ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৮ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৪ ১৪৩০

ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড কাজে লাগাতে চাই কর্ম ও জীবনমুখী শিক্ষা

প্রকাশিত : ০৭:২০ পিএম, ১৮ জানুয়ারি ২০১৮ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ১০:৫৪ পিএম, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ শুক্রবার

বর্তমানে দেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ১০ লাখের মধ্যে কর্মক্ষম মানুষ ৬৬ শতাংশ। ২০৩০ সালে এ সংখ্যা ৭০ শতাংশে গিয়ে ঠেকবে। কারণ বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডে (জনসংখ্যাতাত্ত্বিক বোনাসকাল) প্রবেশ করেছে। এই ‘উর্বর’ জনগোষ্ঠীকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে না পারলে নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকবে। এজন্য এখনই উপযুক্ত সময় এসব কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগিয়ে দেশকে সমৃদ্ধ করার।

এই বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীকে দক্ষ করে গড়ে তুলতে প্রয়োজন কর্ম ও জীবনমুখী শিক্ষা বলে জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মো. আবু ইউসুফ। সম্প্রতি বাংলাদেশে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড আহরণের সুযোগ ও সঠিক ব্যবহারসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে একুশে টিভি অনলাইনকে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাতকারে তিনি এসব কথা বলেন। সাক্ষাতকার নিয়েছেন একুশে টিভি অনলাইন প্রতিবেদক তবিবুর রহমান।   

একুশে টিভি অনলাইন : ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট (জনসংখ্যাতাত্ত্বিক বোনাসকাল) প্রবেশ করেছে দেশ। এ সুযোগটা আমরা কতটা কাজে লাগতে পারেছি বলে আপনি মনে করেন ?    

ড. মো. আবু ইউসুফ : ২০১২ সালে আমাদের বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডে প্রবেশ করেছে। বর্তমানে বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৪০ শতাংশের বয়স ১৮ বছরের নিচে। ২০১২ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬০মিলিয়ন বা ১৬ কোটি; এই হিসাবে প্রায় ৭ কোটি জনগণ ১৮ বছর এর নিচে। উন্নত এবং উন্নয়নশীল খুব কম দেশই এই বিশাল কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী পেয়েছি। এটা সঠিকভাবে কাজে লাগতে সরকার বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছে। কিন্ত কিছু সমন্বয়হীনতার কারণে তেমন উন্নয়ন সম্ভব হয়নি। আগে এ বিপুল কর্মক্ষম জনসংখ্যাকে দক্ষতা বৃদ্ধিতে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থাকে কর্মও বাজারমূখী করতে হবে।

প্রতিবছর  ১৮ লাখ মানুষ শ্রমশক্তিতে যোগ হচ্ছে। সেই তুলনায় আমাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হচ্ছে একেবারেই অপ্রতুল। ফলে বৃদ্ধি পাচ্ছে বেকারত্ব। শিক্ষাবাজার মুখী করতে পারলে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত হবে না।

দেশের সমুদয় জনসংখ্যাতে চাকরি বাজারের চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তুলতে হবে। সেই শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ অবশ্যই আন্তর্জাতিক মানের হতে হবে। যাতে সেখান থেকে প্রশিক্ষণ দেওয়া পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নিয়ে কাজ করতে পারে।

দেশে বহু লোক আছেন যাদের সঠিকভাবে কাজ দিতে পারছি না। অনেকেই আবার বছরের কিছু সময় কাজ করে সারা বছর বসে থাকে। এজন্য কাজ থাকলেও সমন্বয় না থাকার কারণে আমার বিপুল জনগষ্ঠীকে কাজ দিতে পারছি না। এজন্য সরকারী-বেসরকারী সংস্থাদের মধ্যে সমন্বয় করতে হবে। 

একুশে টিভি অনলাইন :  বিশ্বে আর কোন কোন দেশে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট (জনসংখ্যাতাত্ত্বিক বোনাসকাল) প্রবেশ করেছিলো। ওইসব দেশ কিভাবে এ সুযোগ কাজে লাগিয়েছে?

