ঢাকা, শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

প্রীতিলতা ও নারী রাজনীতি

প্রকাশিত : ০৪:৪৬ পিএম, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ১২:৪৫ পিএম, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ শুক্রবার

প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ছিলেন ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে একজন সক্রিয় অংশগ্রহণকারী। দেশকে বাঁচাতে তিনি বিস্ফোরক সরবরাহ করেছিলেন। নিয়েছিলেন জীবনের ঝুঁকি। সাম্রাজ্যবাদের প্রভাব এবং ঔপনিবেশবিরোধী আন্দোলনে তার অবদান অনস্বীকার্য। দেশকে মুক্ত করতে একজন দেশপ্রেমিক হিসেবে যা করণীয় তিনি তাই করেছিলেন। দ্য গার্ডিয়ানে নোভারা মিডিয়ার জ্যেষ্ঠ সম্পাদক অ্যাশ সরকার একটি নিবন্ধ লিখেছেন। তার লেখা ভাষান্তর করে একুশে টেলিভিশন অনলাইনের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-

কিছু ব্রিটিশ নারীকে ভোটাধিকার দেওয়ার শতবর্ষপূর্তি হয়েছে গত মঙ্গলবার। এখন সময় এসেছে নারীর ভোটাধিকারের ওপর সাম্রাজ্যবাদের প্রভাব এবং ঔপনিবেশবিরোধী আন্দোলনগুলোতে নারীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা বিবেচনায় নেওয়ার।

এখানেই চলে আসে প্রীতিলতার বিষয়টি। ১৯৩০-এর দশকের শুরুর দিকে বাংলা ছিল ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবী আন্দোলনের জ্বলন্ত কড়াই। আর নারীরা ছিলেন এ পুনরুত্থান আন্দোলনের আত্মার স্থানে। এ অঞ্চলের তৎকালীন এক জেলা ম্যাজিস্ট্রেট চার্লস স্টিভেনস দুই নারী শান্তি ঘোষ ও সুনীতি চৌধুরীর হাতে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। কমলা দাশগুপ্ত ব্রিটিশ দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে বোমা হামলা চালানোর জন্য যুগান্তর দলকে সহায়তা করেছিলেন। আর প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার স্কুল শিক্ষকের চাকরি ছেড়ে দিয়ে হাতে তুলে নেন অস্ত্র।

যুক্তরাজ্যে ১৯১৪ সালে মাত্র দুই হাজার নারী সরকারি ডকইয়ার্ড, কারখানা ও অস্ত্রাগারে কাজ কররেও যুদ্ধবিরতির সময় এ সংখ্যা বেড়ে আড়াই লাখে চলে গিয়েছিল। ১৯১৮ সালের গণপ্রতিনিধিত্ব আইনে ৩০ বছরের বেশি বয়সী সম্পত্তির মালিক নারীদের ভোটাধিকার অনুমোদন করা হয়েছিল।

ওই সময় স্বদেশি ভাবনাকে আঁকড়ে ধরে প্রতিবাদী বিবেকবানদের আন্দোলনকে প্রত্যাখ্যান এবং নারীর সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের ভাবমূর্তি বদলে গিয়েছেল। আর এ কাজটি করেছিল, ব্রিটেনে নারীর ভোটাধিকার নিয়ে প্রচারণা চালানো প্রধান সংস্থা দ্য পাংখুরস্ট। একসময় বিপথগামী রাজনৈতিক স্বার্থের নারী ভোটাধিকারীরা ও ব্রিটিশরাজ সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধবিগ্রহের অভিন্ন কারণ খুঁজে পেয়েছিল।

