ঢাকা, বুধবার   ১৭ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ৩ ১৪৩১

‘আইনী জটিলতায় নারী উদ্যোক্তারা সুবিধা পাচ্ছে না’

প্রকাশিত : ০৭:৪২ পিএম, ১০ মার্চ ২০১৮ শনিবার | আপডেট: ০৭:৫৫ পিএম, ১০ মার্চ ২০১৮ শনিবার

নারী উদ্যোক্তাদের জন্য রাষ্ট্র অনেক সুবিধা দেওয়ার পরও আইনের নানা মারপ্যাঁচে এসব সুযোগ কাজে আসছে না। তাছাড়া নারীরা পারিবারিক ও গৃহস্থালি কাজে যে শ্রম ও সময় দেয় এরও কোনো স্বীকৃতি নেই।

একুশে টেলিভিশন অনলাইনকে দেওয়া এক একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন ব্যারিষ্টার মিতি সানজানা

তিনি মূলত একজন কর্পোরেট ল`ইয়ার। আইনপেশার পাশপাশি তিনি শ্রমজীবী নারীদের অধিকার, নারীদের সচেতনতা বৃদ্ধি নিয়ে কাজ করছেন। এসব বিষয় নিয়েই তার সাক্ষাতকারটি নিয়েছেন একুশে টেলিভিশন অনলাইন প্রতিবেদক আলী আদনান

একুশে টেলিভিশন অনলাইনঃ আপনি কর্পোরেট` ল নিয়ে কাজ করছেন। ঐ জায়গা থেকে বলুন আমাদের উদ্যোক্তা নারীদের কী কী সমস্যা রয়েছে?

ব্যারিস্টার মিতি সানজানাঃ হ্যাঁ, এজন্য বিভিন্ন স্কীম রয়েছে। কিছুদিন আগে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। যেখানে বলা হচ্ছে, একজন নারীকে মাত্র ৯% সুদে লোন দেওয়া যাবে। কিন্তু অন্যদের জন্য সেটা ১৪% বা ১৫%।

এটা একটা ইতিবাচক দিক। এর ফলে নারীরা উদ্যোক্তা হতে উৎসাহ পায়। তবে এর পরও অনেক নারী সাহস করে এগিয়ে আসে না। কেন আসে না? এখানে জামানত বিহীন লোনের কথা বলা হয়েছে। কোন নারী যদি ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত লোন চায়, তার কোন জামানত লাগবেনা। কিন্তু তারপরও সেটি সম্ভব হয়না।

কারণ, লোন পাওয়ার ক্ষেত্রে একটি শর্ত দেওয়া আছে। শর্তটি হলো, কোন একজন সরকারী কর্মকর্তা তার গ্যারান্টার হতে হবে। গ্রামের একজন সাধারণ নারীর পক্ষে এটি কঠিন শর্ত। অনেক ক্ষেত্রে স্বামীকেও গ্যারান্টার হতে বলা হয়। কিন্তু যারা বিধবা নারী বা তালাকপ্রাপ্তা নারী তারা সে সুযোগটি পাচ্ছেন না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, এসএমই ক্ষুদ্র লোনের ১০% নারীদের দিতে হবে। কিন্তু এসব জটিলতার কারণে নারীর লোন পাওয়া হয়ে উঠেনা। ২০১৬ সালে মাত্র ৩% নারী এ লোন পেয়েছেন।

ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা বলছেন, তাদের চাহিদায় ২৫% ঘাটতি রয়ে গেছে। আবার সামাজিক দৃষ্টিভংগিও অনেক সমস্যার জন্ম দিচ্ছে। যেমন: নারীকে লোন দিলে আদৌ তিনি সেই লোন শোধ করতে পারবেন কীনা? বা ব্যবসা দাঁড় করাতে নারীরা কতটুকু সক্ষম এমন সব প্রশ্ন কিন্তু এসব ক্ষেত্রে আসছে। অর্থাৎ নারীদের জন্য সরকার ইতিবাচক উদ্যোগ গ্রহণ করলেও ব্যাংকের দিক থেকে অসহযোগিতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

 

একুশে টেলিভিশন অনলাইনঃ নারী পারিবারিক ও সামাজিক জীবনেও অনেক শ্রম দেয়। কিন্তু তার কোন স্বীকৃতি পায়না বা পাচ্ছেনা। কেন?

