ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৮ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৪ ১৪৩০

এলো নববর্ষ, শুভ নববর্ষ

সৈয়দ আবদাল আহমদ

প্রকাশিত : ১২:১৩ এএম, ১৩ এপ্রিল ২০১৮ শুক্রবার

‘‘সকল জীর্ণতা দীর্ণ করে তুমি এসো হে বৈশাখ

এসো উত্তপ্ত বদ্বীপে, সবুজ পল্লবে, নবরূপে
এসো স্বপ্ন-সম্ভাবনা বুকে নিয়ে, এসো বারবার,
মুছে দাও ব্যর্থতার যত গ্লানি, জীবনের ভার।’’

বাংলা নববর্ষ পয়লা বৈশাখকে কবিতায় এভাবেই আবাহন করেছেন কবি মোশাররফ হোসেন খান। আজ শুক্রবার চৈত্র সংক্রান্তির দিন। রাত পোহালেই পয়লা বৈশাখ। বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন। সব অশুভ ও অসুন্দরকে পেছনে ফেলে নতুনের কেতন উড়িয়ে আগমন ঘটবে নতুন বছরের। শুভ নববর্ষ ১৪২৫।

নববর্ষ মানেই নতুন আশা, নতুন স্বপ্ন, নতুন প্রত্যয়। নববর্ষ মানেই জীর্ণ-পুরোনোকে বিদায় জানানো। নববর্ষ মানেই কবি শামসুর রাহমানের গান: ‘এলো নববর্ষ, শুভ নববর্ষ’। নববর্ষ মানেই কবি সুফিয়া কামালের কবিতা:
চৈত্রের বিষন্ন রাত্রি তার
দিয়ে গেল শেষ উপহার
প্রসন্ন নবীন
বৈশাখের ঝলোমলো দিন।
পুরাতন গত হোক! যবনিকা করি উন্মোচন
তুমি এসো হে নবীন! হে বৈশাখ! নববর্ষ!
এসো হে নতুন!

 

সর্বজনীন উৎসবের দিন পয়লা বৈশাখ। বাংলাদেশের সকল মানুষের হৃদয়কে এ দিনটি স্পর্শ করে। নানা ঝামেলার মধ্যেও পয়লা বৈশাখ আমাদের একটু অন্যভাবে নাড়া দেয়। এর কারণ বঙ্গাব্দের সঙ্গে বাংলাদেশের ঋতু চক্র এবং কৃষি উৎপাদনের নিবিড় সম্পর্ক।


বৈশাখ আমাদের সাহিত্যে, বৈশাখ আমাদের কবিতায়, বৈশাখ আমাদের গানে, বৈশাখ আমাদের জীবনের। অর্থ থাকুক আর নাই থাকুক পয়লা বৈশাখে আমাদের হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সুর জেগে উঠবে- ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো...। কিংবা ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর...।’

পয়লা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব। এই বর্ষবরণ উৎসব এখন বিশাল রূপ নিয়েছে। সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে যে উৎসবের শুরু তা চলে রাত অবধি। কতই না আনন্দ! এই আনন্দ রবীন্দ্রনাথের উৎসব প্রবন্ধের কথা মনে করিয়ে দেয়! রবন্দ্রিনাথ লিখেছিলেন: “উৎসবের দিন সৌন্দর্যের দিন। এই দিনকে আমরা ফুলপাতার দ্বারা সাজাই, দ্বীপমালা দ্বারা উজ্জ্বল করি, সঙ্গীতের দ্বারা মধুর করিয়া তুলি। এইরূপ মনের দ্বারা, প্রাচুর্যের দ্বারা, সৌন্দর্যের দ্বারা আমরা উৎসবের দিনকে বৎসরের সাধারণ দিনগুলোর মুকুটমণির স্বরূপ করিয়া তুলি।” উৎসব এভাবে মানবজীবনে বেঁচে থাকার সত্যকে অর্থবহ করে তোলে। আমাদের বাংলা নববর্ষ এভাবে জাতি গোষ্ঠির শেকড় সন্ধানী এক অনুপ্রেরণা।

বৈশাখ এখন আর শুধু ছায়ানটের বর্ষবরণ আর চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রায় সীমাবদ্ধ নেই। বৈশাখ মানেই বর্ণিল আনন্দ। ছোটদের হৈ-হুল্লোর, জয়ধ্বনি। বৈশাখ মানেই তরুণীদের হাতভর্তি রেশমী চুড়ি, খোঁপায় গোঁজা রঙিন ফুল, দেশীয় ঐতিহ্যের নতুন পোশাক, গ্রামীণ মেলা, নাগরদোলা, হাওয়াই মিঠাই, মুখোশ, পুতুল নাচ, হালখাতা, রাজপথে আল্পনা আরও কত কী! চারদিকেই রঙের ছড়াছড়ি।

