ঢাকা, মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ৩ ১৪৩১

স্মাগলার

বেনাপোলের অভিজ্ঞতা

মো. মতিউর রহমান

প্রকাশিত : ০৭:৪০ পিএম, ২৮ জানুয়ারি ২০১৮ রবিবার

সকালে অফিসে রওনা হবার আগে মনজুর মোরশেদ দৈনিক পত্রিকা দেখেন। এটা তার দীর্ঘদিনের অভ্যাস। খুব জরুরি কিংবা গুরুত্বপূর্ণ কিছু না হলে পুরো খবর পড়েন না। হেডিং দেখেই ছেড়ে দেন। পত্রিকার পাতা উল্টে-পাল্টে দেখার সময় পেছনের পৃষ্ঠায় একটা খবরে নজর আটকে যায়- বেনাপোলে আমদানি-রপ্তানি বন্ধ। তুচ্ছ ঘটনায় জের ধরে এটা ঘটেছে। ইমিগ্রেশন পুলিমের এক কর্মকর্তা ভারত থেকে আসা দুই লাগেজ-পার্টি নিয়ে বিনা তল্লাশিতে কাস্টমস চেকপোস্ট পার করাচ্ছিলেন। এতে বাধা দেওয়ায় কাস্টমস কর্মকর্তাদের ওপর হামলা ও অফিস ভাংচুর। পরে এ ঘটনার জের ধরে বেনাপোল বন্দর দিয়ে বাংলাদেশ-ভারত আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যায়। কারণ হামলাকারীদের শাস্তির দাবিতে সেখানকার কাস্টমস্‌ অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন কর্ম-বিরতিতে যায়। হামলায় গুরতর আহত কয়েকজন কাস্টমস কর্মকর্তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। খবরটা পড়ার পর মনজুর মোরশেদের মনে পড়ে গেল বেনাপোলের কথা। একজন কাস্টমস কর্মকর্তা হিসেবে তিনিও সেখানে কর্মরত ছিলেন এক যুগ। কম করে আঠারো বছর তো হবেই, সেখান থেকে তিনি বদলি হয়ে চলে এসেছেন। তারপর আর যাওয়া হয়নি। সেটা নানা ব্যস্ততার কারণে। দেশ জুড়ে অবকাঠামোগত যে উন্নয়ন, তাতে দেশের পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত এবং সবচেয়ে বড় স্থলবন্দর বেনাপোলও আর আগের মতো নেই- নিশ্চয় পাল্টে গেছে। সেখানেও উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে। সেটাই স্বাভাবিক।

বড় ব্যস্ত এলাকা। রাতদিন সেখানে কাজ চলে। ভারত থেকে ট্রাকের পর ট্রাক ভরে মাল আসছে, বাংলাদেশ থেকেও যাচ্ছে। জাতীয় রাজস্ব আহরণের অন্যতম স্থলবন্দর হলো বেনাপোল। আর এটা মাথায় রেখে সেখানকার কর্মস্থলে পা রেখেছিলেন। যদিও ঢাকা ছেড়ে যেতে তার বড় একটা ইচ্ছে ছিলো না। একে তো পরিচিত মহানগর, পরিচিত বন্ধু-বান্ধব আর আত্মীয়-স্বজন। তারপর সন্তানদের পড়াশোনার ব্যাপারটাও ছিল। কে যেতে চায় মহানগর ছেড়ে অজ মফস্বলে! যদিও অনেকেই মুখিয়ে থাকে বেনাপোলে পোস্টিং নেতে। সেটা যে উপরি আয়ের টানে মনজুর মোরশেদের তা অজানা নয়। কিন্তু তিনি আর পাঁচজন থেকে কিছুটা আলাদা। ব্যক্তিস্বার্থের চেয়ে দেশের স্বার্থটাই তার কাছে বড়। চাকরি জীবনের শুরু থেকে এটাই তিনি মেনে এসেছেন, এখনও মানছেন।

