ঢাকা, রবিবার   ১৯ মে ২০২৪,   জ্যৈষ্ঠ ৪ ১৪৩১

‌ ‘তস্কর’

লুনা নুসরাত

প্রকাশিত : ০৭:১২ পিএম, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৭ রবিবার | আপডেট: ১১:৩৩ এএম, ১৬ জানুয়ারি ২০১৮ মঙ্গলবার

ওই মা, মোক ভোগ নাইগছে, বাড়িত চল। ওই মা, ওই মা, হাঁটেক ক্যানে...

মদিনা বেগমের শাড়ির ঘোমটা দেওয়া আঁচলের প্রান্ত ধরে টানছে আর ঘ্যানঘ্যান করছে রতন। ভাদ্র মাসের তালপাকা গরমের ভর দুপুরবেলায় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে গেছে সে। পেটে চিড়বিড় করছে রাক্ষুসে ক্ষিদে। কতক্ষণ আর দাঁড়িয়ে থাকতে ভালো লাগে?

মদিনার ইচ্ছে করছে এক থাপ্পর দিয়ে বসিয়ে দিতে ছেলেটাকে। সারাক্ষণ খালি খাইখাই। এত ক্ষিদে তার আসে কই থেকে! বাসা থেকে বের হবার সময় পানি-ভাত লাবড়া দিয়ে মেখে খাইয়ে এনেছে। সে নিজেও খেয়েছে। কই তার তো ক্ষিদে লাগেনি!

রতনের দিকে কড়া চোখে তাকালো একবার। কিন্তু ছেলেটা ছোট, তার এই দৃষ্টিতে দমলো না। বরং তার ঘ্যানঘ্যান মিহি কান্নায় রুপ নিল। কাঁদতে কাঁদতেই ক্ষিদের কথা বলতে থাকে সে। আশেপাশের তার মত অপেক্ষায় থাকা লোকজন আড় চোখে তাকাচ্ছে তাদের দুজনের দিকে। রাগে মদিনার মুখে থুথু জমছে। পিচ্ করে থুথু ফেলে আঁচল দিয়ে মুখটা মুছলো।

হারামী ছাওয়া, দিন রাইত খালি ভোগ আর ভোগ। এত্ত ক্ষিদা তোর প্যাটত আসে কুন্ঠে হাতে? তোর বাপ জমিদারি রাখি গেইছে তোর তোকনে। সারাদিন খালি খাবু আর খেলাবু। মরির পাইস না। তুই মরিলে মোর শান্তি হয় এ্যানা। জন্মি হাতে মোক জ্বালায়ছিস। গজগজ করতে করতে পাঁচ বছরের রতনের হাতে হ্যাঁচকা টান দিয়ে নিয়ে গেল রাস্তার ওপারের মস্ত শিরিষ গাছটার নীচের একটা চায়ের অস্থায়ী দোকানে।

ভাইজান একখান ছোট রুটি আর একটা কলা দ্যানতো।

ছেলের হাতে খাবার ধরিয়ে বসিয়ে দিল দোকানের সামনে পেতে রাখা বাঁশের বেঞ্চে। নিজেও বসলো। এক গ্লাস পানি ঢেলে নিল শিকলে বাঁধা আ্যালুমিনিয়ামের কলসি থেকে।ঢকঢক করে পানিটা গিলে দোকানদারের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।

কত হইছে ভাইজান? টাকার পরিমাণ শুনে আঁচলের খুঁটে বাধা টাকা থেকে ময়লা কতগুলো নোট বের করে গুনে দিল দোকানীকে।

ভাইজান মোর ছাওয়াখানেক এ্যানা দেখেন, মুই আইসোছো এ্যালায়।

রতনকে বসতে বলে মদিনা রাস্তা পার হয়ে এলো ওপাশের বড় লাল ইটের দালানটার লোহার গেটের সামনে।
দুই পাহারাদারের একজনের কাছে গিয়ে জানতে চাইলো কোন খবর আছে কিনা।

ও ভাই, আর কতক্ষণ দাঁড়ে থাকিম? এ্যালাও ছুটি হয়ছে না ক্যানেএ? মোক তো কছিল সকাল দশটাতে ছুটি হইবে। তা এ্যালাও যে হয়ছে না? মোর ছাওয়াটা ছোট, থাকিবার চায়ছে না। খালি কাঁন্দেছে।

