ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৫ ১৪৩০

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল

রোহিঙ্গাদের জমিতে ঘাটি বানাচ্ছে সেনাবাহিনী

প্রকাশিত : ১০:৩২ এএম, ১২ মার্চ ২০১৮ সোমবার | আপডেট: ১১:২৫ এএম, ১২ মার্চ ২০১৮ সোমবার

মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নিপীড়নে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের গ্রামগুলোতে সামরিক ঘাটি ও স্থাপনা নির্মাণের কাজ চলছে। রাখাইন গ্রামগুলো পুড়িয়ে দেওয়ার পর সেখানে চলছে সেনা ঘাটি, হেলিপ্যাড ও সড়ক নির্মাণের কাজ। এসব অবকাঠামামো নির্মাণের জন্য যাও কিছু রোহিঙ্গা সেখানে ছিল তাদেরকেও জোরপূর্বক তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।
নতুন এক গবেষণার পর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এই দাবি করেছে। তারা স্যাটেলাইট থেকে ধারণ করা ছবি ও প্রত্যক্ষ দর্শীদের বরাত দিয়ে এমন তথ্য জানতে পেরেছেন।
অ্যামনেস্টির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যেসব গ্রাম থেকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নির্যাতনে রোহিঙ্গারা পালিয়ে গেছেন সেসব গ্রামেই ওই রোহিঙ্গাদের ফেলে আসা জমি ও ভিটে-বাড়ির উপর ঘাটি তৈরি করছে সেনাবাহিনী।
এই জানুয়ারি মাসে রোহিঙ্গাদের গ্রামে বহু বাড়িঘর বুলডোজার দিয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়। তখন থেকেই সেখানে সেনা ঘাটির অবকাঠামো নির্মাণের কাজ শুরু করেছে।
নতুন করে সারি সারি ঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে বলেও জানাচ্ছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। এর আগে মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচও একই ধরনের ঘটনার বর্ণনা দিয়েছিল।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের একজন মুখপাত্র এটিকে সেনাবাহিনীর ভূমি গ্রাস বলে উল্লেখ করেছেন।
তবে মিয়ানমারের সরকার অ্যামনেস্টির অভিযোগ সম্পর্কে কোন মন্তব্য করেনি।
গত বছরের ২৫ আগস্ট থেকে মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর অভিযানে নির্যাতন শুরুর পর থেকে প্রাণভয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা।
জানুয়ারিতে অ্যামনেস্টির সবশেষ গবেষণায় রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বহু গ্রাম বুলডোজারে জ্বালিয়ে দেওয়ার আলামত উঠে এসেছিল। বলা হচ্ছিলো রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত সামরিক বাহিনীর নিধনযজ্ঞ আড়াল করতেই গ্রামগুলোতে বুলডোজার চালানো হচ্ছে। এইচআরডব্লিউ-এর পক্ষ থেকে অপরাধের আলামতের সুরক্ষায় অবিলম্বে বুলডোজারের ব্যবহার বন্ধের তাগিদ দেওয়া হয়েছিল মিয়ানমারকে। একই মাসে ‘দ্যা আরাকান প্রজেক্ট’ নামে সে দেশের স্থানীয় একটি মানবাধিকার পর্যবেক্ষক সংস্থা  একই ধরনের অভিযোগ তুলেছিল।তবে নতুন করে অ্যামনেস্টির দেওয়া বিবৃতি থেকে জানা গেল, বুলডোজারে গ্রাম গুঁড়িয়ে দেওয়ার সঙ্গে সেনাঘাঁটিসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণেরও সম্পর্ক রয়েছে।