সাম্রাজ্যবাদবিরোধী উল্লেখযোগ্য নারী ভোটাধিকারী অ্যানি বেসান্ট, ক্যাথেরিন ইমপে এবং এমেলাইন পাংখুরেস্টের মেয়ে সিলভিয়ার সময় নারীবাদের প্রথম ঢেউ উঠে। সেই সময় ঔপনিবেশবাদে ব্রিটিশ নারীদের সমঅংশ গ্রহণ নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়। কারণ তারা ছিল ভোটাধিকার বর্ধিতকরণের পক্ষে। সেই সময় এমেলাইন পাংখুরস্ট আওয়াজ তুলেছিল, ‘ব্রিটিশ সাম্রাজ্য আয়তন ও সম্ভাব্য সম্পদে বিশাল’।

ফ্লোরা অ্যানি স্টিলের মতো ব্যক্তিত্বরা উপনিবেশ দেশগুলোতে স্বদেশিদের ওপর শ্বেতাঙ্গ নারীদের শাসন পরিচালনার সক্ষমতা দেখে মূল ব্রিটেনে নারীদের রাজনৈতিক অংশীদারিত্বের আরও বেশি দাবির যৌক্তিকতা খুঁজে পান। ভারতের গৃহস্থালি ও রান্নাবান্না বিষয়ে ১৮৮৮ সালে স্টিল লিখেছিলেন, উপনিবেশ দেশগুলোর গৃহস্থালি কাজের লোকদের ওপর নারীর কর্তৃত্ব ছিল একটি ক্ষুদ্র সাম্রাজ্যের মতো। ইংরেজ মিসেসদের প্রথম দায়িত্ব ছিল আদেশ দেওয়া। আর দ্বিতীয়টি ছিল তার আদেশ বাস্তবায়নের ওপর জোর দেওয়া।

১৯১৮ সালের দিকে ব্রিটিশের যুদ্ধ চেষ্টায় ঔপনিবেশিক বিষয়াবলিতে অবদান এবং ভারতীয় ও আফ্রিকানদের নারীর ভোটাধিকারবিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে উপস্থিতি সত্ত্বেও নারীর ভোটাধিকার সীমিত রাখা হয়েছিল। শুধু মূল ব্রিটেনে বসবাসকারী নারী এবং উপনিবেশ দেশগুলোতে বসতি স্থাপনকারী শ্বেতাঙ্গ নারীদের মধ্যে।  ইউরোপের নারীরা ১৯১৯ সালের শুরুতেই কেনিয়ায় ভোট দিতে পারলেও আফ্রিকার নারী-পুরুষদের একই অধিকারের জন্য ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল। আর ভারতজুড়ে নারীরা সীমিত আকারে প্রাদেশিক পরিষদে ভোট দেওয়ার অধিকার পেয়েছিল ১৯২০ সালের মাঝামাঝি থেকে।

এশিয়া, আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী নারীদের জন্য ঔপনিবেশবিরোধী আন্দোলন ছিল রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অংশগ্রহণের প্রাথমিক স্তর। প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে অন্তর্ভুক্তির দাবি তখনও ছিল না। ছিল শুধু সাম্রাজ্যবাদ পুরোপুরি উৎখাতের দাবি।

১৯২৫ সালে প্রথম নারী হিসেবে সরোজিনি নাইডু ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। ভারতের নারীদের রাজনৈতিক আত্মপ্রকাশের ক্ষেত্রে গান্ধীবাদী গণআন্দোলনই একমাত্র পথ ছিল না। যেখানে ভারত ছাড় আন্দোলনের পরিচিতির কৌশল ছিল সত্যগ্রহ, সেখানে সশস্ত্র সংগ্রাম খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে ব্রিটিশরাজকে পরাজিত করার পেছনে।

সূর্যসেন, প্রীতিলতা এবং আরও ৬০ জন মিলে ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল চট্টগ্রামের দুটি অস্ত্রাগার দখল করে নেন। তারা ইউরোপিয়ান ক্লাব থেকে কয়েকজনকে জিম্মি করার এবং কলকাতার সঙ্গে রেললাইন ও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার উদ্যোগ নেন। ব্রিটিশরাজের মূল অস্ত্রসম্ভারের সন্ধান পেতে ব্যর্থ হলেও বিপ্লবীরা টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ লাইন কেটে দিতে এবং রেল নেটওয়ার্ক ওলটপালট করে দেন। প্রীতিলতা রিজার্ভ পুলিশ লাইন নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার সফল এক অভিযানে অংশ নেন।