 
বৈশাখে বড়দের চেয়ে ছোটদের আনন্দই বেশি। বৈশাখী মেলায় ঘুরে বেড়ানো, নাগরদোলায় চড়া, হাওয়াই মিঠাই খেতে খেতে এটা-ওটা কেনা। বৈশাখে দেশের নানা অঞ্চলে নানা অনুষ্ঠান হয়। সিলেটের গ্রাম ও চা-বাগান এলাকায় হয় মোরগের লড়াই, পার্বত্য অঞ্চলে হয় বৈশাবী উৎসব, দক্ষিণাঞ্চলে হয় নীলনৃত্য বা অষ্টক গানের উৎসব, রাজশাহীতে হয় লাঠিখেলা, গম্ভীরা গান। চট্টগ্রামে বলী খেলা। হাওর অঞ্চলে হয় ঢপযাত্রা। এক কথায় মজার আনন্দে ভরপুর আমাদের নববর্ষ। 


পয়লা বৈশাখ আমরা ঐতিহ্যগতভাবে পালন করি। ভ্রাতৃত্ব, সৌহার্দ্যরে দিন হিসেবে এদিনটি একেবারেই ‘মৃত্তিকাজাত’। ছোটবেলায় দেখেছি এই দিনে শুভ হালখাতার আয়োজন করতেন ব্যবসায়ীরা। হালখাতায় ব্যবসায়ীদের পাওনা শোধ করে দেওয়া হতো। ওই দিনে দেখতাম দেশি খাবার, রসগোল্লা, বুন্দিয়া, লুচি, নিমকি, মুড়ি-মুড়কি পেটপুরে খাওয়ানো হতো। এখন হালখাতার উৎসব আগের মতো হয় না। পয়লা বৈশাখের আগের দিন দেখতাম গ্রামে চৈত্র সংক্রান্তির মেলাও বসত। তেমনি নববর্ষের দিনটিতেও দেশব্যাপী হতো মেলা। লোক বিশেষজ্ঞদের মতে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বাংলা নববর্ষকে কেন্দ্র করে অন্তত: ৭/৮ হাজার মেলার বিবরণ পাওয়া যায়। এসব মেলায় দিকদিগন্ত উদ্বেল হয়ে উঠত। এখনও মনে আছে আমাদের গ্রাম নাছিরপুরের ছাডের (মাঠ) বান্নির কথা। তেমনি আমায় শৈশব কেটেছে পীরের গাঁওয়ে, সেই হবিগঞ্জের চুনারুঘাটের বান্নির কথা ভুলতে পারিনা। নববর্ষের দিনে একেবারে ভোরে ঘুম থেকে উঠে যেতাম। ভাগ্নে-ভাগ্নিরা ছিল আমার ছেলেবেলার সাথী। সেফুল, কুকুল, মুকুল, ইলিয়াস, ইকবাল, কামাল, তোজাম্মেল, সবাই আমরা আনন্দে মেতে উঠতাম। বড়রা বিশেষ করে সেফুলের দাদা আমাদের সবাইকে ওইদিন ডেকে ডেকে চার আনা, আট আনা, এক টাকা করে দিতেন। নতুন পোশাক পরে চুনারুঘাটের বান্নিতে (মেলা) গিয়ে পছন্দের জিনিষ কিনে আনতাম। আমরা কিনতাম নানা রকমের মিষ্টি, আম কাটার চাকু, মোহন বাঁশী, ঢোল, পুতুল, সে যে কী আনন্দ! মাঠ জুড়ে বৈশাখী মেলায় কত সামগ্রীই না দেখা যেত! ভাজা জিলাপীর গন্ধে গোটা মেলার বাতাস মৌ মৌ করত। ওই সময় আম কুড়াতে খুব ভালো লাগতো। আমরা কাঁচা আম কুড়াতাম এবং মেলা থেকে কেনা চাকু দিয়ে কেটে কেটে খেতাম। ছেলেবেলার সেই স্মৃতি বড়ই মধুর। প্রতিমা ব্যানার্জীর উদাস করা সেই গানÑ“আমি মেলা থেকে তালপাতার এক বাঁশি কিনে এনেছি। বাঁশি কই আগের মতো বাজে না, মন আমার তেমন কেন সাজে না, তবে কি ছেলেবেলা অনেক দূরে ফেলে এসেছি।” সত্যিই কোথায় যেনো হারিয়ে গেছে সেই ছেলেবেলা।

