ঢাকা, বুধবার   ০১ মে ২০২৪,   বৈশাখ ১৭ ১৪৩১

‘শিক্ষা কর্মমুখী না হওয়াই বেকারত্বের কারণ’

প্রকাশিত : ০৬:০৯ পিএম, ১৯ মার্চ ২০১৮ সোমবার | আপডেট: ০৪:৪২ পিএম, ২০ মার্চ ২০১৮ মঙ্গলবার

ড. সৌমিত্র শেখর

ড. সৌমিত্র শেখর

একাডেমিক শিক্ষার সর্বোচ্চ সনদ নিয়েও বছরের পর বছর পার করে দিচ্ছে দেশের অসংখ্য শিক্ষার্থী, চাকরি মিলছে না। স্নাতকোত্তর পাশের পর ৩ থেকে ৪ বছর আবার চাকরির জন্য আলাদাভাবে প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে। সর্বোচ্চ সনদ নিয়ে করতে হচ্ছে কোচিংও। তাতেও অনেকের চাকরি মিলছে না। আবার যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও কোটার মারপ্যাঁচে ধুঁকছে মেধাবীরা। কোটা সুবিধা নিয়ে অপেক্ষাকৃত কম মেধাবীরা ক্ষেত্রবিশেষে মেধাহীনরাও চাকরি পেয়ে যাচ্ছে।

অন্যদিকে পাবলিক পরীক্ষা থেকে শুরু করে চাকরি পরীক্ষা সর্বত্র দেদারসে চলছে প্রশ্নফাঁস। এতে লেখাপড়া না করেও ফাঁকফোকরে সনদ পেয়ে যাচ্ছে মেধাহীনরা। তাহলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার গলদটা কোথায়? এর সুলোক সন্ধানে একুশে টেলিভিশন অনলাইন মুখোমুখি হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক, লেখক ও  প্রাবন্ধিক ড. সৌমিত্র শেখরের। তার কথায় উঠে এসেছে প্রশ্নফাঁস, কোচিং বাণিজ্য, কোটা পদ্ধতির সংস্কার, শিক্ষার্থীদের চাকরির সমস্যাসহ শিক্ষাব্যবস্থার নানা অসঙ্গতি-গলদ।

সৌমিত্র শেখর মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নেওয়ার পরও চাকরি না পাওয়ার বড় কারণ মনোস্তাত্ত্বিক ব্যাপার। আমরা এখনও মনে করি যে, এমএ পাশ না করলে আমাদের শিক্ষা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। মাস্টার্স পাশ করেও যদি সে বেকার থাকে তারপরও বাপ-মা মনে করে যে আমরা ছেলে এম এ পাশ। আর এসএসসি পাশ করেও যদি কেউ নিজ চেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয় তারপরও তার মনে কষ্ট থাকে যে, আমি কেন পোস্ট গ্রাজুয়েট হতে পারলাম না। অর্থাৎ আমরা ডিগ্রিকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। আর যে ডিগ্রিকে আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি সেটা কর্মমুখী শিক্ষা না। এজন্যই গ্রাজুয়েশন করেও চাকরি হচ্ছে না বহু তরুণের। বাড়ছে বেকারত্ব।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন একুশে টেলিভিশন অনলাইন প্রতিবেদক রিজাউল করিম । দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের শেষ পর্ব পাঠকদের উদ্দেশ্যে তুলে ধরা হলো-

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: আমাদের দেশে এতো শিক্ষিত যোগ্য লোক, অথচ পোশাক শিল্পসহ দেশের বিভিন্ন শিল্পকারখানায় বিদেশি এক্সপার্টদের বেশি বেতনে আনা হচ্ছে। কেন আমরা সে জায়গাটা নিতে পারছি না? কেন সর্বোচ্চ পর্যায়ের ডিগ্রি নেওয়ার পরও চাকরি মিলছে না?