একজনস পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে মনজুর মোশেদ তার বাসভবন থেকে অফিসে গাড়িতে চড়েই রওনা হলেন অফিসের দিকে। সময় মতো যাতে কর্মস্থলে পৌঁছুতে পারেন- তাই আগেভাগেই বেরিয়ে পড়েন। আজকাল ঢাকায় শুধু জনসংখ্যাই নয়, যানবাহনের চাপ বেড়ে গেছে খুব। একমাত্র ছুটির দিনগুলি ছাড়া সাবলীলভাবে এগুনো দায়। কোথাও না কোথাও জ্যামে আটকা পড়তে হয়। আজও পড়লেন যথারীতি। তবে একবার ফ্লইওভারে উঠতে পারলে অফিসে পৌঁছে যাবেন দেখতে দেখতে। ফের বেনাপোলের স্মৃতি তাকে পেয়ে বসে। সেখানে জয়েন করার পরই টের পেয়েছিলেন চারদিকে অনিয়ম আর বিশৃঙ্খলা। এই যে আজ চেকপোস্ট নিয়ে ইমিগ্রেশন পুলিশ আর কাস্টমস কর্মকর্তাদের মাঝে হাতাহাতির খবর পত্রিকায় বেরিয়েছে তখনকার পরিস্থিতি কী খুব একটা ভালো ছিল? চেকপোস্টের কথাই ধরা যাক। তখন চেকপোস্ট ছিল পাসপোর্টধারী যাত্রীদের হয়রানির কেন্দ্র। চেকপোস্ট পার হতে গেলে সাধারণ যাত্রদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হতো। তখন মুশকিল আসানের ভূমিকা নিতো কোনো দালাল। স্বাচ্ছন্দ্যে চেকপোস্ট পার করার প্রলোভন দেখিয়ে দালালরা নানা কৌশলে যাত্রীদের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নিতো। সেই অর্থর বখরা পেত চেক পোস্টের একশ্রেণির অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারী। এই দুর্নীতির কারণে পাসপোর্টধারী যাত্রীদের চেকপোস্টে যে হয়রানি আর দুর্ভোগ পোহাতে হয়, মনজুর মোরশেদ সেটা মেনে নিতে পারছিলেন না। বেনাপোল কাস্টসম হাইসের একজন সহকারী কমিশনার বিসেবে এক্ষেত্রে কার কি কারণীয় কিছু নেই ?। এই প্রশ্ন তার মাঝে জেগে ইঠার পর এক দালালকে ডেকে বললেন – তোমরা যে চেকপোস্টে যাত্রী সাধারণেদের জিন্মি করে রেখেছো  এটা কী ঠিক হচ্ছে?

দালাল জবাব দেয়- কী করবেন স্যার, একা তো অনেক দিন ধরে চলে আসছে।

কথাটা মেনে নিতে পারেননি মনজুর মোরশেদ। মনে মনে সিদ্ধান্ত নেন, বেনাপোল কাস্টমস চেক পয়েন্টের অনিয়ম ও বিশৃঙ্থা দূর করতে হবে। আর সে সেটা করতে গিয়ে টেল পেলেন। মৌকাকে যেন ছুঁড়েছেন। শুধু কিছু কাস্টমস এবং ইশগ্রেশন পুলিশ কর্মকর্তা-কর্মচারী নয়। তাদের দোসর দলালের সঙ্গে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও  মাস্তুানও  তার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। যেহেতু সবার স্বার্থে আঘাত লেগেছে। নানাজনের হুমকি আর হম্বিতম্বি কানে এলও তিনি দমে যায়নি। তার উদ্যোগের ফলে  কাস্টমস কর্তৃপক্ষ কিছু পদক্ষেপ নেয়।ফলে চেকপোস্টে শৃঙ্খা ফিরে আসে । ঢাকা এবং যশোরের পত্র-পত্রিকায় এই মর্মে খবর ও বেরোয় যে বেনাপোল সীমান্তে চেক পোস্টের পরিবেশ পাল্চে গেছে রাতারাতি। দলালদের দৌরত্ন যেমন আগের মতো নেই তেমনি নেই তেমনি নেই পাসপোর্টধারী যাত্রীদের ভোগান্তি।
জ্যামে আটকে থাকা গাড়ি আবার চলতে শুরু করেছে। সকাল থেকেই উজ্জ্বল রোদ। শীতকালে চললেও ঢাকায় এখনও ঠাণ্ডা পড়েনি পুরোদমে। মনজুর মোরশেদ দেখছেন ঢাকার তুলনায় বেনাপোলে শীতচা বেশিই পড়ে। এবারও নিশ্চয় ব্যতিক্রয় হবার কথা নয়। বখেন নিশ্চয় কন কনে ঠান্ঠা পড়েছে। ওখানকার কোয়ার্টারের কথা মনে পড়ে। বেশ নির্জন জায়গা, আশে পাশে নানা গাছগাছালি এতদিনে নিশ্চয় সেখানে পরিবর্তন হয়েছে। একদিন সদ্ধ্যা ড্রইংরুমে বসে স্ত্রীর আর ছেলেমেয়ের সঙ্গে টিভি দেখছিলেন। রাত কিছুটা গড়াবার পর বেজে ওঠে কলিংবেল। ওই কলিংবেলের শব্দ শোনার সময়ও ঘুনাক্ষরেও ভাবতে পারেননি, কয়েকজন সশস্ত্র দুর্বৃত্ত এসেছিল তাকে হত্যা করতে। মনজুল মোরশেদ জানতেন, স্বার্থহানী হওয়ায় বেনাপোলের কিছু লোক তার ওপর চটে গেছে। তাই বলে তারা যে সশস্ত্র গুন্ডা পাঠাবে তাকে মারার জন্য- সত্যিই কখনো ভাবতে পারেননি। বেনাপোলে থাকা অবস্থায় বরাবরই তিনি নিজের বিবেকের কাছে পরিষ্কার ছিলেন। কোনো অপরাধ করেননি। শুধু নিজের ওপর অর্পিত দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করার চেষ্টা করেছেন মাত্র। এতে স্বার্থ ক্ষুন্ন হওয়াতে কেউ তার ওপর ক্ষুব্ধ হলেও করার কিছুই ছিলনা।

