ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৫ ১৪৩০

‘শিক্ষায় মূল্যবোধ ও নীতি-নৈতিকতাকে গুরুত্ব দিতে হবে’

প্রকাশিত : ০২:২৯ পিএম, ১ মার্চ ২০১৮ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ০৮:১৮ পিএম, ১ মার্চ ২০১৮ বৃহস্পতিবার

একসময় নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ পাওয়া যেতো। পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়-মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের ঘটনা ঘটে। এখন তো সেটি আরও ব্যাপকতা পেয়েছে। এইচএসসি-এসএসসির পর প্রাথমিক সমাপনীর প্রশ্নপত্র ফাঁসের মতো ঘটনাও ঘটছে। প্রযুক্তির কল্যাণে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগের রাতেই প্রশ্নপত্র ছড়িয়ে পড়ে। সেই প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়ে সার্টিফিকেট নিচ্ছে শিক্ষার্থীরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন দেশের গোটা শিক্ষাব্যবস্থাকে হুমকির মুখে এমনকি বিপর্যায়ে ফেলে দিচ্ছে এ প্রশ্নফাঁস।

গত একমাস জুড়ে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বড় জায়গাজুড়ে স্থান পেয়েছে এসএসসিতে প্রশ্নপত্র ফাঁসের খবর। এ নিয়ে তুমুল বির্তক চলছে দেশজুড়ে। একের পর এক প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে দেশের গোটা শিক্ষা ব্যবস্থা ও পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে নানা মহলে। এ থেকে উত্তরণে ওপেন বুক এক্সামের প্রস্তাব করেছেন শিক্ষাসচিব। কেউ কেউ বলছেন, সব পরীক্ষায় সৃজনশীল পদ্ধতির প্রয়োগ ঘটানো দরকার। এর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে অনেকেই বলছেন শিক্ষকদের তৈরি না করে শিক্ষাব্যবস্থায় সৃজনশীল পদ্ধতি সংযোজন করায় বিপাকে পড়েছে শিক্ষার্থীরা। যার কারণে বাধ্য হয়ে কোচিংয়ের ধারস্থ হতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। তাই সৃজনশীল পদ্ধতিকে আদর্শ শিক্ষাপদ্ধতি মানতে নারাজ বহু শিক্ষাবিদ।

এছাড়া শিক্ষাব্যবস্থা কর্মমুখী না হওয়ার কারণে একাডেমিক শিক্ষার সর্বোচ্চ সনদ নিয়েও বছরের পর বছর পার করে দিচ্ছে শিক্ষার্থী, চাকরি মিলছে না। স্নাতকোত্তর পাশের পর ৩ থেকে ৪ বছর আবার চাকরির জন্য আলাদাভাবে প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে। করতে হচ্ছে কোচিংও। তাহলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার গলদটা আসলে কোথায়? এর সুলোক সন্ধানে একুশে টেলিভিশন অনলাইন মুখোমুখি হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের। তার কথায় উঠে এসেছে প্রশ্নফাঁস, কোচিং বাণিজ্য, কোটা পদ্ধতির সংস্কার, শিক্ষায় নীতি নৈতিকতার অভাব, শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটি, শিক্ষার্থীদের চাকরির সমস্যাসহ সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার নানা দিক।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন একুশে টেলিভিশন অনলাইন প্রতিবেদক রিজাউল করিম। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের শেষ পর্ব পাঠকের উদ্দেশ্যে তুলে ধরা হলো-

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: জনসংখ্যার বোনাসকাল (ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড) অতিবাহিত করছে দেশ। অথচ সরকারি হিসেবে দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ২৫ লাখের বেশি। আমরা দেশের এই বিশাল কর্মক্ষম জনশক্তিকে কেন কাজে লাগাতে পারছি না? কেন সর্বোচ্চ পর্যায়ের ডিগ্রি নেওয়ার পরও চাকরি মিলছে না? মূল সমস্যা ও সমাধান কোথায়?

আরেফিন সিদ্দিক: বেকারত্বের সমস্যা উন্নত ও উন্নয়নশীল সব দেশেই আছে। আমাদের দেশে বড় একটা সমস্যা রয়ে গেছে যে, আমরা শিক্ষার ক্ষেত্রে খুব বেশি বড় পরিকল্পনা করিনি। এ কারণে কোন বিষয়ে বছরে কী পরিমাণ আমাদের স্নাতকোত্তর দরকার আছে তা আমরা বুঝতে পারি না। পরিকল্পনা না থাকায় প্রতি বছর এমন বিষয়ে ছাত্র-ছাত্রীরা বের হচ্ছে যে বিষয় হয়তো দরকারই নেই। আবার যেসব বিষয়ে আমাদের স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীর দরকার সে সব বিষয়ে হয়তো আমরা পাঠদানই করছি না। যেমন তথ্যপ্রযুক্তি খাতে আমাদের যে পরিমাণ শিক্ষার্থী দরকার তার তুলনায় খুব কম সংখ্যক গ্রাজুয়েটই আমরা তৈরি করতে পারছি। ফলে বেকারত্ব তো থেকেই যাচ্ছে।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: জনসম্পদকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে কি উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে ?