স্যাটেলাইট ইমেজ বিশ্লেষণ করে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল অন্তত তিনটি নিরাপত্তা ঘাঁটি নির্মাণের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছে। এগুলোর একটি উত্তর-রাখাইনে। অপর দু`টি মংডু ও বুথিডাউং-এ। সংস্থাটি ধারণা করছে, জানুয়ারি মাসে ঘাঁটিগুলোর নির্মাণ কাজ শুরু হয়।  ক্রাইসিস রেসপন্স ডিরেক্টর তিরানা হাসান বলেন, `সমগ্র গ্রামে বুলডোজার চালানোর ঘটনা খুবই উদ্বেগের। যারা এসব অপরাধকর্মে জড়িত ভবিষ্যতে তাদের বিচারকে কঠিন করে তুলতে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ মানবতাবিরোধী অপরাধের আলামত নষ্ট করছে।
স্যাটেলাইট ইমেজে ডিসেম্বরে সহিংসতা থেমে যাবার পরও নতুন করে চারটি মসজিদ ধ্বংস করে দেওয়ার আলামত পেয়েছে অ্যামনেস্টি।  একটি রোহিঙ্গা গ্রামে সদ্য ধ্বংস করা মসজিদের অবস্থানে একটি পুলিশের একটি নিরাপত্তা চৌকি স্থাপন হতে দেখেছে সংস্থাটি।   
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সংকট মোকাবিলাবিষয়ক পরিচালক তিরানা হাসান  বলেছেন, ‘রাখাইন রাজ্যে সামরিক বাহিনীকে বিপুল পরিমাণে জমি দখল করতে দেখা গেছে। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনকারী সে একই নিরাপত্তা বাহিনী এখন ঘর তৈরির জন্য নতুন ঘাঁটি স্থাপন করেছে। আর তা রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায়, নিরাপদে এবং মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনকে আরও বেশি দূরাশায় পরিণত করে দিচ্ছে। কেবল তাদের বাড়ি-ঘরই নষ্ট হয়নি, বরং নতুন এ নির্মাণ কাজের মধ্য দিয়ে মিয়ানমারে আগে থেকে অমানবিক বৈষম্যের শিকার হয়ে আসা রোহিঙ্গাদের জন্য পুরনো বাস্তবতাকেই সুরক্ষিত করা হচ্ছে।
ফেব্রুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে সোফরেপ-এর প্রতিবেদনও একই ধরনের তথ্য উঠে এসেছিল। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, রোহিঙ্গাদের অন্যান্য গ্রামের মতো বুথিডাউং শহরে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সরাসরি কোনও সহিংসতা দেখা যায়নি। তারপরও সেখান থেকে অনেক রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে এসেছেন। রাজ্যজুড়ে সেনাবাহিনীর নির্যাতন শুরুর পর পরিবারকে সহিংসতার হাত থেকে বাঁচাতে অনেকে আগেই পালিয়ে গেছেন। এটা দেশজুড়ে চালানো মিয়ানমার সেনাবাহিনীর একটি সাধারণ কৌশল। সোফরেপ-এর প্রতিবেদন বলছে, মিয়ানমার সরকার এখন কারেন জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে যুদ্ধবিরতিতে রয়েছে।
মিয়ানমারে কারেন উপজাতির প্রায় ৬০ লাখ বাসিন্দা রয়েছে। তাদের সঙ্গে মিয়ানমার সরকারের দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলে আসছে। তারপরও তারা বিরোধপূর্ণ এলাকায় সেনাবাহিনীর অবস্থান শক্তিশালী করছে। যদি কখনও আবার লড়াই শুরু হয় তাহলে বাড়তি সুবিধার জন্য তারা এটা করছে। সরকারের আধিপত্য থাকায় কারেন উপজাতিরা রোহিঙ্গাদের মতোই তেমন কোনো প্রতিবাদ করতে পারছে না। কারেন রাজ্য থেকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সূত্র সোফরেপকে সে সময় জানায়, সরকার কারেন রাজ্যেও পরিকল্পিতভাবে সড়কসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করেছে। সেখানে কারেনদের কোনও স্থাপনা নির্মাণে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। সেখানে জঙ্গলের বাইরেও স্থাপনা নির্মাণ করেছে মিয়ানমার। যাতে যুদ্ধবিরতি ভঙ্গ হলে তাৎক্ষণিকভাবে ভারী কামান দিয়ে কারেনদের ওপর হামলা চালানো যায়।
সূত্র : অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ওয়েবসাইট।
/ এআর /