বেনাপোল কাস্টম হাউজে যোগদানের পর মনজুর মোরশেদ শুধু চেকপোস্টে অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলা নয়, তিনি লক্ষ্য করলেন কাস্টমস হাউস দিয়ে বৈধ আমদানির ছদ্মাবরণে ভারত থেকে অবৈধ মালামাল নিয়ে আসা হয়। এতে বিপুল পরিমাণের রাজস্ব সরকারের হাতছাড়া হচ্ছিল। একজন কাস্টমস কর্মকর্তা হিসেবে দেশের এই ক্ষতি মেনে নেয়াটা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। ব্যক্তিগত আগ্রহ ও উদ্যোগে তিনি অনুসন্ধানে নেমে দেখতে পান, স্টেনলেস স্টিলের ক্রোকারিজ সামগ্রি, শাড়ি এবং থ্রি-পিস জাতীয় বস্ত্র আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক ফাঁকির প্রবণতা বেশি। পাশাপাশি গ্রানাইড মার্বেল পাথর, কেমিক্যালস, কাগজ ইত্যাদি পণ্যেও শুল্ক ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে। সংঘবদ্ধ চক্র এসব বেআইনি কাজ করছে। মনজুর মোরশেদ অবাক হয়ে গেলেন এই চোরাচালান চক্রের সাথে বেনাপোলের কিছু অসৎ ব্যক্তির যোগসাজশ দেখে। যে কারণে ভারত থেকে পণ্য বোঝাই ট্রাক বেনাপোল চেক পোস্ট দিয়ে বন্দরে প্রবেশ করলে অনেক সময় এন্ট্রিই করা হয় না। বেনাপোল স্থল বন্দরের উল্টোদিকে সীমান্তের ওপারে ভারতের পেট্রোপোল বন্দর। সেখান থেকে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে- এমনকি কখনো কখনো ঘোষণা না দিয়েই পণ্য চালান বেনাপোল ঢুকে পড়ছে।