পরের দুই বছরজুড়ে প্রীতিলতা বিস্ফোরক সরবরাহ করেন। এ ছাড়াও জাতীয়তাবাদী লিফলেট লিখেন এবং সূর্যসেন ও ফাঁসির দিন গুণতে থাকা তার কারাবন্দি সহযোগী রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের মধ্যে অবৈধ যোগাযোগ স্থাপনের সুযোগ করে দেন। মাত্র ২১ বছর বয়সে প্রীতিলতা নিজেকে বাংলার মোস্টওয়ান্টেড তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেন। ১৯৩২ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি নিজের সর্বশেষ রেইডে অংশ নেন। চট্টগ্রামের পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাবে একজন পাঞ্জাবি পুরুষের ছদ্মবেশে যোদ্ধাদের নিয়ে হামলায় নেতৃত্ব দেন তিনি। প্রীতিলতা ও তার সঙ্গীরা ক্লাবটি জ্বালিয়ে দেন। এক ব্রিটিশ নারীকে হত্যা এবং আরও ১১ জনকে জখম করেন তারা।

হামলার সময় প্রীতিলতা একটি বুলেটের আঘাতে আহত হয়ে পুলিশের হাতে আটক হন। জেলে বন্দি হয়ে থাকার চেয়ে পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন তিনি। এর দুই বছর পরই ব্রিটিশদের হাতে নির্যাতন ও ফাঁসির শিকার হন সূর্যসেন। স্বাধীনতার লড়াইয়ে প্রীতিলতা ও অন্য নারী অংশগ্রহণকারীরা ঔপনিবেশবিরোধী আন্দোলনকে পুনরুত্থিত করেছেন। নিজের প্রকাশিত সর্বশেষ শব্দগুচ্ছে প্রীতিলতা লিখেছেন, ‘আমি আন্তরিকভাবে আশা করি, আমার বোনেরা নিজেদের আর দুর্বল হিসেবে ভাববে না। এবং নিজেদের তৈরি রাখবে সব ধরনের বিপদ ও কঠিন পরিস্থিতির মোকাবেলায় এবং হাজার হাজার বিপ্লবী আন্দোলনে যোগ দেবে।’

ব্রিটেনে ভোটাধিকারপ্রাপ্ত নারীরা তাদের রাজনৈতিক অংশীদারিত্বের জন্য বিতর্ক করেছেন নিজেদের পুরুষ প্রতিপক্ষকে যুদ্ধবিগ্রহে যাওয়ার ক্ষেত্রে সমর্থনদানের মধ্য দিয়ে। অন্যদিকে উপনিবেশ দেশগুলোতে নারীরা নিজেরাই সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন।

ব্রিটিশ নারীদের ইতিহাস কখনও ব্রিটেনের মূল ভূখণ্ড ধারণ করেনি। ভোটাধিকারপ্রাপ্তির বিষয়ের প্রতিযোগিতা দেখা যায়, অধিকার রাষ্ট্র পাইয়ে দেয় না, এর কাছ থেকে জোর করে আদায় করে নিতে হয়। আহেদ তামিমি থেকে ইরিসা গারনার পর্যন্ত এখনকার নারীরাও স্মরণ করিয়ে দেন, রাজনৈতিক অধিকার ভোটের বাক্সে প্রবেশের থেকে আরও বহুদূর বিস্তৃত। আমাদের অধিকার কেবল সামান্য প্রতিনিধিত্বের জন্য নয়, পরিপূর্ণ মুক্তি ছাড়া আর কিছুতেই এটি নিহিত নয়। প্রীতিলতার কর্মকাণ্ড ভোটাধিকার অর্জনের নেপথ্যে বৈচিত্র্য প্রকাশ করে।

 

একে//এসএইচ