ঢাকা, শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

আর কতদিন এই ভাঙ্গা রেকর্ড

মুহম্মদ জাফর ইকবাল

প্রকাশিত : ১২:০২ এএম, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ শুক্রবার | আপডেট: ০২:০৪ পিএম, ১ মার্চ ২০১৮ বৃহস্পতিবার

আজকে আমার একজন সহকর্মী তার স্মার্টফোনে আমাকে একটা ভিডিও দেখিয়েছে। আমি আমার জীবনে এর চাইতে হৃদয় বিদারক কোনো ভিডিও দেখেছি বলে মনে করতে পারি না। ভিডিওটি একজন এস.এস.সি পরীক্ষার্থীর, ছেলেটি অত্যান্ত ক্ষুব্দ হয়ে বলছে সে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন দিয়ে পরীক্ষা দিয়েছে, প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্নের উত্তরও সে পেয়ে গেছে। কিন্তু সেই উত্তরে বেশ কয়েকটি ভুল ছিল। ক্ষুব্দ ছাত্রটি বলছে, কেন ভুল উত্তর সরবরাহ করে তাদের এভাবে উত্যক্ত করা হয়।

যে কোনো হিসেবে এটাকে খুবই মজার একটা কৌতুক হিসেবে বিবেচনা করার কথা ছিল কিন্তু আমি এই ভিডিওটি দেখে বিন্দুমাত্র কৌতুক অনুভব করিনি। আমি এক ধরনের আতংক অনুভব করেছি। আমাদের দেশে আমরা নতুন একটি তরুণ প্রজন্ম তৈরি করছি যারা সাংবাদিকদের বলতে সংকোচ বোধ করে না যে তারা ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়েছে। সেই প্রশ্নের উত্তর সরবরাহকারীদের ওপর তারা ক্ষুব্দ হয়, যদি তারা উত্তরে ভুল করে। আমাদের এই নতুন প্রজন্ম ন্যায় এবং অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য করতে পারে না।

এরকমটি আগে ছিল না, এরকমটি হয়ে যাওয়ার জন্য আমরা দায়ী। আমরা হাতে ধরে এরকম একটি প্রজন্ম তৈরি করেছি। যদি এই দেশে প্রশ্নফাঁস না হতো তাহলে আমাদের দেশের তরুণ প্রজন্ম এরকম হয়ে যেত না।

কাজেই আমি খুবই অসহায় বোধ করি যখন দেখি এই দেশের গুরুত্বপূর্ণ মানুষেরা বিষয়টিকে খাটো করে দেখানোর চেষ্টা করছেন। তারা বলেন, প্রম্নফাঁস নতুন কিছু নয়, আগেও প্রশ্নফাঁস হতো। প্রশ্নফাঁস নিয়ে কথা বলা হচ্ছে সরকারের একটি দোষ খুঁজে বের করার চেষ্টা মাত্র। আমি এটাকে মোটেও ছোট একটা বিষয় হিসেবে দেখতে পারি না। আমার কাছে এটাকে রিক্টার স্কেলে মাত্রার ভূমিকম্পের মতো মনে হয়, মহামারী প্লেসার মতো মনে হয়। প্রশ্নফাঁস হওয়ার কারণে আমাদের পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাটাকে অর্থহীন করে দেওয়া হয়েছে। একটি ছেলে বা মেয়ের জিপিএ ফাইভ কথাটির অর্থ কী আমরা জানি না। আসলেই সে ভালো একজন ছাত্র বা ছাত্রী হতে পারে কিংবা সে ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্ন দিয়ে পরীক্ষা দেওয়া একজন অসৎ অভিভাবকের অসৎ সন্তান, অসৎ শিক্ষকের অসৎ ছাত্র হতে পারে। তুলনামুলকভাবে খারাপ গ্রেডের একজন ছাত্র বা ছাত্রী হয়তো আসলে একজন সোনার টুকরো ছেলে বা মেয়ে। তার চার পাশে ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্ন দেখেও সে প্রলোভনে পা দেয়নি, সৎ থেকেছে, বাবা মায়ের বকুনী খেয়েছে বন্ধুদের হাসির পাত্র হয়েছে। কে এই প্রশ্নের জবাব দেবে?