পয়লা পয়লা ব্যাপারটা রীতিমতো অবিশ্বাস্য ঠেকেঠিল মনজুর মোরশেদের কাছে। পরে বুঝতে পারলেন, এটা শক্তিশালী সিন্ডিকেটের কারসাজি। নিরাশ হলেন না তিনি। অনুসন্ধান চালিয়ে যান। একদিন দেখতে পেলেন, স্টিল জাতীয় পণ্য ১৫০ বান্ডিল ঘোষণা দিয়ে ৩০০ বান্ডিল আনা হচ্ছে। শাড়ি, থ্রিপিস ১৯০ প্যাকেজ ঘোষণা দিয়ে ৩৮০ প্যাকেজ আনা হচ্ছে। অবাক করা কান্ড হলো, একটি চালানের পণ্য সঠিক রেখে একই ডকুমেন্টস দেখিয়ে ঘোষণাভিত্তিক পণ্য চালানগুলো বারবার বন্দর থেকে গেট পাস ছাড়াই বের করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। দেখা গেল, দুই ট্রাকের পণ্যের রাজস্ব পরিশোধ করে বন্দর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে চার ট্রাক মাল। গেটপাসের ক্ষেত্রেও অনিয়ম আর অপকৌশল। এভাবে সরকারের কোটি কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দেখে মনজুর মোরশেদের মাথা প্রায় খারাপ হবার অবস্থা। কাস্টমসের একজন সহকারী কমিশনার হিসেবে ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে ওঠেন। একদিন কাজের অবসরে নিজের বিবেকের কাছেই প্রশ্ন করেন- সরকার আমাদের বেনাপোলে পাঠিয়েছে কেন?

জবাব পেলেন- কর্তব্য পালনের জন্য

  • এই কর্তব্য পালনের বিনিময়ে আমরা কী পাচ্ছি?
  • বেতন-ভাতাসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা, উপরন্তু পুরস্কার।
  • তাহলে বেনাপোল বন্দরে এই যে কোটি কোটি টাকার শুল্ক ফাঁকি চলছে, এটা জেনে চুপচাপ কিংবা নিষ্ক্রিয় থাকাটা ঠিক হবে?
  • মোটেই না। বরং নিশ্চুপ আর নিষ্ক্রিয় থাকাটা শুধু অন্যায়ই হবে না, অপরাধের সামিল হবে।

সহকারী কমিশনার মনজুর মোরশেদ সিদ্ধান্ত নেন, কোটি কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি বন্ধের ব্যবস্থা নিতে হবে। তিনি জানেন, বেনাপোল কাস্টম হাউজে বৈধ আমদানির ছদ্মাবরণে অবৈধ পণ্য আমদানির নেপথ্যে আছে সংঘবদ্ধ চক্র। তারা টিভি-সিনেমায় দেখে চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত অপরাধীদের চেয়ে কম নিষ্ঠুর নয়। স্বার্থে ঘা লাগলে ওরা মানুষ খুন করতে পারে। কাজেই সাবধানে পা ফেলতে হবে। চোরাচালান সিন্ডিকেটের একশেণির সিএন্ডএফ এজেন্ট জড়িত। এরা চোরাচালানি এবং অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঝে সেতুবন্ধনের কাজ করে। তাদের স্বার্থে এহেন কাজ নেই যা করতে পারেনা। ওরা মাস্তানও পোষে। তাই বলে মনজুর মোরশেদ পিছপা হবেন না। দেশের স্বার্থে ও রাজস্ব বৃদ্ধির লক্ষ্যে একজন নিষ্ঠাবান  কর্মকর্তার ভূমিকা রাখতে চান। কিছু বিশ্বস্ত কর্মকর্তার ভূমিকা রাখতে চান। তাই কিছু বিশ্বস্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বেছে নেন তিনি। সোর্সও নিয়োগ করলেন। কৌশলে কয়েকটি চালান আটক করেন। গাজীপুরের এক প্যাকেজ ইন্ডাস্ট্রিজ ৩০০ জিএসএম ঘোষণা দিয়ে ভারত থেকে ২২০ মেট্রিক টন ২২৪ জিএসএম ডুপ্লেক্স বোর্ড আমদানি করে। কাস্টমস হাউজে বিল অব এন্ট্রি দাখিলও করে। কিন্তু আমদানিকৃত ডুপ্লেক্স বোর্ড দেখে সহকারী কমিশনার মনজুর মোরশেদের সন্দেহ হয়। তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিশ্চিত হন আমদানি করা ডুপ্লেক্স বোর্ড ৩০০ জিএসএম নয়, ২২৪ জিএসএম। বাংলাদেশ ৩০০ জিএসএমের নিচে ডুপ্লেক্স বোর্ড আমদানি করা নিষিদ্ধ। কাজেই তিনি মিথ্যা ঘোষণার দায়ে ওই পণ্য আটক করার ব্যবস্থা করলেন। এই মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে প্রায় ৩৭ লাখ টাকা শুল্ক ফাঁকি দেওয়া হয়েছিল।