পাহারাদার দাঁত খিচিয়ে বলে উঠলো, ওই তোর ভাই কায়রে? মুই তোর কুন সমন্ধী ভাই রে? যা বসি থাক। সময় হইলে আপনে আসিবে। তোক পুছির নাইগবে না, যা এইঠে হাতে।

ধমক খেয়ে মুখ কালো করে ফিরে এলো গাছতলার চায়ের দোকানের সামনে। পাহারাদার টাকে মনে মনে কিছু অশ্রাব্য গালি দিল। হারামীর পুতের ম্যালা গরম হইছে। দেখিস ক্যানে তোর বিচার আল্লায় করিবে। অবশ্য দোষ তারও কিছুটা আছে। গত চার ঘণ্টায় কম করে হলেও দশবার জিজ্ঞেস করছে সে একই কথা। এই গরমের দুপুরে কার ই বা মেজাজ ঠিক থাকে?

চিরটাকাল মদিনা এমন ছিল না। নরম সরম শান্ত মদিনার কথা শুনতে দুইবার জিজ্ঞেস করতে হতো। হালকা পাতলা গড়নের মোটামুটি সুন্দরী মদিনার বিয়ে দিয়েছিল বাপ অল্প বয়সেই। রমিজ মিঞাই প্রস্তাব দিয়েছিল মদিনার বাপকে। আর এ অঞ্চলের আর সব বাপেদের মতই মেয়ের বিয়ের প্রস্তাবে লাফিয়ে উঠেছিল তার বাপ। খোঁজখবর না নিয়েই বিয়ে দিয়ে দিয়েছিল। মেয়ে পরের ঘরে পাঠানোর তাড়া এদিকের মানুষের একটু বেশি। তার ওপর বয়স যত বাড়ে ছেলের যৌতুকের অঙ্ক তত বড় হয়। তা মদিনার বাপকে তেমন বেশি কিছু দিতে হয়নি। একটা চৌদ্দ ইঞ্চি রঙিন টিভি আর নগদ ২৫ হাজার টাকা। বিয়ের পর দুই বছর বাপের বাড়িতেই ছিল মদিনা। তার জামাই আসছে গেছে। পরে অঘ্রান মাসের এক শুক্রবারে তাকে নিয়ে আসে রমিজ মিঞা।

গ্রামের শেষ প্রান্তে বাঁশঝাড়ের গাঁ ঘেঁষে বাড়ি। একটা বেড়ার ঘর, উপরে পুরান টিন ভিতরে বাঁশের চাটাই দেওয়া। রান্নাঘর বলে কিছু নাই। দাওয়ায় মাটি খুঁড়ে একটা চুলা আর মাথার উপর ছনের ছাউনি, চারটা নড়বড়ে বাঁশের উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর বাঁশবাগানের গাঁ ঘেঁষে একটা কাঁচা ল্যাট্রিন আর একটা পুরনো টিউবওয়েল। মনে মনে বাড়ি দেখে দমে গেলেও ভয় পায়নি। উৎসাহের সঙ্গে সব আপন করে নিয়েছে, যেমনি হোক তার নিজের সংসার!

প্রথম কটা দিন রমিজ মিঞা বাসায়ই থাকতো, বের হতো না। শুধু সদাইপাতি লাগলে বাজারে যেত। মদিনার দিন রান্না বাড়া আর ঘরদোরের কাজ করতেই ফুরিয়ে যেত। মানুষটা তাকে ভালোওবাসতো খুব। সব সময় কাছে কাছে থাকতো। কিন্তু সুখের দিন কি আর চিরদিন থাকে কারও?

মদিনা এক রাত্রে রমিজ মিঞাকে জানালো, সে পোয়াতী। খুশি হয়নি যে তার স্বামী তা না। তবে তার পর থেকেই সে বাইরে যেতে লাগলো, কাজের সন্ধানে। বসে বসে খেয়ে আর কদিন? মদিনার বাপের দেওয়া টাকা শেষ। টিভি তো বেচা হয়েছে আগেই। এখন কাজ না করলে উপোস দেওয়া লাগবে। কিন্তু কাজ কি আর রোজ রোজ পাওয়া যায়? কয়দিন পর রমিজ মিঞা এক রাতে তাকে ডেকে বলল,

