় বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা পরিদর্শনে আসে। তবে অন্যান্য জাদুঘরের মতো প্রবেশ মূল্য থাকলে সবার মধ্যে একটা আকর্ষণ থাকত। এ জাদুঘর সপ্তাহে পাঁচ দিন খোলা থাকে। দিনগুলো হচ্ছে শনি, রবি, সোম, মঙ্গল ও বৃহস্পতিবার। গ্রীষ্মকালে সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত আর শীতকালে ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে। বুধবার বন্ধ থাকে। শুক্রবার বিকেল ৩টা থেকে ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকে। এছাড়া অন্যান্য সরকারি ছুটির দিন বন্ধ থাকে।

জাদুঘরে দর্শনার্থীরা মনোযোগ সহকারে ঘুরে ঘুরে দেখছেন আর মুগ্ধ হচ্ছেন। মুগদা থেকে আসা ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী আফরা আনাম জেসি বললেন, ‘পুরো মিউজিয়াম ঘুরে দেখছি। অনেক কিছুই জানা হচ্ছে।’

পুরো জাদুঘরটিকে এমনভাবে সাজানো হয়েছে, যাতে একজন দর্শনার্থী মুক্তিযুদ্ধে সামরিক বাহিনীর অবদান জানার পাশাপাশি এ বাহিনীর ইতিহাসও জানতে পারবেন।

 

/ডিডি/