একবার শুরু করার পর মনজুর মোরশেদ আর পিছনে তাকাননি। যা হবার হবে, তিনি শুধু তার দায়িত্ব পালন করবেন। তখন বেনাপোল দিয়ে টিস্যু পেপার আমদানির নামে সিগারেট পেপার আমদানি চলতো। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে মনজুর মোরশেদ প্রায় ৪০ মেট্রিক টন টিস্যু পেপারের নামে আমদানি করা সিগারেট পেপার আটক করেন। ওই পেপার খালাসের চেষ্টাকালে আটক করা হয়। একই কায়দায় ঢাকার একটি প্রতিষ্ঠান দুটি চালানের মাধ্যমে ১৪০ মেট্রিক টন সিগারেটর পেপার আমদানি করেছিল। ওই দুটি চালানও আটক করা হয়। বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে অবৈধভাবে আমদানি করা সিগারেট পেপার আটকের ঘটনা স্মরণ করতে গিয়ে কত কিছুই মনে পড়ছে মনজুর মোরশেদের। আটক ছাড়াও কাস্টমস কর্তৃপক্ষের অগোচরে পণ্য খালাস করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে- এমন নয়টি চালান সনাক্ত করেছিলেন। ভারতের পেট্রোপোল কাস্টম হাউজে চালান এন্ট্রি হলেও বেনাপোল তো হয়নি। এমন কি বেনাপোল কাস্টমসের কাছে কোনো কাগজপত্রও জরা পড়েনি। মাল বেনাপোলে আসা মাত্রই তা সরাসরি পাচার করে দেওয়া হয়।

মনজুর মোরশেদ বুঝতে পারেন, সংঘবদ্ধ চক্র কতটা শক্তিশালী হলে এ ধরণের প্রায় অভিশ্বাস্য ঘটনা ঘটাতে পারি। প্রতিটি চালানের টিস্যু পেপারের ঘোষণা ছিল। মনজুর মোরশেদ হিসাব করে দেখেছিলেন, টিস্যু পেপার হলে সরকার বঞ্চিত হবে প্রায় ৫২ লাখ টাকা রাজস্ব আয় থেকে । আর সিগেরেট পেপার হলে বঞ্চিত রাজস্ব আয়ের পরিমাণ দাড়াঁবে প্রায় এক কোটি ৬৫ লাখ টাকা। টিস্যু পেপারের চেয়ে সিগারেট পেপারের ট্যারিক ভ্যালু অনেক বেশি।

বেনাপোল স্থলবন্দর ব্যবহারকারী সংঘবদ্ধ চোরাচালান চক্র যতই শক্তিশালী হোক না কেন, একজন সহকারী কমিশনার হওয়া সত্ত্বেও মনজুর মোরশেদ তাতে বিচলিত ছিলেন না। চোরাচালানিদের বিরুদ্ধে দায়িত্ব যথারীতি পালন করে যান। ঢাকার পশ্চিম কাফরুল এলাকার এক গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠান ভুয়া এলসির মাধ্যমে ভারত থেকে ৪৫ হাজার ৫৭ গজ ভিসকস পলিয়েস্টার এবং ফিলামেন্ট কাপড় নিয়ে আসে। আমদানিকারক হিসেবে তাদের কোনো পাসবই ছিল না। এ ধরেণের প্রতারনার খবর জানতে পেরে মনজুর মোরশেদ দেরি করেননি। ওই চালন আটক করেন। ঢাকার আরেকটি প্রতিষ্ঠান মিক্সার গ্রিন্ডার আমদানির  সময় এইচএস কোডের মিথ্যা ঘোষণা দেয়। গোপন সূত্রে সংবাদ পেয়ে মনজুর মোরশেদ পণ্য খালাস নেওয়ার প্রাক্কালে তা আটক করেন এবং অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় করেন। তবে এ ধরনের তৎপরতার ফলে চোরাচালানিদের টনক নড়ে। মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে বৈধ আমাদানির ছদ্মাবরণ অবৈধ আমাদানি বন্ধের উদ্যোগ এবং স্থলবন্দর থেকে শুল্কায়নের আগেই পাচার হয়ে যাওয়া নয়টি চালানের বিষয়ে তদন্ত শুরু করলে তারা আর নিশ্চুপ থাকতে পারেনি। টেলিফোনে মনজুর মোরশেদের কাছে আসতে  থাকে হুমকির পর হুমকি। একদিন তো একজন বলেই ফেললো- এটা বেনাপোল। এখানে আইন-টাইন আর সততা দেখাতে আসবেন না। তাহলে টিকতে পারবেন না। জান নিয়ে টানাটানি পড়বে।