শুধু কী তাই? পরীক্ষার নম্বর দিয়ে ছেলে-মেয়েদের কলেজ ঠিক করে দেওযা হয়। ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্ন দেখে পরীক্ষা দেওয়া ছেলে মেয়েরা ভালো ভা্লো কলেজের সিটগুলো দখল করে নেবে। আমাদের সোনার টুকরো ছেলে মেয়েরা হতাশ হযে দীর্ঘশ্বাস ফেলবে। দেশের গুরুত্বপূর্ণ মানুষেরা তাদের দীর্ঘশ্বাস শুনতে পাবে না, আমি শুনতে পাই। আগে প্রশ্নফাঁস হতো কি না আমরা জানি না, যদি হতো অবশ্যই সেটি খুব একটা খারাপ একটি ব্যাপার হতো। কিন্তু আগে প্রশ্নফাঁস হতো বলে এখন প্রশ্নফাঁস হওয়াটি মেনে নিতে হবে এটা নিশ্চয়ই একটা যুক্তি হতে পারে না। আগে এদেশে রাজাকারেরা গাড়িতে পতাকা উড়িয়ে ঘুরে বেড়াতো বলে এখনও তারা তারা গাড়িতে পতাকা উড়িয়ে ঘুরবে সেই কথাটি তো আমরা এখনও বলি না। খুটি নাটি না জেনেও শুধু কমন সেসব দিয়ে অনেক কিছু বোঝা যায়। আগে প্রশ্নফাঁস করতে হলে কাউকে না কাউকে পুরো প্রশ্নটির একটি কপি জোগার করতে হতো, এখন তার দরকার হয় না। একটি প্রশ্ন মাত্র এক ঝলক দেখার সুযোগ পেলে হয়, চোখের পলকে প্রায় অদৃশ্য একটা ক্যামেরা দিয়ে তার ছবি তুলে নিয়ে আসা যায়। আমি নিজের কৌতুহলে পরীক্ষার প্রশ্ন ছাপানো এবং বিতরণ করার পুরো প্রক্রিয়াটা খুটিয়ে খুটিয়ে দেখেছি। আমি জানি অনেক মানুষ এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত, তারা অকারণে এবং বিনা প্রয়োজনে এই প্রশ্নটিতে হাত বুলানোর সুযোগ পান। কাজেই প্রশ্নফাঁস হয়ে যাওয়ার বিষয়টি ধরা ছোয়ার বাইরের একটি বিষয় নয়। পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত মাত্র একজন অসৎ মানুষের প্রয়োজন সে এক ঝলক প্রশ্ন দেখার সুযোগ পেলে সম্ভবত কয়েক কোটি টাকার ব্যবসা করে ফেলতে পারে।

এখানে একটা কৌতুহলের বিষয় বলা যায়, আমি জানতে পেরেছি বেশ কিছুদিন আগে একটা সরকারি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল সেখানে বিজি প্রেসের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর সহায় সম্পত্তির খোঁজ খবর নেওয়া হচ্ছিল। (বিজি প্রেস হলো সেই প্রেস যেখানে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ইত্যাদি গোপন কাগজপত্র ছাপানো হয়।) এই প্রেসের কর্মকর্তা-কর্মচারীর সহায় সম্পত্তি বা ব্যাংক ব্যালেন্সের খোঁজ খবর নেওয়ার উদ্দেশ্য খুবই সহজ, কেউ হঠৎ করে বাড়াবাড়ি বড় লোক হয়ে যাচ্ছে কী না, হঠাৎ করে কারো আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যাচ্ছে কী না সেটি খুঁজে বের করা। যদি এরকম কিছু দেখা যায় তাহলে বুঝেতে হবে “ডাল মে কুছ কালা হায়”। তবে সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে এই অত্যন্ত সময়োপোযোগী প্রয়োজনীয় তদন্তটি হঠাৎ করে “ওপরের” আদেশে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কাজেই বিজি প্রেসের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী অসৎ উপায়ে বড়লোক হতে শুরু করেছে কীনা সেটা জানতে পেরেছি তার মাঝে কতোটুকু সত্যতা আছে জানা দরকার কারণ এটি যদি সত্যি হয় তাহলে আমাদের ভয় পাওয়ার অনেক কারণ আছে। “ওপরের” আদেশটি কতো ওপর থেকে এসছে আমি সেটাও জানতে খুবই আগ্রহী।

