ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৮ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৪ ১৪৩০

নব্য দোসর

স্মৃতি ভদ্র

প্রকাশিত : ০৫:৩৩ পিএম, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৭ শনিবার | আপডেট: ১১:৩৪ এএম, ১৬ জানুয়ারি ২০১৮ মঙ্গলবার

অগ্রহায়ণ মাস প্রায় ফুরিয়ে এলো। সূর্য ওঠে আর ডোবে কুয়াশার পর্দা ঘিরে। কোনো দিন আবছা ধোয়াটে কুয়াশা তো কোনোদিন গাঢ় সাদায় চারদিক অস্পষ্ট।

আজ সকালে এক হাত দূরের মানুষও চোখকে ফাঁকি দিচ্ছে কুয়াশার জন্য। রতন গাছি দুয়োর খুলে যখন উঠোনে দাঁড়ালো একটা ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝাপ্টা যেন চামরায় সূচ ফুটালো। গায়ের চাদর দিয়ে যখন কান মাথা ঢেকে নিচ্ছে রতন গাছি তখন আশরাফ উদ্দিনের ঘর থেকে ভেসে আসা অনবরত কাশির আওয়াজ রতনকে ব্যস্ত করে তোলে। রতন গাছি দৌড়ে যায় গোলপাতাও ছাওয়া ঘরটাতে। শীতের কুয়াশা পাতার আবরণ ভেদ করে আশরাফ উদ্দিনের ছালা বিচুলির বিছানাটা স্যাঁতস্যাঁতে করে দিয়েছে।

" বাজান, একটু পানি খাবা?" বলে ঝিনুইয়ে করে একটু পানি ধরে আশরাফ উদ্দিনের মুখের কাছে।

মাথা উঁচিয়ে পানিটা মুখে নেবার চেষ্টা করে আশরাফ উদ্দিন। পারে না, কাশির দমক আর শরীরের অক্ষমতায় পানি টুকু ঠোটের পাশ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে। গায়ের চাদর দিয়ে রতন গাছি পরম মমতায় বাবার মুখটা মুছিয়ে দেয়।

"শ্বাস নিতি কষ্ট হচ্ছে বাজান? একটু ঠেকনা দিয়ে বসায়ে দেবো?"  স্যাঁতস্যাঁতে দু`টো কাঁথা আর কিছু ছেঁড়া ছালার দঙ্গল আশরাফ উদ্দিনের গা থেকে সরাতে সরাতে বলে রতন গাছি।

ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে আশরাফ উদ্দিন, কিছু বলে না। রতন গাছি আর একটা শুকনো কাঁথা দিয়ে তার বাজানকে জড়িয়ে বেড়ায় ঠেকনা দিয়ে বসিয়ে দেয়।

" আজ কাম শেষে ঝিকরগাছা বাজারে যাবো নে বাজান। তোমার জন্য কফের ওষুধ আনতি হবি। আর কিছু খাতি ইচ্ছে হলে বলবা কিন্তু। আমি বাজার থিকে আনি দিবো।" বলতে বলতে রতন মাঝি আশরাফ উদ্দিনের বুকে আস্তে আস্তে হাত বুলায়। বাবার শ্বাসের কষ্ট রতন মাঝিকেও খুব কষ্ট দেয়। তাই বাজানকে বিভিন্নভাবে আরাম দেবার চেষ্টা করে সে। আর করবেই বা না কেনো। বাজান রতন মাঝির সব কিছু। মা তো সেই কবেই রতন গাছিকে ১০ বছরের রেখে মারা গেছে। এরপর থেকে বাজান তার সবকিছু। বাপ-বেটার এই গরীব সংসারে যেটুকু সুখ,যেটুকু আনন্দ দেওয়া যায় তার সবটা দিয়েছে বাজান তাকে। সারাদিন পর কাজ শেষে ঘরে ফিরে নিত্য চাল ডাল ফুটিয়ে তাকে উপাদেয় করতে একটু ঘি ফেলে হোক বা ঈদের দিন গ্যাঁটের প্রায় সব টাকা শেষ করে সেমাই আর মোরগ কিনে এনে হোক, সব ভাবেই চেষ্টা করতো আশরাফ উদ্দিন ছেলের মুখে একটু হাসি ফোটাতে। চিনি কম হওয়া ল্যাটা সেমাই খেয়েও যখন রতনের চোখ মুখ খুশীতে উজ্জ্বল হয়ে উঠতো, তখন আশরাফ উদ্দিন লুকিয়ে চোখের জল মুছতো।

রতন গাছি বাজানের ঘর থেকে গলা বাড়িয়ে বৌকে ডাকে।

" ও বৌ, আজ বাজানের জন্যি একটা বাচ্চা মুরগী পাঠায়ে দেবো নে, তুমি পেঁপে দিয়ে পাতলা করে পাক করে দিও।" বউ উত্তর  দেয় না। রতন গাছি বউয়ের সারা না পেয়ে ঘরের বাইরে আসে।