এমন হুমকিতে ভীত ছিলেন না মনজুর মোরশেদ । আরেকদিন তো জবাব দিয়েই বসলেন- এসব ভয়-টয় দেখিয়ে কোনো লাভ হবে না্। আমার যা কাজ সেটা করবো।

-দেখেন, সেরের উপর সোয়া সের থাকে । উপর মহলে আমাদের লোক আছে। তারপর আমাদের হতে সাংবাদিকও আছে, এমন রিপোর্ট করবো যে আপনার চাকরি রক্ষা করাই কঠিন হবে।

-যখন হয় তখন দেখা যাবে।

হুমকিতে টলানো যাচ্ছে না দেখে চোরাচালানি চক্র প্রলোভনও দেখায়। তাদের হয়ে একজন বলে-ভাই, এসব ঝামেলা করে কী লাভ। তার চেয়ে আসেন, মিলেমিশে কাজ করি। যাতে আপনারও উপকার হয়।

মনজুর মোরশেদের স্পষ্ট জবাব- আমার পক্ষে এমন কিছু করা সম্ভব নয়, যাতে দেশের ক্ষতি হয়।

- আরে ভাই, এত দেশ দেশ করলে নিজের জন্য করবেন কী? আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি, এই বেনাপোল থেকে যা কামিয়ে নেওয়ার সুযোগ পাবেন সারা জিন্দেগিতে আপনাকে আর টাকার জন্য ভাবতে হবে না।

- সরি ভাই, অত টাকার দরকার আমার নেই। সরকার আমাকে যথেষ্ট পরিমাণে বেতন দিচ্ছে।

চোরাচালানে জড়িত সংঘচক্র হুমকি দিয়ে আর প্রলোভন দেখিয়ে মনজুর মোরশেদকে বাগে নিতে না পেরে ভিন্ন পথ ধরে । তাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিল। এক রাতে যখন বোনাপোলের সরকারি বাসায় বসে সপরিবারে টেলিভিশন দেখছিলেন তিনি তখনই দরজার বাইরে কলিংবেলের সুইচ টিপে দুর্বৃত্তরা।

সকালের দিকে কয়েকটা পয়েন্ট ছাড়া ঢাকার রাস্তায় জ্যাম ততটা জমাট বাধে না। যাথাসময়ে মনজুর মোরশেদ অফিসে পৌঁছেন এবং দাপ্তরিক  কাজে ব্যাস্ত হয়ে পড়েন। লাঞ্চ আওয়ারের বিরতির সুযোগ নিয়ে সতের-আঠার বছর আগে ফেলে আসা বেনাপোল আবার তার মানে আবার উঁকি দেয়। হ্যাঁ, সেই রাতটা তার চাকরি জীবনে একটি স্মরণীয় ঘটনা হয়েই থাকবে। ভাগ্যিস, বুলেট ড্যাম থাকায় দুর্বৃত্তদের পিস্তলটা অকেজো হয়ে পড়ে। নইলে অন্যরকম কিছু ঘটতে পারতো। এমনকি তার প্রাণ বিপন্ন হয়ে ওঠাও অস্বাভবিক কিছু ছিল না।