একটি সময় ছিল যখন কোনোভাবেই শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্বীকার করতে রাজী হয়নি যে পরীক্ষায় প্রশ্ন পত্র ফাঁস হয়েছে। আমি তখন অসহায় বোধ করেছি কারণ আমি জানি একটি সমস্যার সমাধান করতে হলে প্রথমে সমস্যাটি বুঝতে হবে। যদি সমস্যা আছে সেটি মেনেই নেওয়া না হয় তাহলে সমস্যার সমাধান করা হবে কেমন করে? শেষ পর্যন্ত সেই অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে, এখন সবাই জানে পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁস হয়। সেটি নিয়ে সংসদে আলোচনা হয় এবং সবচেয়ে বড় কথা হাইকোর্ট নিজে থেকে পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস বন্ধ করার ব্যাপারে সুপারিশ দেওয়ার জন্যে দুইটি কমিটি করে দেওয়া হয়েছে। সেই কমিটি দুটির একটির দায়িত্বে রয়েছেন অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ। ২০১৪ সালে প্রশ্ন ফাঁসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্য আমি যখন শহীদ মিনারে বৃষ্টির মাঝে বসেছিলাম তখন আমার সঙ্গে সারা বাংলাদেশের একজন মাত্র শিক্ষক ছিলেন, তিনি অধ্যাপক কায়কোবাদ। কাজেই আমি নিশ্চিতভাবে জানি প্রশ্নফাঁসের এই অভিশাপ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য সবচেয়ে আন্তরিক মানুষটিকেই বেছে নেওয়া হয়েছে। আমি অনুমান করতে পারি এই কমিটি নিশ্চয়ই কোনো কিছু ধামাচাপা দেবে না, সমস্যাটির গভীরে প্রবেশ করবে এবং নিশ্চিতভাবে একটি সমাধান খুঁজে বের করবে।

প্রশ্নফাঁসের ব্যাপারটি যখন আর লুকিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি তখন সেটি বন্ধ করার এক ধরণের আয়োজন শুরু হয়েছে। তবে আয়োজনটি “প্রশ্নফাঁস বন্ধ” করার জন্য নয় আয়োজনটি ফাঁস হয়ে যাওয়া “প্রশ্ন বিতরণ” বন্ধ করার জন্যে। আমরা যদি ধরে নিই প্রশ্নফাঁস আমরা বন্ধ করতে পারব না, সেটি হবেই হবে, অথবা আমরা শুধু এর বিতরণটি বন্ধ করব তাহলে বুঝতে হবে আমরা প্রশ্নফাঁস বন্ধের যুদ্ধে আগেই পরাজয় স্বীকার করে বসে আছি। আমি বিশ্বাস করতে রাজী নই যে প্রশ্নফাঁস বন্ধ করা সম্ভব নয়, অবশ্যই সম্ভব, শুধু সেটি আন্তরিকভাবে চাইতে হবে। যদি প্রশ্নফাঁস বন্ধ করা যায় তাহলে তার বিতরণ বন্ধ করার জন্যে আলাদা করে নতুন কোনো উদ্যোগ নিতে হবে না। যে প্রশ্নফাঁস হয়নি সেটি বিতরণ করবে কেমন করে?