ড. মো. আবু ইউসুফ: চীন, থাইল্যান্ড, ভারত, মালয়েশিয়সহ বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দেশ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড প্রবেশ করছে। অনেকেই এর সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করেছে। ভারত তথ্য-প্রযুক্তিতে বিপুল জনশক্তির কর্মসংস্থান নিশ্চিত করেছে। তারা সবাই আগে ‘মাষ্টারপ্ল্যান’ করছে। বিশ্ব শ্রমবাজারে কোন কোন বিষয়ে শ্রমিকদের চাহিদা আছে সেটি যাচাই করে মানবসম্পদ তৈরি করেছে ভারত। বিশ্বে বাজারের চাহিদা অনুযায়ী তাদের লোকগুলো তৈরি করছে। বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছে। বিশেষ করে আইটি ও কারিগারি শিক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।

একুশে টিভি অনলাইন : ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড (জনসংখ্যাতাত্ত্বিক বোনাসকাল) সুযোগ কাজে লাগাতে বিশ্বে অন্যান্য দেশগুলো কি কি কৌশল গ্রহণ করছে। আমরা সেটা করতে পারছি কি না ?

ড. মো. আবু ইউসুফ : বিশ্বের অন্যান্য দেশ আগে একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনা তৈরি করছে। তাদের এবিপুল জনগষ্ঠীকে বিভাবে কাজে লাগতে পারে। এর পর সুনির্ধারিত পরিকল্পনা সঠিকভাবে ব্যস্তবায়ন করছে। তাদের সরকারি বেসরকারি সংস্থার সমন্বয় ভিত্তিক কাজ করছে। বিশ্ববাজরের চাহিদার ভিত্তিতে বাংলাদেশে বিপুল কর্মক্ষম মানুষকে বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। তারা কোন ধরনের শ্রমশক্তি প্রয়োজন তা জানতে হবে। তাদের চাহিদা বুঝে শ্রমিকদের প্রস্তুত করতে হবে।

শুধু একটা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করলে হবে না। বিশ্ব শ্রমবাজারে টিকে থাকার জন্য দক্ষ লোক তৈরি করতে হবে। যেমন শেখ হাসিনা যুবউন্নয়ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। এখানে মাত্র ৭দিনের প্রশিক্ষণ দেয়। ৭দিনে প্রশিক্ষণ নিয়ে শিক্ষার্থীরা কিছু করতে পারবে না। উন্নতি মানের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। শুধু রাজধানীও এমন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র দেশে বিভিন্ন জেলায় স্থাপন করতে হবে। এমনকি যারা প্রশিক্ষণ দিবে তাদের বিভিন্ন কোম্পানির সাথে ভাল যোগাযোগ করে চাকরির সুব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। দেশে অসংখ্যা কাজের সুযোগ আছে। কিন্তু অনেক মানুষ জানা না। তাদের জানাতে হবে এবং কাজের সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন : দেশে প্রচুর কর্মক্ষম মানুষ। তারা কাজ পাচ্ছে না। এদের দক্ষ করে কাজে লাগাতে হলে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে ?

ড. মো. আবু ইউসুফ : আমাদের কর্মক্ষম যুবশক্তিকে কাজে লাগাতে হলে দেশের চাকরির বাজারের চাহিদা কী আছে, অন্যান্য দেশে কী চাহিদা আছে, সব চাহিদাগুলো সামনে রেখে একটি সমন্বিত মানবসম্পদ উন্নয়ন পরিকল্পনা নিতে হবে। এখানে সরকারি বেসরকারি সংস্থাকে সস্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। বিশ্বে অবস্থিত দূতাবাসগুলোর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করতে হবে। কী পরিমাণ জনবল, কোন খাতে দরকার, দূতাবাসগুলো তা জানালে জনশক্তিকে প্রশিক্ষণ ও শিক্ষা দিয়ে কাজের উপযোগী করে গড়ে তোলা যেতে পারে। শুধু দেশেই নয়, প্রবাসে অবস্থানরত বাংলাদেশের শ্রমিকদেরকেরও সংশ্লিষ্ট দেশের চাহিদা অনুযায়ী প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজে লাগানোর ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় আমুল পরিবর্তন করতে হবে। তরুণ শিক্ষার্থীদের কর্ম ও বাস্তবমুখী শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। প্রযুক্তি ও কারিগরি শিক্ষার প্রতি জোর দিতে হবে। সবাই এমএ পাস, সবাই বিবিএ পাশ করলে হবে না। বরং চাকরি বাজারের চাহিদা যাচাই করে সেই অনুযায়ী শিক্ষা দিয়ে গ্রাজুয়েট তৈরি করতে হবে।শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি নিয়ে এখনই ভাবতে হবে। চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোকেও ভাবতে হবে। চাকরিতে নিয়োগ দিয়ে কর্মীকে যথাযথ প্রশিক্ষণ দিয়ে তার ভেতরকার প্রতিভা বিকাশের সুযোগ করে দিতে হবে। সর্বোপরি রাষ্ট্রকে বিষয়টি নিয়ে এখনই ভাবতে হবে। নতুবা ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্টের সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাবে।