সৌমিত্র শেখর : চাকরি না হওয়ার বড় কারণ মনস্তাত্ত্বিক। আমরা এখনও মনে করি যে এমএ পাশ না করলে আমাদের শিক্ষা শেষ হবে না। এম এ পাশ করেও যদি সে বেকার থাকে তারপরও বাপ-মা মনে করে যে আমরা ছেলে এমএ পাশ। আর এসএসসি পাশ করেও যদি কেউ নিজ চেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয় তারপরও তার মনে কষ্ট থাকে যে আমি কেন গ্রাজুয়েট হতে পারলাম না।

অথচ বিশ্বের অন্যান্য দেশে এর উল্টো চিত্র পাওয়া যাবে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মানুষ মনে করে যে, তাকে স্বাভলম্বী হতে হবে। এই যে আমাদের ছেলে-মেয়েরা বিদেশে গেলে সহজে উচ্চশিক্ষায় ভর্তি হতে পারে, তার কারণটা কি? কারণ একটাই, ওখানে যারা থাকে তাকে গ্রাজুয়েশন করলেই হয়। পোস্ট গ্রাজুয়েশনে তারা আর ভর্তি হয় না। ওইযে আসনগুলো ফাঁকা থাকে ওই আসনগুলোতে আমাদের সন্তানেরা খুব সহজেই ভর্তি হতে পারে। আর ওইসব দেশের আসন যারা ফাঁকা করলো অর্থাৎ পোস্ট গ্রাজুয়েশন করলো না, তারা কিন্তু বসে থাকছে না। চাকরিতে ঢুকে যাচ্ছে। কারণ তারা আঠারো বছর বয়স থেকেই নিজের দায়িত্ব নিজেই নেয়। মা-বাবা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়। তাদের লেখা-পড়ার মধ্যে একটা বিষয় গুরুত্ব পায় সেটা হলো বৃত্তি বা চাকরি। সে ভাবতে থাকে কীভাবে জীবন-জীবিকা চালাবে। ভাবনা অনুযায়ী সেটা তারা পেয়েও যায়।

কিন্তু দূর্ভাগ্যক্রমে আমাদের দেশে সে বৃত্তিমূলক লেখা-পড়া গড়ে ওঠে নাই। যেহেতু মনস্তাত্ত্বিকভাবে আমাদের মাথার মধ্যে কাজ করে যে, এমএ পাশ করতে হবে। এ কারণে কলেজগুলোতে পোস্ট গ্রাজুয়েশন বাড়ছে কিন্তু পোস্ট গ্রাজুয়েশন করেও ছেলে-মেয়েরা চাকরি পাচ্ছে না। মাদ্রাসা শিক্ষার ক্ষেত্রে এটা আরও ভয়াবহ। মাদ্রাসায় একটি ছেলে ১২ বছর পড়েও আধুনিক আরবিতে ভালোভাবে কথা বলতে পারে না। এটা কারিগরি শিক্ষার ক্ষেত্রেও বিদ্যমান। কারিগরি শিক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও মনস্তাত্ত্বিক কারণে আমরা সেটার খোঁজও নিই না। জানি না তাদের কারিকুলামটা কি। এমনকি যে সন্তানটা কারিগরিতে ভর্তি হলো আমরা তাদের অগ্রগতি সম্পর্কে জানিও না।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: আমাদের দেশে কোচিংয়ের পাশাপাশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে। বাণিজ্য থেকে বেরিয়ে শিক্ষাকে কীভাবে নিরেট সেবায় রূপান্তর করা যায়?

সৌমিত্র শেখর : এটা আসলে সরকার একা পারবে না। যদি আমরা সহযোগিতা না করি। আমাদের রন্দ্রে রন্দ্রে ষঠতা। আমাদের আইন আছে, সেটা বলবার বা দেখাবারও মানুষ আছে। কিন্তু মান্য করার প্রবণতা কম আছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থ রোজগারের একটা বুনো উল্লাস চলছে। যাদের টাকা আছে তারাই এ উল্লাস করছে। একটি কম্পিউটার কোম্পানি বা সিমেন্ট কোম্পানি লাখ লাখ টাকা মুনাফা করে। এখন তারা যদি এ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে তো লাভ তো করবেই। কারণ তাদের মাথায় তো লাভের বিষয়টা আগে থেকেই রয়ে গেছে। এটাই সমস্যা। আমাদের দেশে যারা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় দিয়েছে তাদের অধিকাংশ শিক্ষা প্রসারে দেননি। মুনাফার জন্য দিয়েছেন। যে কারণে লবণ কারখানার কাছ থেকে যে মুনাফা প্রত্যাশা করা হয়, বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও সে মুনাফা প্রত্যাশা করা হয়। এটা যতদিন না বন্ধ হবে, মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন যতদিন না আসবে ততদিন ব্যবসা বন্ধ হবে না।