যারা প্রশ্নফাঁসের বিষয়টি দীর্ঘদিন থেকে দেখে আসছে তারা মোটামুটিভাবে তার একটা প্যাটার্ন লক্ষ্য করে আসছে। মূল প্রশ্নটি অনেক আগেই ফাঁস হয়, সেটি ধাপে ধাপে বিতরণ করা হয়। যখন পরীক্ষা প্রায় শুরু হতে যাচ্ছে তখন বিনমূল্যে ছেড়ে দেওয়া হয়। একেবারে শেষ ধাপে যখন এটা খুচরা হিসেবে বিতরণ করা হয় তখন তাদের কাউকে কাউকে ধরা হয়েছে কিন্তু তারা নেহাতেই চুনোপুটি । শিক্ষা মন্ত্রণালয় ঘোষণা দিয়েছিল প্রশ্ন ফাঁসকারী কাউকে গ্রেফতার করতে পারলে পাঁচ লাখ টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে, এ পর্যন্ত অনেককেই ধরা হয়েছে (এর মাঝে এস.এস.সি পরীক্ষার্থীরাও আছে) তাদের কতোজনকে পাঁচ লাখ টাকা করে পুরস্কার দেওয়া হয়েছে কে জানে।

প্রশ্নফাঁসকারী চুনোপুটিকে গ্রেফতার করেছেন এরকম একজন পুলিশ অফিসারের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তিনি আমাকে নতুন একটি তথ্য দিয়েছেন। সেটি হচ্ছে প্রশ্নফাঁসের এই রমরমা ব্যবসার মূল চালিকা শক্তি হচ্ছে বিকাশ। বিকাশে টাকা পাঠানোর পুরো ব্যাপারটি যেহেতু পানির মতো সোজা তাই এটি অপরাধ চক্রের সবচেয়ে প্রিয় পদ্ধতি। আমি ধরেই নিয়েছিলাম এরকম একটি পদ্ধতিতে টাকা পাঠানো হলে কে পাঠাচ্ছে এবং কার কাছে পাঠাচ্ছে তার একটি হাদিস থাকবে। কিন্তু আমি সবিনয়ে এবং মহাআতংকে আবিষ্কার করেছি সেটি সত্যি নয়। কোনো রকম নিয়মনীতি না মেনে বিকাশে একটা একাউন্ট খুলে ফেলা সম্ভব এবং সেই একাউন্টে টাকা লেনদেন সম্ভব।

যে বড় পুলিশ অফিসারটির সঙ্গে আমার কথা হয়েছে তিনি বিশাল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছেন এই বিকাশ প্রযুক্তির কারণে কিডন্যাপিং অনেক বেড়ে গিয়েছে। শুধু তাই নয় তিনি আমার কাছে জানতে চেয়েছেন যে প্রযুক্তি অপরাধীদের টাকা লেনদেনে সাহায্য করে, আমাদের দেশ কী সেই প্রযুক্তির জন্যে প্রস্তুত হয়েছে?

আমি কখনো বিকাশ ব্যবহার করে টাকা পাঠাইনি তাই এই প্রক্রিয়াটি সম্পর্কে আমি কিছু জানি না, কিন্তু সহজ প্রশ্নটি তো করতেই পারি। যদি এই প্রক্রিয়ায় অপরাধীরা ধরা ছোয়ার বইরে থেকে টাকা লেনদেন করতে পারে তাহলে তার দায় দায়িত্ব কি বিকাশকে নিতে হবে না।

আবার প্রশ্নফাঁসের মূল ব্যাপারটায় ফিরে আসি। শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্বীকার করেছে একটি প্রশ্ন পুরোপুরি এবং অন্যগুলো আংশিক ফাঁস হয়েছে। যেগুলো ফাঁস হয়েছে সেগুলোর পরীক্ষা কী আবার নেওয়া হবে? শিক্ষা মন্ত্রণালয় কী বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবে যদি নতুন করে নেওয়া হয় তার প্রশ্ন আর ফাঁস হবে না? যদি হয় তখন কী হবে?

আমি আমার ভাঙ্গা রেকর্ড বাজাতে বাজাতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। আর কতোদিন?

লেখক : কথাসাহিত্যিক, শিক্ষক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।

এসএইচ/