ঢাকা, শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

কিশোরী বধূ থেকে সফল নারী উদ্যোক্তা

প্রকাশিত : ০৩:৪১ পিএম, ৮ মার্চ ২০১৮ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ০৫:৫৫ পিএম, ৮ মার্চ ২০১৮ বৃহস্পতিবার

হেলেনা জাহাঙ্গীর

হেলেনা জাহাঙ্গীর

পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষ নিরিবিলি জীবন যাপন করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। সমাজের অধিকাংশ নারী-ই অনেক ক্ষেত্রে রক্ষণশীলতার অজুহাতে আবার কেউ নিরাপত্তার অজুহাতে নিজেকে গুঁটিয়ে রেখেই স্বস্তি পান। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমও আছে। যারা বাধাকে ডিঙিয়ে আনন্দ পান। প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌছতে চান।

পাঠক, আন্তর্জাতিক নারী দিবসের এই দিনে আমরা এমন একজন নারীর গল্প বলবো যিনি জীবনের পরতে পরতে লড়াই করে এগিয়ে যাচ্ছেন। তিনি দৃঢ় মনোবল, সাহস, বুদ্ধি ও পরিশ্রমের সমন্বয়ে নিজেই গড়েছেন নিজের জগত। হ্যাঁ, তিনি হেলেনা জাহাঙ্গীর

হেলেনা জাহাঙ্গীর একজন ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা। সমাজসেবী হিসেবে তার স্বীকৃতি দেশের সীমানা অতিক্রম করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পৌঁছেছে অনেক আগেই। পাশাপাশি টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব হিসেবে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা পেয়েছেন হেলেনা জাহাঙ্গীর।

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই-এর পরিচালক তিনি। জড়িত রয়েছেন ব্যবসায়ী সংগঠন বিজিএমইএ, বিকেএমই, এনসিসিআই, এনএএসসিআইবি, গুলশান ক্লাব, গুলসান নর্থ ক্লাব, বারিধারা ক্লাব, কুমিল্লা ক্লাব, গলফ ক্লাব, গুলসান অল কমিউনিটি ক্লাব, বিজিএমইএ অ্যাপারেল ক্লাব, বোট ক্লাব, গুলসান লেডিস ক্লাব, উত্তরা লেডিস ক্লাব, গুলসান ক্যাপিটাল ক্লাব, গুলসান সোসাইটি, বনানী সোসাইটি, গুলসান জগার্স সোসাইটি ও গুলসান হেলথ ক্লাবে। নিজের হাতে প্রতিষ্ঠিত জয়যাত্রা ফাউন্ডেশন নিয়ে দেশের মাঠ ঘাট চষে বেড়ালেও সিআইএস- বিসিসিআই, রোটারী, ইন্টারন্যাশনাল জোন্টা ক্লাব, ইন্টারন্যাশনাল ইনার হুইল ক্লাব, বাংলাদেশ ক্রীড়া সাংবাদিক সমিতি, আমরা সবাই ফাউন্ডেশন- এর মাধ্যমেও সমাজ সেবায় ভূমিকা রাখছেন।

আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে একুশে টেলিভিশন অনলাইন মুখোমুখি হয়েছিল তার। হেলেনা জাহাঙ্গীর শুনিয়েছেন তার জীবনের গল্প। বলেছেন, লড়াই করে উদ্যোক্তা হওয়ার গল্প। এদেশের প্রেক্ষাপটে নারীদের উদ্যোক্তাদের সমস্যা ও সম্ভাবনার কথা বলেছেন। সেক্ষেত্রে ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো কেমন ভূমিকা রাখছে তাও উঠে এসেছে তার আলাপচারিতায়। সেই সঙ্গে উঠে এসেছে নারীকে নিয়ে আমাদের সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি।

