ঢাকা, সোমবার   ০৬ মে ২০২৪,   বৈশাখ ২৩ ১৪৩১

পশ্চিমবঙ্গে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম ও দিনবদলের গল্প

হাবিবুর রহমান

প্রকাশিত : ০১:৪৫ পিএম, ১৮ জানুয়ারি ২০১৮ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ০২:৪৬ পিএম, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ সোমবার

ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি হচ্ছে। পরিবর্তনের হাওয়ায় রাজ্যের রাজধানী কলকাতা শহর দ্রুত বদলে যাচ্ছে এক আধুনিক নগরে। উন্নয়ন ও অগ্রগতির ছাপ এখন স্পষ্ট কলকাতা শহর ও শহরতলী এলাকায়। আধুনিক ও সুশৃঙ্খল ট্রাফিক ব্যবস্থা, সুন্দর পরিচ্ছন্ন পথঘাট, পরিকল্পিত নতুন টাউনশিপ, নতুন নতুন স্থাপনা ও ভবনে কলকাতা শহর যেন সেজে উঠছে এক তিলোত্তমা মহানগরে। যারা সাত-আট বছর পর কলকাতা যাবেন তাদের চোখে এ ফারাক সহজেই ধরা পড়বে।

পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতি একটা দীর্ঘসময় ধরে স্থবির ছিল। সেই সময় অনেকেই পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতি নিয়ে শুধু হতাশার কথা বলতেন এবং এ পরিস্থিতির জন্য দীর্ঘস্থায়ী বামপন্থী শাসনকে দায়ী করতেন। তবে কারণ যাই হোক না কেন, এখন এটি দিবলোকের মতো পরিষ্কার ও স্পষ্ট যে, পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতিতে নতুন প্রাণের সঞ্চার হয়েছে এবং জেগে উঠছে শত সোনালী সম্ভাবনার হাত ধরে। এইউন্নতির ছোঁয়া শুধু কলকাতা শহর কিংবা এর বাসিন্দাদের জীবনে নয়, এর ঢেউ লেগেছে গ্রামীণ জনপদে এবং প্রান্তিক মানুষদের জীবনেও।

সম্প্রতি ব্যক্তিগত ভ্রমণে পশ্চিমবঙ্গ গিয়েছিলাম। এ সফরে পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়ন সংস্থা আশা ইন্টারন্যাশনাল ইন্ডিয়া এর কিছু কার্যক্রম দেখার সুযোগ ঘটে। প্রায় এক দশক ধরে আশা ইন্টারন্যাশনাল ইন্ডিয়া পশ্চিমবঙ্গ এবং প্রতিবেশী কয়েকটি রাজ্যে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে
নিম্ন আয়ের মানুষদের ঋণ সহায়তা দেওয়ার উদ্দেশ্যে। প্রতিষ্ঠানটিকে কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে বাংলাদেশের বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা আশা। নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দারিদ্র্য বিমোচনে আশা ইন্টারন্যাশনাল ইন্ডিয়া সেখানকার স্বল্প আয়ের মানুষদের কার্যকর সহায়তা দিয়ে তাদের জীবনমানের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

প্রতিষ্ঠানটির সহায়তাপ্রাপ্ত মানুষদের অবস্থা জানতে কলকাতার শহরতলী ও উত্তর ২৪ পরগনা জেলার প্রত্যন্ত গ্রাম ঘুরে দেখি। কথা হয় নানা পেশার মানুষের সঙ্গে। এদের একজন প্রতিমা নির্মাতা মাধব পাল ও মলিনা পাল দম্পতি। এঁরা বহুদিন ধরে কলকাতা শহরের বিখ্যাত কুমারটুলিতে প্রতিমা তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। বিগত কয়েক বছর ধরে আশা ইন্টারন্যাশনাল ইন্ডিয়া তাদের ঋণ সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। এ ঋণে তাদের ব্যবসার গতি এসেছে। প্রতিমা তৈরি ব্যবসায় নগদ অর্থের প্রয়োজন হয়। কিন্তু ঋণ না পাওয়ায় তাদের পক্ষে ব্যবসা টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছিল। ভারতে সাধারণ মানুষের পক্ষে প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ পাওয়া অত্যন্ত কঠিন। যদিও মহাজনী ঋণ পাওয়া যায় কিন্তু সুদের হার অত্যন্ত চড়া। মহাজনী ঋণ নিয়ে ব্যবসা চালানো প্রায় অসম্ভব। আশা ইন্টারন্যাশনাল ইন্ডিয়া তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে সহজ শর্তে ও সহনশীল সুদে ঋণ নিয়ে। পশ্চিমবঙ্গে একের পর এক নানা পূজা- দূর্গা, লক্ষ্মী, কালী, কার্তিক, জগোধাত্রি ইত্যাদি চলতে থাকে । প্রতিটি পূজার জন্য আলাদা করে ঠাকুর প্রয়োজন হয়। তবে দূর্গা পূজার প্রতিমা গড়া এ ব্যবসার প্রধান সিজন। এসময়ে এই দম্পতি ১০টি পর্যন্ত দূর্গা প্রতিমা গড়েন। সারা বছরই প্রতিমা তৈরি করতে ব্যস্ত থাকতে হয় তাদের। যেগুলো ভারতবর্ষের নানা স্থান এবং ভারতের বাইরে ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন পূজা মন্ডপে স্থান পায়। প্রতিমা তৈরিতে কাজ করছেন ১০ জন কারিগর ও শ্রমিক। যাদের মাসিক বেতন ছয় হাজার টাকা থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। বর্তমানে মলিনা দম্পতির ৫০ হাজার টাকার ঋণ রয়েছে এবং তারা নিয়মিত কিস্তিতে তা পরিশোধও করছেন। সব ব্যয় মিটিয়ে তাদের এখন মাসে আয় ২০ হাজার টাকা। এ আয় তাদের পরিবারে স্বচ্ছলতা বয়ে এনেছে। পাল দম্পতির পরিতৃপ্ত মুখে সেই প্রতিচ্ছবি দেখা গেল। মলিনা পাল আবদার করলেন ছোট ঋণ এর বদলে আমাকে বড় দিন, ব্যবসাটাকে বড় করবো।

উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার দেগঙ্গা গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীনে চ্যাংদোনা গ্রামের খবিরন বিবির ঝাড়ু তৈরি কারখানাটি মনে রাখার মতো একটি প্রতিষ্ঠান। খবিরন বিবি ও তার স্বামী গফফার মন্ডল দু’জনে কারখানাটি চালান। এলাকাটি দক্ষিণবঙ্গে হওয়ায় এখানে প্রচুর নারিকেল গাছ জন্মে। এ দম্পতি নারিকেল পাতার শলাকা দিয়ে ঝাড়– তৈরি করে তা স্থানীয়ভাবে বিক্রির মাধ্যমে ব্যবসা শুরু করেছিলেন বেশ কয়েক বছর আগে। যথেষ্ট পুুঁজি না থাকার তাদের কারবারে প্রত্যাশিত উন্নতি হচ্ছিলো না এবং একই বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছিলো। বছর সাত-আট বছর পূর্বে হঠাৎই যে দেবদূতের মতো সহজ ঋণের বর নিয়েআশা ইন্টারন্যাশনাল ইন্ডিয়ার কর্মী হাজির হন তাদের সামনে। এটি ছিল তাদের কাছে বিশাল প্রাপ্তি। যেখানে সহজে ঋণ পাওয়া অনেকটা স্বপ্নের মতো। ঋণের টাকায় ব্যবসার উন্নতি শুরু হলে তাদের আর পিছনে তাকাতে হয়নি। ব্যবসার প্রসারে গ্রামের নারীরা এ কাজে যুক্ত হওয়ার সুযোগ পেয়ে যান। গ্রামের ১৫ নারী ও পুরুষ এখন এ কারখানায় কাজ করেন। গ্রামের নারীরা তাদের সংসারের কাজ সামলে এখানে কাজ করে আয় করার সুযোগ পাচ্ছেন। প্রতিদিন তারা ২০০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত আয় করতে পারছেন। এ আয়ে তাদের পরিবারগুলো একটু যেন সুখ-স্বাচ্ছন্দের মুখ দেখতে পাচ্ছে। খবিরন বিবি জানালেন ১০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে আশা ইন্টারন্যাশনালের ইন্ডিয়ার সঙ্গে তার লেনদেন শুরু হয়েছিল যা এখন দাঁড়িয়েছে ৬০ হাজার টাকায়। ব্যবসার আয় দিয়ে কারখানার জন্য সেড তৈরি করেছেন, বাড়ি করেছেন। দূরদুরান্তের ক্রেতারা তাদের উৎপাদিত পণ্য কিনতে ছুটে আসেন। কারখানা থেকেই সব মাল বিক্রি হয়ে যায়। ফলে বিপনণের জন্য বাড়তি সময়, শ্রম ও অর্থ কিছুই লাগে না। খবিরন জানালেন তার কারখানার মাসিক গড় আয় প্রায় ৩০ হাজার টাকা। পরিবার নিয়ে এখন তিনি বেশ সুখেই আছেন।

উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার দেওয়ানয়াটি গ্রামের আরেক উদ্যোক্তা আসমা ইয়াসমিন। বাড়িতেই গড়ে তুলেছেন পোষাক তৈরির কারখানা। এ কারখানায় ছেলেদের প্যান্ট ও শার্ট তৈরি হয় এবং এসব পোষাক বিক্রি হয় কলকাতার বড়বাজারে। প্রায় সাত বছর আগে আসমা আশা ইন্টারন্যাশনাল ইন্ডিয়া থেকে ১০ হাজার টাকা ঋণ গ্রহণ করেন। ঋণের অর্থ বিনিয়োগ করেন কারখানা ব্যবসায়। ধীরে ধীরে ব্যবসা বেড়েছে। সঙ্গে সঙ্গে আয়ও বেড়েছে। এ সাত বছরে ক্রমান্বয়ে আসমা ইয়াসমিন প্রায় দু’লক্ষ ঋণ পেয়েছেন আশা ইন্টারন্যাশনাল ইন্ডিয়া থেকে। ঋণের অর্থ সময়মতো পরিশোধে তার তেমন কোন অসুবিধা হয়নি। বর্তমানে ৬০ হাজার টাকা ঋণ চলছে এবং পরিশোধ প্রায় শেষ পর্যায়ে। তার কারখানায় ২২ জন শ্রমিক নিয়মিত কাজ করে। যাদের মাসিক বেতন ছয় হাজার থেকে ১২ হাজার টাকা পর্যন্ত। শ্রমিকরা জানালেন আগে তারা কাজের জন্য বম্বে যেতেন। এখন তাদের আর দূরে যেতে হয় না। গ্রামে থেকেই ভাল রোজগার করতে পারেন। আসমার এখন গড় মাসিক নিট আয় ৩০ হাজার টাকা। কারখানার আয় দিয়ে স্বামীর সঙ্গে বাড়িতেই তিন লাখ টাকা ব্যয়ে একটি পোল্ট্রি ফার্ম গড়ে তুলেছেন। আসমার দুটি ছেলেমেয়ে স্কুল ও কলেজ পড়ুয়া। এক সময়ের সনাতনী গৃহবধু আসমা এখন পুরোদস্তুর উদ্যোক্তা। উদ্যোম ও লক্ষ্য স্থির থাকলে যে কারও পক্ষে বড় কিছু করা সম্ভব তা দেখিয়ে দিলেন উত্তর চব্বিশ পরগনার জেলার এক অজ পাড়াগাঁয়ের এই সাধারণ নারী। আসমা অনেক দূরে যেতে চান। বললেন, স্যার আমাকে বড় লোন দিন, তাহলে কারখানা আরও একটু বড় করতে পারি। ঋণের টাকা নিয়ে ভাববেন না। সময় মতো পরিশোধ করে দেব। এ আত্মবিশ্বাস বলে দিচ্ছে একজন বড় উদ্যোক্তা হওয়া আসমার জন্য এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।

আশা ইন্টারন্যাশনাল ইন্ডিয়ার সার্বিক কার্যক্রম নিয়ে প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মি. অঞ্জন দাশগুপ্তের সঙ্গে কথা হলো তার সল্টলেকের অফিসে। বললেন সংস্থাটি দ্রুত সামনে এগিয়ে যাচ্ছে এবং বর্তমানে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষকে ঋণ সহায়তা দিচ্ছে। পোর্টফলিও’র নিরিখে বর্তমানে এটি ভারতে ১২ নম্বর ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান এবং সংস্থাটি পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, আসাম, মেঘালয়, মনিপুর ও উত্তর প্রদেশে কাজ করছে। ভবিষ্যতে উড়িষ্যা রাজ্যে কার্যক্রম চালানোর পরিকল্পনা করছে আশা ইন্টারন্যাশনাল ইন্ডিয়া। উল্লেখ করা প্রয়োজন বাংলাদেশর কয়েকজন পরামর্শক আশা ইন্টারন্যাশনাল ইন্ডিয়ার কার্যক্রম সরাসরি তদারকি করছেন। তাদের সুযোগ্য তত্ত্বাবধানে সংস্থাটি সাফল্যের পথে এগিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে।

বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের আর্থসামাজিক অবস্থা প্রায় একই ধরনের। এদুটি অঞ্চলের মানুষ একই ভাষা ও সাংস্কৃতির উত্তরাধিকার বহন করছে। তবে বাংলাদেশে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম অনেকদিন আগে শুরু হলেও পশ্চিমবঙ্গে তা চালু হয় অনেক পরে। বাংলাদেশে ক্ষুদ্রঋণের সাফল্য ভারত সরকারকে উদ্বুদ্ধ করেছে সেখানে এ কার্যক্রম চালু করতে। দেরীতে হলেও ক্ষুদ্রঋণের সুফল পাচ্ছে ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গের মানুষ। এর প্রভাবে শহর ও পল্লী অঞ্চলের নিম্ন আয়ের মানুষদের অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের অফুরন্ত সম্ভবনার দ্বার খুলে গেছে। যার লক্ষণ প্রকাশ পেয়েছে ইতোমধ্যেই। ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম নব প্রত্যাশা জাগিয়ে দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষের জীবনে। আর এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে সুফল ঘরে তুলতে তারা আন্তরিক প্রয়াস চালাচ্ছে।

উন্নয়ন কর্মী।

এসএইচ/