আরেফিন সিদ্দিক: বিজ্ঞান, কারিগরি এবং প্রযুক্তি শিক্ষায় আমাদের ছেলে-মেয়েদের শিক্ষিত করতে হবে। বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষার উপর যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া দরকার। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশে যখন প্রথম সমাবর্তন করেন সেটা ছিল প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন। সেখানে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন আমাদের এ স্বাধীন দেশে কেরানী শিক্ষা বন্ধ করে বৃত্তিমূলক কারিগরি শিক্ষার প্রসার ঘটনোর প্রয়োজন আছে। বঙ্গবন্ধু কুদরত এ খুদা শিক্ষা কমিশন গঠন করে শিক্ষাকে সেইভাবে পুনর্বিন্যস্ত করার চেষ্টাও নিয়েছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পরে তা আর আলোর মুখ দেখেনি। আজকে সময় এসেছে বঙ্গবন্ধুর সেই কারিগরি বৃত্তিমূলক শিক্ষার দিকে নজর দেওয়ার। এটা করতে পারলে আমাদের জনসম্পদকে কাজে লাগানো সহজ হবে।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: অনেকের অভিমত, শিক্ষা ব্যবস্থা হয়ে পড়েছে অনেকটাই সনদনির্ভর। দেশপ্রেম, নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধের প্রচুর ঘাটতি রয়েছে শিক্ষার্থীদের মাঝে। এগুলোর চর্চার অভাবে একজন মেধাবী শিক্ষার্থী দেশের সম্পদ হওয়ার পরিবর্তে অভিশাপে পরিণত হচ্ছে। এ পরিস্থিতি থেকে কীভাবে উত্তরণ ঘটানো যায়?

আরেফিন সিদ্দিক: বৃটিশ উপনিবেশ ও পাকিস্তান উপনিবেশ শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে আমরা আজ এ পর্যায়ে এসেছি। আমাদের এখানে সমাজভিত্তিক লেখা-পড়া করছি। এখন সময় এসেছে সমাজভিত্তিক লেখা-পড়ার চেয়ে মূল্যবোধভিত্তিক লেখা-পড়ার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া। উন্নত স্বাধীন দেশগুলোতে আমরা মূল্যবোধভিত্তিক লেখা-পড়া আমরা দেখে আসছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমরা মূল্যবোধভিত্তিক লেখা-পড়া চালু করতে পারিনি। শিক্ষানীতিতে মূল্যবোধভিত্তিক শিক্ষা, সংস্কৃতির শিক্ষা, চরিত্র গঠনের শিক্ষা ও নীতি-নৈতিকতার শিক্ষাকে গুরুত্ব দিতে হবে। পাশাপাশি আমাদের পাঠ পরিক্রমায় যে ছাত্র-ছাত্রীদের যে মূল্যায়নের পদ্ধতি আছে তাতে এ বিষয়গুলো রাখতে হবে। সারা পৃথিবীতে কিন্তু এটা আছে। আমাদের শিক্ষাপদ্ধতিতে নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধ যোগ হলে প্রশ্নফাঁসসহ অনৈতিক বিষয়গুলো দিন দিন দূর হয়ে যাবে।

বহির্বিশ্বে সহ-শিক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। আমাদের দেশেও এ ধরণের সহ-শিক্ষাকে গুরুত্ব দিতে হবে। ছাত্র-ছাত্রীর মানদণ্ডের বিচারেও এ ধরণের সহ-শিক্ষার বিষয় রাখতে হবে।

আজকে একজন শিক্ষিত মানুষ যখন দূর্নীতি করেন, মিথ্যা কথা বলেন, একজন শিক্ষিত যুবক যখন নারী নির্যাতনে সম্পৃক্ত হন, তখন আমরা বুঝতে পারি যে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় কতটা অসারতা আছে। কতটা অর্থহীন শিক্ষা দিচ্ছি আমরা।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কি? শিক্ষা পদ্ধতির আমূল পরিবর্তন দরকার আছে কি না?

আরেফিন সিদ্দিক : আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের যুগে শিক্ষা পদ্ধতি এক জায়গাতে থেমে থাকবে না এটাই স্বাভাবিক। কারণ শিক্ষা খাত হচ্ছে সবচেয়ে গতিশীল খাত। কাজেই বর্তমান সময়ে দেশের পরীক্ষা পদ্ধতি, পরীক্ষা মূল্যায়ন পদ্ধতি ও শিক্ষা প্রদান পদ্ধতিগুলোতে পরিবর্তন আসবে এবং এটা সময়ের দাবি। আজকের যে পাঠ্যক্রম আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদান করি। আমি মনে করি আগামীতে তা পরিবর্তন করা দরকার। নতুন কোন পাঠ্যক্রম গ্রহণ করা দরকার। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে পাঠ্যক্রম আছে সেগুলো প্রতিবছরই পরিবর্তনের সুযোগ রয়েছে। হয়তো প্রতিবছর সেটা পরিবর্তন হয় না। কিন্তু জ্ঞান-বিজ্ঞানের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এ পাঠক্রমের পরিবর্তন ছাড়া পরিকল্পনা করা যায় না।

আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় আনতে হবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। এখানে পাঠক্রমের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষা মূল্যায়ন পদ্ধতির পরিবর্তনকে বলছি। অর্থাৎ একজন শিক্ষার্থী যেন বুঝতে পারে যে সে শিক্ষা নিতে এসেছে নিজেকে সত্যিকার একজন মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য। সনদ নেওয়ার জন্য সে আসে নাই।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন : স্যার আমাদের সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

আরেফিন সিদ্দিক : একুশে পরিবারের প্রতি শুভ কামনা রইল।

/ এআর /