সাহসী হেলেনা জাহাঙ্গীর দাবি করেছেন, এদেশের প্রেক্ষাপটে শেখ হাসিনা জাতির জন্য আশীর্বাদ। দেশকে পৃথিবীর উন্নত রাষ্ট্রগুলোর কাতারে নেওয়ার জন্য শেখ হাসিনার বিকল্প নেই। পাশাপাশি এটাও বলেছেন, অধিকাংশ রাজনীতিবিদ ও জনপ্রতিনিধির মধ্যে সততার অভাব রয়েছে।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন একুশে টেলিভিশন অনলাইন প্রতিবেদক আলী আদনান। পাঠকদের উদ্দেশ্যে সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো-

একুশে টেলিভিশন অনলাইনঃ আজকে উদ্যোক্তাদের মাঝে, সমাজসেবীদের কাছে হেলেনা জাহাঙ্গীর একটি অনুপ্রেরণার নাম। কীভাবে এই জায়গায় এলেন। উঠে আসার গল্প বলুন।

হেলেনা জাহাঙ্গীরঃ আমি বড় হয়েছি চট্টগ্রামে। পড়তাম কৃষ্ণচূড়া স্কুলে। আমাদের বাসা ছিল হালিশহর, মাদারবাড়ী, সদরঘাট এসব এলাকায়।আমার বাবা মরহুম আবদুল হক শরীফ সাহেব জাহাজের ক্যাপ্টেন ছিলেন। আমি খুব চঞ্চল ও দুরন্ত ছিলাম ছোটবেলা থেকে। একপর্যায়ে বাবা অলিম্পিক কোম্পানী থেকে ভালো একটা প্রস্তাব পেয়ে আফ্রিকায় গেলেন। মা আমাদেরকে নিয়ে গ্রামে ফিরে এলেন। গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার দাউদকান্দি।

সাধারণত যেটা হয় শহরের কোনো সুন্দর মেয়ে গ্রামে এলে গ্রামের বখাটেরা নানা ধরণের উৎপাত করে। তখনো করত। নানাভাবে প্রেম প্রস্তাব দেওয়া, দেওয়ার চেষ্টা করা ইত্যাদি। সত্যি কথা হচ্ছে, আমাদের পরিবারটা প্রভাবশালী পরিবার ছিল। কেউ তেমন একটা সাহস করতো না। এরপরও মায়ের চোখে ব্যপারটা পড়ে গেল। তখন নানা দিক থেকে ভাল ভাল বিয়ের প্রস্তাবও আসছিল। বিয়ে হয়ে গেল। ১৯৯০ সালের ৫ অক্টোবর আমাদের বিয়ে হয়।

একুশে টেলিভিশন অনলাইনঃ এত অল্প বয়সে বিয়ে। সেখান থেকে উঠে এলেন কিভাবে?

হেলেনা জাহাঙ্গীরঃ আমি ভাগ্যবান। আমার স্বামী জাহাঙ্গীর আলম আমাকে প্রেরণা যুগিয়েছেন। আমাদের তিন সন্তান। আমার স্বামী তার তিন সন্তানকে যেভাবে যত্ন নেন, আমার যত্নটাও ঠিক একইভাবে নেন। আমি আমার অভিজ্ঞতায় শিখেছি, পেশাগত জীবনে তিনিই সফল, যিনি দাম্পত্য জীবনে ও সাংসারিক জীবনে সফল হবেন। স্বামী- স্ত্রীর ভাল বোঝাপড়া খুবই জরুরি।

একুশে টেলিভিশন অনলাইনঃ ব্যবসায়ী হলেন কীভাবে?

