ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৪ ১৪৩০

জামায়াত নিষিদ্ধ না হওয়ার জন্য বিএনপিই দায়ী: তুরিন আফরোজ

প্রকাশিত : ০২:০৩ পিএম, ২১ ডিসেম্বর ২০১৭ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ১১:৪১ পিএম, ২১ ডিসেম্বর ২০১৭ বৃহস্পতিবার

ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ

ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতাকারী দল জামায়াত। একাত্তরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এদেশের ছাত্র-তরুণ-যুবক, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে আপামর জনতা যখন বর্রর পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধরত। তখন জামায়াত ইসলামী ঘোষণা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে, পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মিলে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে হত্যাযঞ্জে মেতে উঠে। হাজার হাজার মা বোনের সম্ভ্রমহানি করে জামায়াত নেতারা। একাত্তরে সংঘটিত নানা অপরাধের বিচারে গঠিত ট্রাইব্যুনালে জামায়াত নেতাদের মানবতাবিরোধী এসব অপরাধ এরইমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে। 

জামায়াত ইতিমধ্যে যুদ্ধাপরাধী সংগঠন হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। দলটির শীর্ষস্থানীয় বেশ কয়েকজন নেতা মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দণ্ডিত হয়েছে। অনেকের সর্বোচ্চ সাজা হয়েছে। দলটির আমির ও সেক্রেটারী জেনারেলসহ বেশ কয়েকজন নেতার সর্বোচ্চ সাজা কার্যকর হয়েছে। সাজা ভোগ করছে কয়েকজন। রায়ের অপেক্ষায় আছে কয়েকজন।

এতোকিছুর পরও স্বাধীন দেশে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে একসময় এদেশের অস্তিত্ব অস্বীকারকারী জামায়াত। ২০১৩ সালে দলটিকে নিষিদ্ধ করার দাবি উঠেছিল শাহবাগ আন্দোলনে। সেই সম্ভাবনাও জেগে উঠেছিল। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তিসহ স্বাধীনতার পর জন্ম নেওয়া তরুণ প্রজন্ম আশায় বুক বেধেছিল যে, নিন্দিত ও ঘৃণিত জামায়াত নিষিদ্ধ হওয়ার মধ্য থেকে চার দশকের গ্লানি থেকে মুক্তি পেতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। কিন্তু আজও নিষিদ্ধ হয়নি জামায়াত।

কেন নিষিদ্ধ হচ্ছে না দলটি? হাজারো মানুষের প্রশ্ন আর কত অপরাধ দরকার একটি রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হওয়ার জন্য? দলটি অদৌ কি নিষিদ্ধ হবে? এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ একুশে টেলিভিশন অনলাইনকে বলছেন, জামায়াত নিষিদ্ধ না হওয়ার জন্য বিএনপিই দায়ী। এই দলটিই জামায়াতকে পৃষ্টপোষকতা দিয়ে আসছে। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান এদেশের রাজনীতিতে জামায়াতের পূনর্বাসন করেছেন। আর বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়া এই দলের চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের মন্ত্রী বানিয়েছেন। এমনকি এখনও তাদের সঙ্গে জোট বেধে রাজনীতি করছেন। তুরিন আফরোজের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন একুশে টেলিভিশন অনলাইন প্রতিবেদক লী আদনান

একুশে টেলিভিশন অনলাইন : এদেশে যুদ্ধাপরাধের জন্য দায়ী দল জামায়াত। ’৭১পরবর্তী সময়ে নানা ধরনের সন্ত্রাসী কার্যকালাপের সঙ্গে জড়িত থাকারও অভিযোগ রয়েছে দলটির বিরুদ্ধে। তবু কেন জামায়াত নিষিদ্ধ হচ্ছে না? যুদ্ধাপরাধ মামলার আইনজীবী হিসেবে বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?

তুরিন আফরোজ : জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার প্রধান অন্তরায় হচ্ছে বিএনপি। কারণ, জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার ব্যাপারটি যদি নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে করা যায়, এটি কিন্তু এক সেকেন্ডের ব্যাপার। এক খোচাতেই, একটি সিগনেচারেই- এটি করা সম্ভব। অতীতেও কিন্তু বেশ কয়েক দফা জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু আমরা কী দেখেছি? দেখেছি, বিএনপি যখনই ক্ষমতায় আসছে তখনই জামায়াতকে রাজনীতিতে ফিরিয়ে এনেছে। এমনকি বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান যখন ক্ষমতায় এসেছিলেন-এসেই কিন্তু তিনি জামায়াতকে পুনর্বাসিত করেছেন। তাহলে এই নির্বাহী আদেশ অর্থহীন হয়ে যাচ্ছে। কারণ, ক্ষমতার পটপরিবর্তন গণতান্ত্রিক সমাজে স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু আমরা দেখি যখনই পটপরিবর্তন হয় তখনই দলটি প্রতিষ্ঠিত হয়।

জামায়াত নিষিদ্ধের ব্যাপারে আওয়ামী লীগেরও দায়বদ্ধতা রয়েছে। আমি রাজনৈতিক প্রসঙ্গে যাবো না। কিন্তু টেকনিক্যাল জায়গা থেকে সমস্যা থেকে যায়। নির্বাহী আদেশে হয়তো জামায়াত নিষিদ্ধ করা হলো। কিন্তু পটপরিবর্তনের পর আরেক নির্বাহী আদেশে সেটি বাতিল হয়ে যায়।