বউ,আর উপায় নাই, চেষ্টাতো কম করনুনা । কিন্তুক কাম দিবার চায় না কাহো। এংকরি চললে না খায়া মরির নাইগবে। মুই গেনু, কুন্ঠে যায়ছি মোক পুছিস না। মুই কবার পাইম না। তুই ঘরোত খিল দিয়া শুতি থাক। মোর আইসতে আইসতে বিহান হইবে।

মদিনাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বের হয়ে গেল মানুষটা। পরদিন ফিরলো না। তার পরের দিনও না। পোয়াতী ভারী শরীর আর পেটে খিদের জ্বালা নিয়ে দুদিন অপেক্ষা করলো সে। তারপর বাসা থেকে বের হয়ে গ্রামের ভেতরের দিকটায় গেল। কয়েকজনের কাছে জানতে চাইলো তারা কেউ জানে নাকি রমিজ মিঞার কোন খবর। কিন্তু কেউ খোঁজ দিতে পারলো না।

বাসায় ফিরে এসে বাঁশঝাড়ের আনাচেকানাচে থেকে কোঁচড় ভরে ঢেঁকিশাক তুলে আনলো। একটু লবন দিয়ে সিদ্ধ করে খেয়ে পানি খেয়ে নিল। ক্ষিদে তো আর বিপদ বোঝে না, নিরুদ্দেশ বোঝে না!

পরদিন তার আর বের হতে হয়নি, গাঁয়ের দুইটা বউ এসে জানালো তার স্বামীর খবর। গঞ্জের দোকানে চুরি করতে গিয়ে ধরা পরেছে রমিজ মিঞা। পুলিশের হাতে তুলে দিয়ে দোকান মালিক ডাকাতির অভিযোগ দিয়েছে। খবর শুনে মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পরেছিল মদিনার। চোখ মুছতে মুছতে রওনা দিয়েছিল বাপের বাড়ি।

বাপের সঙ্গে গঞ্জে গিয়ে দেখা করে এসেছিল একবার তার স্বামীর সঙ্গে, যেদিন রায় দিয়েছিল জজ সাহেব। ডাকাতির অপরাধে ছয় বছরের সশ্রম কারাদণ্ড আর ১০ হাজার টাকা জরিমানা, নইলে আরও এক বছর অতিরিক্ত কারাদণ্ড। কেঁদে কেঁটে বুক ভাসিয়ে লাভ হয়নি কিছু। অভাবে হোক আর স্বভাবে হোক, প্রথম হোক আর সপ্তমবার হোক ধরা পরলে শাস্তি তো পেতেই হবে!

তিনমাস পর ছেলে হয়েছিল মদিনার। নাহ্, গ্রামে আর ফিরতে পারেনি সে। চোরের বউ এর দুর্নাম নিয়ে সেখানে থাকা অসম্ভব। বাপের বাড়িতেই কষ্টে-সৃষ্টে কাটিয়ে দিয়েছে এই বছর কটা। তবে দিনগুলো এত সহজে কাটেনি। বদনামের হাওয়া এ গাঁয়েও এসে পরেছিল। খাওয়া পরার জোগান আর নিত্য চোরের বউ হবার গঞ্জনা শুনতে শুনতে একটা সময় তার কোমল স্বভাব কখন যেন পরিণত হয় বদমেজাজে সে নিজেও ঠাহর পায় না।

আজ রতনকে নিয়ে জেলখানার গেটের সামনে দাঁড়িয়ে সেই পুরনো দিনগুলি ঘুরে ফিরে আসছিল বারবার। বুকের ভেতর কষ্টগুলো আজ আর তেমন করে কাঁদায় না তাকে। বরং চোখ দুটো থেকে থেকে জ্বলে ওঠে। এমন হলো কেন তার জীবনটা? চোরের বউ হওয়াটাই কি তার ভাগ্যের লিখন ছিল?

তাকিয়ে থাকে উদাস চোখে জেলখানার মস্ত বড় লোহার গেটটার দিকে। কখন যে আসবে লোকটা ওপার থেকে? দরজাটা খুলে যায়। রমিজ মিঞার দীর্ঘ দেহটা দেখা যায় গেটের ফাঁক দিয়ে।মাথা ঝুঁকিয়ে বের হয়ে আসে একজন অসফল তস্কর।

রতনকে হাতের ইশারায় দেখায় মদিনা, ওই যে তোর বাপ আইছে!

ছোট গল্প।

এসএইচ/