হেলেনা জাহাঙ্গীরঃ আগেই বলেছি, আমি ছোট থেকেই খুব দুরন্ত ছিলাম। সবকিছুর প্রতি আমার তীব্র কৌতুহল ছিল। বড় বড় লেখকের লেখা পড়তাম। বিভিন্ন বিষয় নিজে লেখার চেষ্টা করতাম। তেমনি নিজে কিছু করার তাগিদ থেকে চাকরি খোঁজা শুরু করি। এখানে বলা হয়নি, ক্লাস এইটে পড়া অবস্থায় বিয়ে হলেও বিয়ের পরে নিজের চেষ্টায় পড়ালেখা চালিয়ে যাই। আমাকে আমার স্বামী খুবই সাপোর্ট দিয়েছেন। উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ার সময় নিজ তাগিদে চাকরি খোঁজা শুরু করি। বিভিন্ন জায়গায় ইন্টারভিউ দিচ্ছি। এ অবস্থায় একদিন আমার হাজবেন্ডের অফিসে যাই। নারায়ণগঞ্জে। তার অফিসে গিয়ে আমি একটা ধাক্কা খাই। অফিসের ইন্টেরিয়র ডিজাইন, তার রুম, বসার চেয়ার, প্রভাব- আসলে এতকিছুর জন্য প্রস্তুত ছিলাম না।বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে এমডির অফিস যেমন হয়, তেমনটাই। আমি তখন ভাবলাম আমি যদি কোথাও চাকরি করি, তাহলে আমি ছোট হয়ে যাবো। তাহলে কী করা যায়? হুঁ, ভাল উপায় হচ্ছে নিজে কিছু করা। নিজের মতো করে নিজের একটা জগৎ তৈরী করা। এরমধ্যে ডিগ্রী পাস করলাম। আমাদের প্রথম সন্তানও এর মধ্যে এসেছে।

একুশে টেলিভিশন অনলাইনঃ যাত্রাটা কেমন ছিল?

হেলেনা জাহাঙ্গীরঃ ব্যবসায়ের প্রতি তখন আমার আগ্রহটা এত বেশি ছিল, আমি ব্যবসা সম্পর্কে প্রচুর খোঁজ খবর নেওয়া শুরু করলাম। এই ঢাকা শহরে বিভিন্ন অফিস ভিজিট করা শুরু করলাম। আসলে মানুষের মধ্যে কাজের ক্ষুদা থাকতে হয়। সেই ক্ষুদাটা আমার ছিল। আমার স্বামীর সঙ্গে আলাপ করলাম। বললাম, আমি কিছু করতে চাই। তিনি আমাকে যথেষ্ট গাইড করলেন। মিরপুরে তিনি আমার খালাতো ভাইয়ের সঙ্গে একটা ফ্যাক্টরি করেছিলেন।  কিন্তু আমি শেয়ারে ব্যবসা করতে আগ্রহী ছিলাম না। তখন মিরপুর ১১- এ একটা ভবনের কয়েকটা ফ্লোর নিয়ে কাজ শুরু করি। পেইন্টিং বিজনেস। বিদেশ থেকে মেশিন নিয়ে এসেছিলাম। নিয়ম মেনে প্রচুর পরিশ্রম করতাম। সকাল সাতটায় অফিসে আসতাম। এরপর অল্প সময়ে ধীরে ধীরে ব্যবসার পরিধি বাড়াতে লাগলাম। ঢাকা শহরের অধিকাংশ অফিস ভিজিট করার যে অভিজ্ঞতা তা ব্যবসায় আমাকে খুব কাজে দিয়েছিল।

একুশে টেলিভিশন অনলাইনঃ প্রতিবন্ধকতার অভিজ্ঞতা কেমন?

হেলেনা জাহাঙ্গীরঃ (হেসে) প্রতিবন্ধকতা তো থাকবেই। মিরপুরে যখন ব্যবসা শুরু করলাম তখন দল বেঁধে অনেকে এল। চাঁদা চায়। ব্যবসা চায়। তবে তেমন একটা সুবিধা করতে পারেনি। আমি ওদের মোটিভেট করে ফেললাম। পরে অবশ্য ওরা আমার বিভিন্ন কাজে সহযোগিতা করত। কিন্তু আমি আর ঝুঁকি নিইনি। এরপর আমি আমার সব ফ্যাক্টরি গুছিয়ে নারায়ণগঞ্জ নিয়ে যাই।

একুশে টেলিভিশন অনলাইনঃ আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট নারী উদ্যোক্তাদের জন্য কতোটা উপযোগী?