 এখনকার পয়লা বৈশাখ নগরে ভিন্নরূপ ধারণ করেছে। গ্রামের সেই তরতাজা আমেজ নেই। তবে জৌলুস বেড়েছে। আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। এর সঙ্গে নতুন করে যোগ হয়েছে পান্তা-ইলিশ। প্রকৃতপক্ষে এই পান্তা-ইলিশ পয়লা বৈশাখের সাংস্কৃতি কোনো কালেই ছিল না। এই কালচার নববর্ষের কোনো কালচার নয়। গরীব মানুষের খাবার পান্তা ভাত। গ্রাম বাংলায় রাতে খাওয়ার পর অবিশিষ্ট ভাত রাখার কোনো ব্যবস্থা ছিল না; তাই পানি দিয়ে রাখা হতো এবং সকালে আলু ভর্তা, পোড়া শুকনো মরিচ ও পেঁয়াজ দিয়ে খাওয়া হতো। ছোটবেলায় আমরাও খেয়েছি। কিন্তু এখন পান্তা-ইলিশ ধনী লোকের বিলাসিতায় পরিণত হয়েছে। এর মাধ্যমে আমাদের সংস্কৃতিকে সম্মান দেখানোর পরিবর্তে ব্যঙ্গ করা হচ্ছে।

নববর্ষ পৃথিবীর নানা দেশে নানাভাবে পালিত হয়। পৃথিবীতে নববর্ষের উৎসব চার হাজার বছরের পুরনো উৎসব। আমাদের দেশে ১৫৮৫ খ্রিস্টাব্দের ১০ মার্চ মোঘল সম্রাট আকবরের ফরমান অনুযায়ী আমির ফতেউল্লাহ সিরাজী উদ্ভাবিত বাংলা ফসলি সাল নববর্ষ চালু হয়। ১০ মার্চ থেকেই (১ বৈশাখ ছিল) তখন সাল গননা হতো।

ফতেউল্লাহ খান সিরাজী প্রায় চারশ বছর আগে হিজরী সনের সঙ্গে মিল রেখে ফসলি সন হিসেবে বাংলা সন বা বঙ্গাব্দের প্রচলন করেন। শস্য ভিত্তিক ঋতুকে সামনে রেখে কৃষকের কাছ থেকে খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে প্রচলন করা হয়েছিল বাংলা সনের। তখনই বঙ্গাব্দের সূচনা হয় বৈশাখের প্রথম দিন থেকে। এরসঙ্গে যতই উৎসব আনুষ্ঠানিকতা থাক, মূলে ছিল অর্থনীতি। সেই থেকে আজ পর্যন্ত তা এই জনপদের মানুষের গর্বিত ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃত। বৈশাখী উৎসব তাই সংস্কৃতির অন্যতম সমৃদ্ধ এক উপাদানে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের বাইরেও এখন পয়লা বৈশাখে বাঙালির নববর্ষ হিসেবে পালিত হয়। বাংলাদেশে বাংলা নববর্ষ বাংলা একাডেমির সুপারিশকৃত পঞ্জিকা অনুসরণ করে উদযাপন করা হয়। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এ পঞ্চিকার সুপারিশ করেন বলে একে শহীদুল্লাহ পঞ্জিকাও বলা হয়।

এসেছে নতুন বছর। নতুন বছরের কাছে মানুষের প্রত্যাশা- শোনাও নতুন গান। ‘ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা’ পুড়িয়ে ফেলে, হতাশা-অবসাদ-ক্লেদ ঝেড়ে-মুছে ফেলে নতুন উদ্দীপনায় জাগরণের আহ্বান নিয়ে আসুক বৈশাখ। প্রতিহিংসা, ক্ষুদ্রতা, কলুষতা, কুসংস্কার এবং পশ্চাৎপদতার নিগড় ভেঙ্গে ফেলে, অসুন্দরকে হটিয়ে সমাজ মুক্ত হোক, প্রগতির আলোয় স্নিগ্ধ প্রশান্ত হোক, সমাজ- এ আহ্বান নিয়ে আসুক বৈশাখ। নতুন বছর দেশে পরিবর্তন নিয়ে আসুক। ‘যাক পুরাতন স্মৃতি, যাঁক ভুলে যাওয়া গীতি। অশ্রুবাষ্প সদূরে মিলাক- এসো হে বৈশাখ।’

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবকে সাধারণ সম্পাদক