হাসি উঠানের এক কোণায় পলিথিনে ঢাকা শুকনো পাতাগুলো টেনে বার করছে।

" আজ উনুন জ্বালাতি কষ্ট হবে নে, সব পাতা নিহরে ভিজে গ্যাছে। নতুন পলিথিন নিয়ে আসবেন আজ।" দু`হাত ভরে পাতা নিয়ে রান্নাঘরের দিকে যায় হাসি।

"এখনো উনুনে আঁচ দেও নি বউ, বাজানের ক্ষিধে পেয়ে যাবে নে।" রতন গাছি একটু অধৈর্য্য হয়ে ওঠে।

" আপনি রস নিয়ে আসতি আসতি হয়ে যাবা নে।" বলে হাসি চাল ডাল মিশিয়ে পাতলা জাউ রান্না করার প্রস্তুতি নেয়।

রতন গাছি কাছি আর দড়ি বাঁধা কয়েকটা হাড়ি হাতে এগোয় বাড়ির সামনের খেজুর গাছগুলোর দিকে। কাল সন্ধ্যায় বেঁধে আসা রস ভরা হাড়িগুলো এখন খুলবে। আর খেজুর গাছের কিছু অংশ কাছি দিয়ে আবার কেটে নতুন হাড়ি বেঁধে আসবে। তবে প্রথম কাটায় যে রস মেলে তা থেকেই যে সুঘ্রাণের পাটালি হয়, দোকাটায় আর তা হয় না। তা থেকে ঝোলা গুড় বানায় রতন গাছি।

রসের হাড়িগুলো যখন সব নামিয়ে নতুন হাড়ি বাঁধতে যাবে তখন চেয়ারম্যানের কাছের এক সাগরেদ এসে দাঁড়ায়।

" রতন গাছি কি সব হাড়ি নামায়ে ফেলেছো?" লোভী চোখে হাড়িগুলো দেখতে দেখতে বলে।

বিরক্তে চোখ মুখ কুঁচকে যায় রতনের।

" হ, তা সে খবর আপনের কি দরকার।" বিরক্ত হয়ে বলে রতন।

" চেয়ারম্যান পাঠালো যে আমারে, একটা ভাল দেখে রসের হাড়ি নিয়ে যেতে। আর তার গাছের রস তো সেই আগে খাবে নাকি তুমি তা মানতি চাও না।" বলেই মুখে একটি বিদ্রুপের হাসি ঝুলায় লোকটা।

তীব্র রাগটা লুকিয়ে রতন গাছি একটা বড় হাড়ি সাগরেদ টার হাতে দেয়। ছয়টা খেজুর গাছওল বাড়ির সামনের আঙিনাটা চেয়ারম্যানের কাছে বিক্রি করেছে রতন এবছরেই। যদিও বলতে গেলে বাধ্য করেই জায়গাটা নিয়েছে চেয়ারম্যান। এখন গাছগুলো বউয়ের একজোড়া সোনার দুল দিয়ে লিজ নিয়েছে। এই গাছগুলোই যে রতন গাছির জীবিকার একমাত্র উপকরণ।

" চেয়ারম্যান আজ কখন বাড়ি থাকবি? আমার দেখা করতি হবি।" সাগরেদ টাকে উদ্দেশ্য করে বলে রতন।

" আজ দুপুরের পরে আসো। দেখা করতি পারবানে।" বলেই লোকটা হাঁটা শুরু করে।

রতন গাছি রসের হাড়িগুলো নিয়ে গজগজ করতে করতে বাড়ির ভিতরে আসে। ততক্ষণে সূর্য কুয়াশাকে হারিয়ে তাপ ছড়াচ্ছে একটু একটু। রতন উঠে আসে আশরাফ উদ্দিনের ঘরে। পক্ষাঘাতগ্রস্ত বাজানকে কোলে নিয়ে বারান্দার রোদে হাসির করে রাখা বিছানায় শুইয়ে দেয়। সারাদিন বাজানকে এভাবেই হাসির চোখের সামনে রেখে যায়। আর পরের বাড়ির মেয়ে হাসিও পরম মমতায় বাজানকে সারাদিন আগলে রাখে।

একটা টিনের থালায় জাউ ভাতে একটু সরিষার তেল ঢেলে রতনের হাতে দেয় হাসি। আর একটি বড় বাটিতে জাউভাতে বয়াম চেঁছে শেষ ঘি টুকু নেয় হাসি।

" বাজানের ঘি কিন্তু শেষ হয়ে গেলো ; আনতি হবি আজ।" বলে বারান্দায় শুয়ে থাকা বাজানের পাশে গিয়ে বসে। ঝিনুইয়ে করে একটু একটু জাউ ঢালতে থাকে বাজানের মুখে হাসি। পাশে বসে তাড়াহুড়ো করে খেয়ে নেয় রতন গাছি।