হেলেনা জাহাঙ্গীরঃ আমাদের পর্যায়ে উদ্যোক্তাদের মধ্যে ১৩% নারী। বাকি ১৭% পুরুষ। সেই বিবেচনায় সংখ্যাটা সন্তোষজনক না। আমাদের পোষাক শ্রমিকদের মাঝে অর্ধেকেরও বেশি নারী। সাধারণত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীতে নারীরা বেশী পরিশ্রমী হয়। অর্থনৈতিক সঙ্গতির কথা চিন্তা করে তাদের পরিবার বা স্বামী সেখানে নারীদের কাজ করতে বাধা দেয় না। বরং উৎসাহ যোগায়। পক্ষান্তরে উচ্চ মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত সমাজে আভিজাত্যের নামে নারীদের কর্মবিমুখ করে রাখা হয়। যেহেতু পারিবারিকভাবে আর্থিক অস্বচ্ছলতা নেই- সেহেতু সেখানে অনেক নারী নিজে কিছু করার চেষ্টায় উৎসাহী হয় না। এটা ইতিবাচক দিক নয়। আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে নারীর অবদান শ্রদ্ধার দাবি রাখে। নারী উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ীরা পুরুষদের তুলনায় সৎ। ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎ করছে, দুর্নীতি করছে এমন অভিযোগ কোনো নারী ব্যবসায়ীর নামে সচরাচর পাওয়া যায় না। তারা যথেষ্ঠ পরিশ্রমী। সুযোগ পায় না। কিন্তু সুযোগ পেলে সুযোগের সদ্ব্যবহারে তারা সচেষ্ট।

একুশে টেলিভিশন অনলাইনঃ তৃণমূলে নারী উদ্যোক্তাদের সাধারণত কী কী সমস্যায় পড়তে হয়?

হেলেনা জাহাঙ্গীরঃ আমাদের দেশে তেলে মাথায় তেল দেওয়া হয়। আমি হেলেনা জাহাঙ্গীর আমার সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থানের কারণে যেসব সুবিধা সহজে পাই- একজন তৃণমূল উদ্যোক্তা কিন্তু তা সহজে পায় না। নানা ধরনের জটিলতা তাকে প্রতিনিয়ত মোকাবেলা করতে হয়। টেবিলে টেবিল তার ফাইল ঘুরে। নানা অজুহাত দেখানো হয়। আমি মূলত এ বিষয়গুলো নিয়ে জনসচেতনতামূলক কাজ করছি। তৃণমূল উদ্যোক্তাদের নানা কথা শুনছি। তাদের কাউন্সিলিং করছি। উৎসাহী করছি।

একুশে টেলিভিশন অনলাইনঃ রাজনীতি নিয়ে কিছু ভাবছেন কি না?

হেলেনা জাহাঙ্গীরঃ আমি যে প্ল্যাটফর্মগুলোতে কাজ করছি, সেখান থেকে মানুষের সঙ্গে সরাসরি মেশা যায়। মানুষের সুখ দুঃখে অংশীদার হওয়া যায়। আশপাশে অনেক এমপি মন্ত্রী দেখি যারা সেই সুযোগ পান না। এদেশের এমপিরা ভোগবাদী। অধিকাংশ এমপি শুধু নিতে জানে। দিতে জানে না। খেয়াল করলে দেখবেন, এমপি হওয়ার আগে তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা থাকে একরকম। পাঁচ বছর যখন বিদায় নেন, তখন অর্থনৈতিক অবস্থা ফুলে ফেঁপে দেখার মতো।

আজকের বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিকল্প নেই। বিশ্বের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায়, বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের লড়াইয়ে তিনি এক অবিসংবাদিত নেতা। আমি তার স্নেহ পেয়েই খুশি। তিনি আমাকে দেশের প্রয়োজনে যা করার নির্দেশ দিবেন আমি তাই করব।

একুশে টেলিভিশন অনলাইনঃ আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ও নারী দিবসের শুভেচ্ছা।

হেলেনা জাহাঙ্গীরঃ পৃথিবীর সব বঞ্চিত নারী পথ খুঁজে পাক, সেটাই প্রত্যাশা।

/ এআর /