মনে রাখবেন আমাদের দেশের গণতন্ত্র আর যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র কিন্তু এক না। অ্যারিস্টোটল, প্লেটো এমনকি জর্জ ওয়াশিংটনের শিক্ষাটা ছিল সমশিক্ষিতের মধ্যে। অর্থাৎ এলিট শ্রেণী যারা তারা চিন্তা করে ভোট দেবে। সেক্ষেত্রে চিন্তার দিক দিয়ে সব ভোটারের মধ্যে সমতা থাকবে। আর আমাদের দেশে প্রত্যেকেই ভোটার। এখানে পিএইচডি হোল্ডার, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, ইঞ্জিনিয়ার তাদের ভোটের মূল্য যা একজন হেরোইন খোরের ভোটের মূল্য তা। দু’জন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক যদি ভোট দেন, আর ৫ জন হেরোইন খোর যদি ভোট দেন। তবে ৫জনের মতটা স্বীকৃত হবে। আমাদের গণতন্ত্রের মূল চেতনাটা এখানে। এ কারণে যারা ভোটের রাজনীতি করে তারা একটা সংকটে থাকেন। কারণ সিমেন্ট বা লবণ কারখানার মালিক যে বিশ্ববিদ্যালয় দিয়েছে, তার কথায় হাজার মানুষ উঠবস করে। আমরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বাণিজ্য বন্ধ্ করবো? তার আগে ভাবতে হয় যে লবণ কারখানার মালিকের কাছে হাজারটি ভোট আছে। সুতরাং এটা করা যাবে না। তাই কোনো সরকার এ কাজে হাত দিতে পারে না। গণতান্ত্রিক প্রতিবন্ধকতা কাজ করে।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: জনসংখ্যার বোনাসকাল (ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড) অতিবাহিত করছে দেশ। অথচ সরকারি হিসেবে দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ২৫ লাখের বেশি। আমরা দেশের এই বিশাল কর্মক্ষম জনশক্তিকে কেন কাজে লাগাতে পারছি না? মূল সমস্যা ও সমাধান কোথায় নিহিত?

সৌমিত্র শেখর : ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট একটা টেকনিক্যাল বিষয়। কারণ আধুনিক বিশ্বে শারীরিক ক্ষমতা কোনো ক্ষমতা না। এই ব্যারোমিটারটা ৬০ বছর আগে ঠিক ছিল। কিন্তু আজকে আমাদের এখানে এটা ঠিক না। কারণ এখন শারীরিক শক্তির জায়গাতে টেকনোলজিটাই বড় ব্যাপার। মানুষ এখন কাপড় কাঁচে মেশিনে, ঘর মুছে মেশিনে, ক্রেন দিয়ে ভারি জিনিস তোলে। ফলে আমরা যেটা নিয়ে গর্ব করছি সেটা প্রকৃত অর্থে ৬০ বছর আগে হলে ঠিক ছিল। যখন টেকনলজি ছিল না। এখন বরং জনসংখ্যা আমাদের এখানে একটা ভার। জনসম্পদের কথা বলে বলে আবার দেশের জনসংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে। মানুষ কয়েক বছর আগে পরিবার পরিকল্পনার প্রতি ঝুঁকে গেলেও এখন আবার বহু সন্তানের দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে। বহির্বিশ্ব টেকনোলজিকে গুরুত্ব দিয়েছে। যে কারণে তারা জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করেছে। তারা মানুষের আয়ুস্কাল বাড়িয়েছে। তারা ১২০ বছরে বৃদ্ধ হয়। আমাদের দেশে ৬০ পেরুতেই বৃদ্ধ হয়ে পড়ি।