একুশে টিভি অনলাইন : অর্থনীতিবিদেরা বলছেন আগামী ২০৩৪ সালে মধ্যে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সুযোগ হারাবে বাংলাদেশ। কিভাবে আমরা এর সঠিক ব্যবহার করতে পারি-একজন অর্থনীতিবিদ হিসাবে আপনার মতামত …

ড. মো. আবু ইউসুফ : প্রত্যেক দেশে বিভিন্ন সময় ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট (কর্মক্ষম বা জনসংখ্যা) সুযোগ আসে। বাংলাদেশেও ২০১২ সালে এ সুযোগ এসেছে। ইতোমধ্যে সরকার উদ্যোগ নিয়েছে। সবার সম্মিলিতি প্রচেষ্টার মাধ্যমে এর সর্বোচ্চ ব্যবহার করা সম্ভব। বিদেশ কাজের সঠিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দিতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থা পরিবর্তন করতে হবে।    

একুশে টিভি : কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সুষ্ঠু মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনার একটা প্রশ্ন চলে আসে। আমরা সঠিকভাবে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা করতে পারছি কি না?

ড. মো. আবু ইউসুফ : প্রতিবছর আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয় পড়াশুনা  শেষ করে ১৪ লাখ শিক্ষার্থী বের হচ্ছে। কিন্তু তারা চাকরি পাচ্ছে না। এর মূল কারণ আমার শিক্ষার্থীদের বাজার মূখী শিক্ষা নিশ্চিত করতে পারছি না। তেমনকি ভাবে বিশ্ববাজারে আমাদের শ্রমিকদের চাহিদা তৈরি করতে শ্রমমূখী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। বাজারে কেমন শ্রমিকের চাহিদা আছে তার আলোকে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গণহারে গ্রাজুয়েট বের না করে। কর্মমুখী গ্রাজুয়েট বের করতে হবে।     

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: আমাদের বিপুল জনসংখ্যাকে অনেক বিশেষজ্ঞ বোঝা মনে করেন, আপনিও তাই মনে করেন কী না?

ড. মো. আবু ইউসুফ : আমি বোঝা বলতে রাজি নয়। কারণ আমি যদি সঠিকভাবে জনসংখ্যাকে ব্যবহার করতে তাহলে সম্পদ। আর যদি না ব্যবহার করতে পারে তাহলে বোঝা। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্টকে কাজ লাগতে সরকার ১০০টি ইকোনোমিক জোন গঠনে কাজ করছে। ইতোমধ্যে ১০টির কাজ শুরু হয়েছে।এগুলো সব হয়ে গেলে বিপুল জনসংখ্যার কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে।  

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: বর্তমানে কোন কোন খাতে দক্ষ মানবসম্পদের অভাব আছে বলে মনে করেন এবং ভবিষ্যতে কোন খাতে সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থান হতে পারে?

ড. মো. আবু ইউসুফ : তথ্য প্রযুক্তিতে অনেক দক্ষ মানক সম্পদের অভাব রয়েছে। এদিকে পোষাক শিল্প অনেকে আগে থেকেই সুনামের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। আগামীতে চামড়া শিল্পের সম্ভাবনা অনেক বেশি। ইতোমধ্যে সরকার বিভিন্ন চামড়া শিল্পকে নিয়ে মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে।

একুশে টিভি অনলাইন: মূলবান সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

ড. মো. আবু ইউসুফ : একুশে টিভি পরিবারকেও ধন্যবাদ।

‘প্রফেসর ড. মো. আবু ইউসুফ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যান। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকোনোমিক্স বিভাগে আন্ডারগ্রাজুয়েট করেন। সেখানে অনার্সে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট এবং মাস্টার্সেও ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে পাশ করেন। তিনি ডেপেলপমেন্ট স্টাডিজে মাস্টার্স করেছেন হ্যাগের ইনস্টিটিউট অব সোস্যাল স্টাডিজ থেকে। পরবর্তীতে কমনওয়েলথ বৃত্তি নিয়ে যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেন। তিনি দারিদ্র, সামাজিক নিরাপত্তা, ওপেন বাজেট ও হেল্থ বাজেট অ্যানালাইসিসসহ বিভিন্ন ইস্যুতে উন্নয়ন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করছেন। বর্তমানে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার অন বাজেট অ্যান্ড পলিসির পরিচালক।’