ব্যারিস্টার মিতি সানজানাঃ পারিবারিক জীবনে পুরুষের চেয়ে নারীর শ্রমের পরিমাণ অনেক অনেক বেশি। কিন্তু তার কোন মূল্যায়ন কোথাও নেই। সন্তান লালন পালন, গৃহের কাজ কর্ম করা, রান্না বান্নাসহ সব ধরনের কাজেই নারীর ভূমিকা বেশি। এটাকে টাকা পয়সার হিসেবে কনভার্ট করলে কিন্তু অনেক টাকা আসে। কিন্তু আমাদের সমাজে এটাকে নারীর একতরফা দায়িত্ব বলে এড়িয়ে যাওয়া হয়। ফলে নারী আয় ও মূল্যায়ন দুটো থেকেই বঞ্চিত হয়। সাংসারিক জীবনে সময় ও শ্রম দিতে গিয়েই নারী অফিসিয়ালি চাকরি করার সুযোগ পাচ্ছেন না অনেক ক্ষেত্রে। সে বিবেচনায় সমাজে তার মূল্যায়ন করা উচিত। কিন্তু সে আয়ের উৎস নয়, বা পরনির্ভরশীল এ বিবেচনায় নারীকে অবহেলার দৃষ্টিতে দেখা হয়। শ্রম আইনে আট ঘণ্টা সময় চাকরিতে দেওয়ার কথা বলা আছে। ওভার টাইম সহ দশ ঘণ্টা। কিন্তু একজন মা চব্বিশ ঘণ্টাই সময় দেন। যার কোন ধরনের মূল্যায়ন তিনি পারিবারিক বা সামজিক জীবনে পাননা। নারী যদি ঘর সংসারে সময় না দিয়ে দেশের কাজে সময় দেয় তাহলে তার কাজের স্বীকৃতি আসবে। নিজের মেধার স্বীকৃতি পাওয়ার পাশাপাশি রাষ্ট্রেরও কল্যাণ হবে।

একুশে টেলিভিশন অনলাইনঃ আমাদের দেশে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য কী কোন আলাদা আইন আছে?

ব্যারিস্টার মিতি সানজানাঃ না, আমাদের দেশে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য আলাদা কোন আইন নেই। যেহেতু আমাদের সমাজে নারী- পুরুষ উভয়কে সমদৃষ্টিতে দেখা হয় সেহেতু এমন আইনের কথা কেউ চিন্তা করেন না। কিন্তু নারী মালিকানা, কোম্পানীতে নারীর অধিকার, নারীর জন্য ব্যবসা বান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করা, ট্রেড লাইসেন্স, টিন সার্টিফিকেটসহ নানা বিষয়ে নারীদের অগ্রাধিকার দিয়ে কিছু আইন হওয়া দরকার। এর ফলে তারা উৎসাহ পাবে।

আমাদের মোট জনগোষ্ঠীর অর্ধেক নারী। সহস্রাব্দের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে আমাদের যে যাত্রা তা কিন্তু নারীকে বাদ দিয়ে সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে ব্যাংকের বিভিন্ন স্কীমে, ব্যাংক লোনের ক্ষেত্রে কিছু সহজ নারী বান্ধব আইন আসা দরকার।

খেয়াল করলে দেখবেন, লোন পেতে গিয়ে একজন নারীকে নানা ধরনের ঝক্কি ঝামেলার ভেতর দিয়ে অনেকগুলো পদক্ষেপ পার হতে হয়। এর ফলে একটা পর্যায়ে সে উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। আবার অনেক সময় দেখা যায় অনেক প্রক্রিয়া পার হওয়ার পর শেষ মুহুর্তে কোন একটা ছোট অজুহাতে তার লোনটা আটকে যায়। এজন্য নারী উদ্যোক্তাদের জন্য আইন দরকার।

 

একুশে টেলিভিশন অনলাইনঃ আপনি একজন লেবার ল`ইয়ার। সেই জায়গা থেকে সাধারণত কোন ধরনের সেবা নারী শ্রমিকদের দিয়ে থাকেন?

ব্যারিস্টার মিতি সানজানাঃ আমি সাধারণত নারী শ্রমিকদের সচেতন করে থাকি। প্রচুর নারী শ্রমিককে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি। শ্রম আইন সম্পর্কে তাদেরকে সচেতন করে থাকি। শ্রম আইনে অনেক ধরণের বিষয় চলে আসে। যেমন: একজন নারীকে নাইট শিফটে কাজ করতে বাধ্য করা যাবেনা। মাতৃত্বকালীন ছুটি নিয়ে তাদের সচেতন করি। আমাদের দেশে মাতৃত্বকালীন ছুটি পাওয়ার ব্যপারে ও এর নানাদিক নিয়ে অনেকে এখনো সচেতন নয়।

একজন নারী গর্ভকালীন সময়ে ( যদি তিনি সরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ না করে থাকেন) চারমাস ছুটি পান। এর মধ্যে দুই মাস সন্তান জন্ম দেওয়ার আগে আর দুই মাস সন্তান জন্ম দেওয়ার পরে। এই চারমাস তিনি পুরোপুরি বেতন পাবেন। উপরন্তু তিনি একটি মাতৃত্বকালীন সুবিধা পাবেন। আমাদের অনেক মেয়েই এই সুবিধা সম্পর্কে জানেন না। শ্রম আইনে বলা আছে প্রত্যেকটি ফ্যাক্টরী বা প্রতিষ্ঠানে একটা করে শিশু কক্ষ থাকবে। যেখানে কর্মজীবী মা তার শিশুকে স্তন্য পান করাতে পারবেন। এসব বিষয়ে শ্রমিকদের সচেতন করা, তাদের একটা ভয়েস তৈরি করা- এটাই আমি করে থাকি।

একুশে টেলিভিশন অনলাইনঃ আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

ব্যারিস্টার মিতি সানজানাঃ আপনাকেও ধন্যবাদ।

আআ/টিকে