আমরা অতীতে দেখেছি জামায়াত শুধু পুনর্বাসিতই হয়নি, ওই দলে থেকে ঘৃনিত ও চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীরা মন্ত্রীও হয়েছে। তারা ক্ষমতায় গেছে ও নির্লজ্জের মতো সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছে। যে সংবিধান তারা বিশ্বাস করে না, সেই সংবিধানের উপর হাত রেখে ওয়াদা করে শপথ নিয়ে সংসদে গেছে। সুতরাং আজকে যদি বিএনপির রাজনীতি থেকে জামায়াতকে সরানো যেত, জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এক মঞ্চে অংশ নিত, তাহলে কিন্তু জামায়াতকে নির্বাহী আদেশে নিষিদ্ধ করা সম্ভব হতো। আজকে একটি দল জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে চাচ্ছে, অন্য আরেকটি দল জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরছে, সেক্ষেত্রে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা যাবে না। সুতরাং জামায়াতকে নিষিদ্ধের অন্তরায় হিসেবে কিন্তু আওয়ামী লীগকে বলা যাবে না।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন : কিন্তু বিএনপি বলছে, এটা নির্বাচনকালীন জোট।

তুরিন আফরোজ : কথাটি একেবারেই ভিত্তিহীন। যদি এটা নির্বাচনকালীন জোট হয়ে থাকে, তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে- এটা কেমন নির্বাচনী জোট? এক্ষেত্রে হয় তারা আদর্শহীন রাজনীতি করছে, না হলে তারা জামায়াতের আদর্শে বিশ্বাসী। ২০০৪ সালে ইসলামী ছাত্র শিবিরের অনুষ্ঠানে তারেক জিয়া বলেছেন, শিবির ও ছাত্রদল এক মায়ের পেটের দুই ভাই। ভাইদের মা কী জামায়াত নাকি বিএনপি, তা আমরা জানতে পারলাম না। আবার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতের নেতা কাদের মোল্লা ২০০৭ সালে ইত্তেফাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, বাংলাদেশে একাত্তর সালে কোনো মুক্তিযুদ্ধ হয়নি। যারা নিজেদের মুক্তিযোদ্ধা বলেন, তারা গিয়েছিলেন নারীদের ধর্ষণ করতে, না হয় ভারতের দালালী করতে। আবার বিএনপি বলছে, তাদের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান সাহেব মুক্তিযোদ্ধা। তাহলে তিনি কোন কারণে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন? নারী ভোগ করতে নাকি ভারতের দালালি করতে? সেই উত্তর এড়িয়ে গিয়ে আপনারা তাদের সঙ্গে নির্বাচনী জোট করছেন। তাহলে প্রশ্ন উঠে, আপনাদের আদর্শ কী? আপনাদের আদর্শ আর জামায়াতের আদর্শে তো কোনো ফারাক দেখি না।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন : জামায়াতকে যদি নিষিদ্ধ করতে হয়, তাহলে আইনগত করণীয় কী?

তুরিন আফরোজ : জামায়াতকে যদি নিষিদ্ধ করতে হয়, তাহলে আদালতের মাধ্যমে আমাদের এগোতে হবে। যেমন ইতোমধ্যে উচ্চ আদালতের একটি মামলার মাধ্যমে তাদের নিবন্ধন বাতিল হয়েছে। কিন্তু তাতে শুধু তাদেরকে নিবার্চনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত রাখছে। কিন্তু তারা তো দল হিসেবে টিকে থাকছে। তারা তো সামাজিক একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে টিকে থাকছে। ইতোমধ্যে আদালত, ট্রাইব্যুনাল নানা সময়ে বলেছে, জামায়াত হচ্ছে একটি অপরাধী সংগঠন। দল হিসেবে এটিকে সমূলে উৎপাটন করতে হবে। এটিকে শুধু নিষিদ্ধ নয়, বরং একটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই নিষিদ্ধ করতে হবে। তাহলো-

১. জামায়াতে ইসলাম নামে কোনো দল বাংলাদেশে থাকবে না।

২. একই আদর্শ নিয়ে অন্য কোনো দল গঠন করতে পারবে না।

৩. তাদের সদস্যরা অন্য কোনো দলে গিয়ে রাজনীতি করতে পারবে না।

সম্পৃক্ততার কারণে এখানে তাদের অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের কথাও চলে আসবে।’৭৩ সালের আইনের মধ্যে, এই দলের বিচারের ক্ষেত্রে আইনের সংশোধন আনার কথা রয়েছে। ২০১৪ সালে আমাদের আইনমন্ত্রী বলেছেন, আমরা অপেক্ষা করছি। আইনটির সংশোধন যখন হচ্ছে, তখনই মামলাটিকে আবারও জাগিয়ে তোলা হবে। আপনি জানেন, ২০১৪ সালের ২৭ মার্চ আমার নেতৃত্বে সাত সদস্যের একটি টিম করা হয়েছে। আইনমন্ত্রী বলেছেন, আইনটি সংশোধন হয়ে আসার পরে আমরা মামলাটিকে সামনের এগিয়ে নিয়ে যাব।

/ডিডি/