রাত তখন নয়টা হবে । ড্রয়ই রুমে বসে মনজুর মোরশেদ স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে টিভি দেখছিলেন। কলিংবেল বেজে উঠলে বাড়িতে নিয়োজিত কর্মচারী রহমান খুলতে যায়। রহমান শুধু বলিষ্ঠই নয়, একাধারে বিশ্বস্ত, সাহসী ও চালাক-চতুর ছিল। দরজা খুলে দেখে কয়েক যুবক। তবে ওদের চিনতে তার ভুল হয়নি। ওরা ঘরে ঢুকতে চাইলে রহমান চিৎকার করে বাধা দেয়। ওরা তখন পিস্তলের গুলি বেরোয়নি। বরং ধস্তাধস্তিতে পিস্তলটা ছিটকে পড়ে। ততক্ষণে রহামানের এবং দুর্বৃত্তদের উপস্থিতি টের পেয়ে মজনুর মোরশেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের চিৎকার শুণে কোয়ার্টার্সের লোকজন ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে তাকে। দুর্বৃত্তরা বেগতিক অবস্থা আঁচ করে আর দেরি করেনি, রাতের অন্ধকারের ভেতর পালিয়ে যায়।

বেনাপোল কাস্টসম হাউসের একজন সহকারী কমিশনারের প্রাণনাশের ঘটনা তখনকার জাতীয় এবং আঞ্চলিক পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই তা বিভিন্ন মহলের দৃষ্টিতে পড়ে। তবে ওই ঘটনার মনজুর মোরশেদ মনোবল হারায়নি। যদিও অনেকের কাছ থেকে সাবধানে থাকার পরামর্শ তাকে শুনতে হয়েছিল । তিনি বেনাপোল থেকে বিদায় নেওয়ার আগ পর্যন্ত তার কাজ চালিয়ে যেতে পেরেছিলেন বলেই বেনাপোল কাস্টম হাউজে বৈধ আমাদানির ছদ্মবরণে অবৈধ পণ্য আমাদানি প্রায় শূণ্যের কোঠায় নেমে আসে। চেকপোস্টে শৃঙ্খলা ফিরে আসাসহ অনেক অনিয়ম বন্ধও হয়। নিজ উদ্যোগে ঝুঁকিবহুল দায়িত্বপালন করেছিলেন বলেই সোখানে যোগদানের পর প্রথম ছয়মাসে তিন কেটি ১৪ লাখ ৭৫ হাজার ৯৫৪ টাকার রাজস্ব ফাঁকি উদঘাটন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তথ্যের জন্য তিনি গড়ে তুলেছিলেন এক গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই ঢাকা শুল্ক ভবন এবং শুল্ক, আবগরি ও ভ্যাট (উত্তর) ঢাকা চাঞ্চল্যকর শুল্ক এবং ভ্যাট ফাঁকির জালিয়াতি উদঘাটন করেছিল। তার চেয়ে বড় কথা হলো, বেনাপোলে তার অধীনস্থ কর্মকর্তা-কর্মচারীরদের উদ্বুদ্ধ করে ব্যাপক সংস্কার কার্যক্রম গ্রহণ করতে পেরেছিলেন।

বদলির চাকরি। মনজুর মোরশেদকে এক পর্যায়ে বেনাপোল কাস্টম হাউস থেকে বদলি হয়ে চলে আসতে হয়। তবে বিদায়ের আগে দেশের বৃহত্তম স্থলবন্দরে শুল্ক ফাঁকি উদঘাটনের পাশাপাশি কী করে তা রোধ করা যায়- সেই পথ খুঁজে বের করতে তিনি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে পেট্রাপোলস্থ ভারতীয় শুল্ক কর্মকর্তার সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা করেন। তাদের সহযোগহিতা নিয়ে শুল্ক ফাঁকি বন্ধের পদ্ধতি সংক্রান্ত সুপারিশমালা স্থল শুল্ক স্টেশনে বাস্তবায়িত হলে সরকারের হাজার হাজার কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি রোধ করা সম্ভব- সেই চিত্র তিনি সবিস্তারে তুলে ধরেছিলেন।

বেনাপোল স্থল বন্দরে তার পদক্ষেপ এবং সুপারিশ কতটা বাস্তবায়িত হয়েছে মনজুর মোরশেদের তা জানা নেই। তবে ওখানকার কর্মব্যস্ত কাস্টম হাউস, চেক পোস্ট আর বিশাল ইয়ার্ডের পাশাপাশি কাস্টমস কোয়ার্টার্সের সেই নিরিবিলি পরিবেশ তার মন থেকে কখনও বিস্মৃত হবে না।

মো. মতিউর রহমান, কমিশনার, বৃহৎ করদাতা ইউনিট (মূল্য সংযোজন কর)

/ এম / এআর