রসের হাড়িগুলো নিয়ে হাশেম মিয়ার জমিতে বানানো বড় চুলায় জ্বাল দিতে নিয়ে যায়। হাড়ি থেকে রস ঢালে তাপালে। রস জ্বাল হতে হতে ঘন হতে থাকে। বাতাসে গুড়ের মিষ্টি গন্ধ ছড়াতে থাকে। রতন গাছি বুক ভরে সেই মিষ্টি গন্ধ নেয়। বাজানরে এই গুড় ঘনদুধে জ্বাল দিয়ে খাওয়াতি হবি, ভাবে রতন গাছি। হাসি চিতই পিঠা দুধে পছন্দ করে খুব। আর এই সুঘ্রাণের পাটালি পালি হাসিও খুব খুশী হবে নে, ভাবতে ভাবতেই রতন গাছি গুড় বানাতে থাকে।

কিছু গুড় বাড়ির জন্য রেখে বাকি গুড় বাজারে গিয়ে সুধেন সাহার মুদি দোকানে বিক্রি করে রতন গাছি। বাজানের জন্য কফের ওষুধ কিনে চেয়ারম্যানের বাড়ি যায়।

দাওয়াই বসে অপেক্ষা করতে থাকে। ভাতঘুম দিয়ে প্রায় ঘণ্টাখানেক পর চেয়ারম্যান আসে।

" কি রে রতন, কয় কেজি গুড় বাঁধিছিস আজ।" পান চিবোতে চিবোতে বলে চেয়ারম্যান।

" কেজি চারেক মতন হবি। সে কথা বাদ দেন চাচা। বাজানের ভাতা-র ব্যবস্থা করতি পারলেন?" কিছুটা ব্যতিব্যস্ত  রতন গাছি।

" সরকারের অফিসে তো জমা দিছি তোর বাপের কাগজ, খবর পালাম দুই মাস পরে হবি।" ঠাণ্ডা গলায় বলে চেয়ারম্যান।

" এক মাসের মধ্যি ভাতা-র কাগজ করি দেবেন বলে জায়গাটা লিখে নিলেন। বাজান এত কষ্ট পাচ্ছে যে কি বলবো। এই ভাতা পালি চিকিৎসা করাতি পারতাম। প্রতি মাসে বাজানের ওষুধ কিনতি অনেক পয়সা লাগে। ভাতাটা পালি বাজানের দেহের ব্যাথা কমাতি ওষুধ পথ্যি সব করতি পারতাম। দ্যাশের জন্যি যুদ্ধ করিছিলো। দ্যাশ তো কিছুই দেয় নাই বাজানরে। এটুকুন ভাতা পাতিও এত সময় লাগে! অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেও বাজান আমার ভাতা পায় না আর যারা যুদ্ধের সময় অন্য দ্যাশে পলাইছিলো তারা ভাতা খায় বসি বসি। আর ভাতা লাগবি নানে, বাজানের যুদ্ধের কাগজ ফেরত দিয়ে দেন আমারে" অসহিষ্ণু রতন গাছি।

" তুই কি বলতিছিস রতন? কে যুদ্ধ না করি ভাতা খায়।" চমকে উঠে বলে চেয়ারম্যান।

"সে বলতি গেলে অনেক কথা। সবাই সবকিছু জানিও চুপ করে থাকে ভয়ে। আপনে আমার মুখ খুলায়েন না। বাজানের কাগজ ফেরত দেন।" ক্ষেপে ওঠে রতন গাছি।

" তুই আমারে ভয় দেখাচ্ছিস। কত বড় বাপেরবেটা তুই দেখছি দাঁড়া" চিৎকার করে ওঠে চেয়ারম্যান।

চেয়ারম্যান কিছু বলার আগেই তার সাগরেদগুলো দুমদাম কিলঘুষিতে রতন গাছির দুনিয়া অন্ধকার করে ফেলে। হাতে রাখা গুড় আর বাজানের কফের ওষুধ ছিটকে পড়ে মাটিতে। রতন গাছি সেদিকে তাকিয়ে ক্ষিপ্র হয়ে ওঠে। নিজেও কিলঘুষি ফেরত দিতে থাকে চেয়ারম্যানের সাগরেদদের। অনেক কষ্টে ওদের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে চেয়ারম্যানের সামনে এসে দাঁড়ায়।

চিৎকার করে বলে," আপনে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা। ভুয়া ভাতা খান আপনে। আমার বাজান যুদ্ধ করি স্বাধীন করছে দ্যাশ। আমি বাজানের ভাতাও আপনেরে ভিক্ষা দিলাম। আপনে একটা ভিক্ষুক।" একদলা থু থু ফেলে চেয়ারম্যানের সামনে।

"বাজানরে আমি সুস্থ করবো নে। দ্যাশের কোনো সাহায্য লাগবি না। দ্যাশ থাকুক আপনের সাথে।” ঘৃণা উগরে দৃঢ় রতন গাছি ওষুধ আর গুড় ধুলো ঝেড়ে গায়ের চাদরে জড়িয়ে বাড়ির দিকে এগোয়, পিছনে দাঁড়িয়ে থাকে চেয়াল ঝুলিয়ে অবনত দ্যাশের প্রতিনিধি!

ছোট গল্প
এসএইচ/