তাই বাংলাদেশের উচিত হবে এ যুবশক্তি বা শ্রমঘণ্টা কাজে লাগিয়ে দেশকে এগিয়ে নেওয়া। সেক্ষেত্রে প্রযোজনে বহির্বিশ্বের সহযোগিতা কাজে লাগানো।অতি দ্রুত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো। তা না হলে গায়ের শক্তি দিয়ে কিছু হবে না। বোঝা-ই বাড়বে।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: অনেকের অভিমত, শিক্ষা ব্যবস্থা হয়ে পড়েছে অনেকটাই সনদনির্ভর। দেশপ্রেম, নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধের প্রচুর ঘাটতি রয়েছে শিক্ষার্থীদের মাঝে। এগুলোর চর্চার অভাবে একজন মেধাবী দেশের সম্পদ হওয়ার পরিবর্তে অভিশাপে পরিণত হচ্ছে। এ পরিস্থিতি থেকে কীভাবে উত্তরণ ঘটানো যায়?

সৌমিত্র শেখর : আমাদের ছেলে-মেয়েদের মধ্যে নীতি-নৈতিকতা ধ্বসে যাচ্ছে। একশ’ বছর আগে আমরা যে শিক্ষা পেয়েছি আজ তা পাচ্ছি না। আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো সুখ জিনিসটার সংঙ্গা খুঁজে না পাওয়া। সুখটা যে নীতির ওপর, সন্তুষ্টির ওপর, আত্মতৃপ্তির ওপর নির্ভর করে। সেটা অনুধাবন করতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। যে কারণে ছেলে-মেয়েদের মধ্যে শিক্ষিত হয়েও নীতি-নৈতিকতার ঘাটতি দেখা দিয়েছে।

এখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারিবিারিক শিক্ষা, মমত্ববোধ, সহমর্মিতা বাড়াতে হবে। পারিবারিকভাবে অনুধাবনে আনতে হবে যে জীবনে নীতি-নৈতিকতার মধ্যেই সুখ। মা-বাবাকে আগে পরিশুদ্ধ হতে হবে। তারপর সন্তানদেরও নিয়ন্ত্রণে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। এখন মানুষকে  বোঝানো হয় না পরার্থে জীবন দেওয়ার গল্প। অন্যের উপকারে নিজের সুখ পাওয়া গল্প। যার কারণে শিক্ষিত হয়েও ছেলে-মেয়েরা নীতি-নৈতিকতা, অন্যের প্রতি তার দায়িত্ব ও কর্তব্য ভুলে যাচ্ছে।

ছেলে-মেয়েরা ক্যারিয়ার নিয়েই ব্যস্ত থাকছে। প্রতিবেশির খোঁজ নিচ্ছে না। আর সে ক্যারিয়ার হচ্ছে শুধুমাত্রা নিজেকে ঘিরে। তাই আগের মতো এখন আর যৌথ পরিবারও দেখা যায় না। টেকনোলজির অপব্যবহার আমাদেরকে বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে। পরস্পর যোগাযোগ ও মমত্ববোধ বিনষ্ট করছে। চারজন ঘরে থাকলে কেউ মোবাইল, কেউ টেলিভিশন, কেউ ল্যাপটপ, কেউবা একা একাই ঘুরছে। এসব থেকে রক্ষা পেতে আমাদের আবার ফিরে আসতে হবে আমাদের মাটির কাছে, বাঙালির সংস্কৃতির কাছে। আবার ফিরতে হবে আমাদের অতিত ঐতিহ্যের কাছে।

একাডেমিক ক্ষেত্রে পড়া-লেখার ভারটা কমাতে হবে। আমি মনে করি ছেলে-মেয়েদের যুক্ত করে রাখা হয়েছে তথাকথিত পাঠ্যপুস্তকে। এটা আসলে পাঠ্যপুস্তক না, অপাঠ্যপুস্তক।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কি? শিক্ষা পদ্ধতির আমূল পরিবর্তন দরকার আছে কি না?

সৌমিত্র শেখর : আমরা তো শিক্ষানীতি নিয়ে এগোতেই পরিনি। পরিবর্তন কী করবো। শিক্ষানীতির পরিবর্তন দরকার নেই। তবে ২০১০ সালে যে শিক্ষানীতি আছে সেটা ধরেও আমরা এগোতে পারছি না। এগোতে পারলে হয়তো আমরা সুফল পাবো।

আরকে// এআর