ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৪ ১৪৩০

‘কর্মমুখী শিক্ষায় বরাদ্দ বাড়াতে হবে’

প্রকাশিত : ১১:০৭ পিএম, ১৫ এপ্রিল ২০১৮ রবিবার | আপডেট: ০৮:০৪ এএম, ১৬ এপ্রিল ২০১৮ সোমবার

পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব। উৎসবকে ঘিরে পোশাকাদি ও খাদ্য দ্রব্যসহ বিভিন্ন পণ্যের চাহিদা বাড়ে দেশে। চাহিদা অনুযায়ী এসব পণ্যের উৎপাদন বাড়ে বহুগুণে। আবার সেগুলো বিপণী-বিতানে ক্রয়-বিক্রয়ে চলে বিশাল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। যা দিন দিনি বাড়ছে। বৈশাখকে কেন্দ্র করে এ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড  এবং আসন্ন বাজেটের নানা দিক নিয়ে একুশে টেলিভিশনের মুখোমুখি হয়েছেন অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। তিনি বলেন, প্রতি বছরের বৈশাখে পণ্যের চাহিদা বেশি থাকায় দাম বেড়ে যায়। কিন্তু এবার দেখা গেছে দাম তেমন বাড়েনি। তার মানে হচ্ছে চাহিদা যে পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে, সরবরাহও একই মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। সুতরাং এটা দেশের সার্বিক অর্থনীতির জন্যে একটা ইতিবাচক দিক।

একুশে টেলিভিশন: বৈশাখ কেন্দ্রীক অর্থনীতি সম্পর্কে আপনার কাছে জানতে চাই।

মির্জ্জা আজিজুল: বৈশাখ বাঙালি সংস্কৃতির একটা অপরিহার্য অঙ্গ। এই আনন্দমুখর উৎসবকে কেন্দ্র করে অনেক অর্থনৈতিক কর্মকানণ্ড পরিচালিত হয়। অনেক পোশাকাদি ও খাদ্য দ্রব্যের চাহিদা সৃষ্টি হয়। যার বেশিরভাগ দেশেই উৎপাদন হয়। এ সময় চাহিদা বেশি থাকায় দাম বেড়ে যায় এসব পণ্যের। কিন্তু এবার দেখা গেছে দাম তেমন বাড়েনি। তার মানে হচ্ছে চাহিদা যে পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে, সরবরাহ ও একই মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। সুতরাং এটা দেশের সার্বিক অর্থনীতির জন্যে একটা ইতিবাচক দিক।

তবে নির্দিষ্ট এ উৎসবকে ঘিরে চাহিদা, সরবরাহ ও দামের উঠা-নামা সম্পর্কে সঠিক কোন হিসেবে নেই। আমাদের দেশে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুারো (বিবিএস) এসব হিসেবে করে। এখন সময় এসেছে উৎসবকে ঘিরে এ হিসেব প্রণয়ন করা।

একুশে টেলিভিশন: প্রবৃদ্ধি সম্পর্কে সরকারের পূর্বাভাস ৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ, বিশ্বব্যাংক বলছে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ আর এডিবি বলছে ৭ শতাংশ। সার্বিক দিকে আপনার মতামত কী?

মির্জ্জা আজিজুল:  ৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি যে হিসেব সরকার করেছে, এটা আমার বিবেচনায় কিছুটা প্রশ্নবিদ্ধ। বিশ্বব্যাংক এবং এডিবির প্রতিবেদন প্রকাশ পাওয়ার আগেই আমি বিভিন্ন মিডিয়াতে বলেছি যে ৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ প্রশ্নবিদ্ধ।

এর পেছনে আমার কয়েকটি যুক্তি আছে। প্রথম হচ্ছে, খুব সাধারণভাবে একটি দেশের উৎপাদনের হিসেবের পন্থা হচ্ছে যে ওই দেশের (ইনক্রিমেন্টাল ক্যাপিটাল আউটপুট) অর্থাৎ এক শতাংশ  জিডিপি গ্রোথের জন্য আমার ইনভেস্টমেন্ট জিডিপি  রেশিও কতটুকু হওয়া দরকার। এটাই মোটামুটি একরেট হিসেবে। তো আমাদের  দেশে গত চার বছরের যদি গড় হার দেখি, তাহলে দেখা যায় ১ শতাংশ জিডিপি গ্রোথের জন্য ৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ জিডিপির আনুপাত হিসেবে বিনিয়োগ প্রয়োজন। তো সে হিসেবে ৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ যদি আমরা জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে চাই, তবে তার জন্য আমাদের প্রায় ৩৪ শতাংশের উপর জিডিপির আনুপাত হিসেবে বিনিয়োগ হওয়া উচিত। সরকারি হিসেবে গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বিনিয়োগ ছিল ৩১ শতাংশের একটু উপরে। এছাড়া অতীতের যে  ইতিহাস তাতে কোন বছরে ১ শতাংশের উপর জিডিপির প্রবৃদ্ধি হয়নি। তো ৩১ শতাংশ থেকে ৩২ বা সাড়ে ৩২ শতাংশ হতে পারে। ৩৪ শতাংশ তো হতে পারে না।

এছাড়া আমদানি-রফতানিও একটি যুক্তি। গত বছর রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ২ শতাংশ ছিল। এ বছরের জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত ৬ দশমিক ৩ শতাংশ। কিন্তু গতবারেও জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত যে প্রবৃদ্ধি ছিল বছর শেষে অর্ধেকে নেমে এসেছিল। কাজেই এ বছরও ১ দশমিক ৭২ এর খুব বেশি হবে তা আশা করা যায় না। রফতানি  উল্লেখ যোগ্য হারে না বাড়লেও আমদানি কিন্তু ২৬ শতাংশ বেড়েছে। এর সাথে সাথে গত অর্থবছরেরে জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি কারেন্ট একাউন্টে ছিল ৯৬৩ মিলিয়ন ডলার। চলতি বছরের একই সমেয় ৬ হাজার ৩১৮ মিলিয়ন ডলার। সুতরাং প্রায় ৬ হাজার মিলিয়ন ডলার বেড়েছে। এ চিত্রও প্রবৃদ্ধি এতো হওয়ার ক্ষেত্রে সমর্থন দিচ্ছে না।

তবে একটা সূচক বেশ ইতিবাচক। যদিও সেটাতেও প্রশ্ন আছে। সেটা হলো গত চারবছর ধরে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ বাড়ছে। চলতি অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ১৮ শতাংশ।  গত চারমাস ধরে এটা বাড়ছে। কিন্তু এখানেও প্রশ্ন আছে যে এ ঋণ কোথায় ব্যবহার করা হচ্ছে।

একুশে টেলিভিশন: আগামী বাজেটকে ঘিরে আমাদের প্রত্যাশা এবং বাস্তবায়ন কীভাবে দেখছেন?

মির্জ্জা আজিজুল: এ সম্পর্কে কথা বলার আগে আমি আমাদের ট্যাক্স রেভিনিউ কালেকশন সম্পর্কে কিছু বলতে চাই। এটা প্রত্যাশা করা যায় যে একটি দেশের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে প্রবৃদ্ধি আসলে কর আদায় বাড়ে। এনবিআর যে গত একবছরে যথেষ্ট স্বক্রিয় ছিল এটা বলা যায়। তবে এনবিআরের চেষ্টা সত্ত্বেও চলতি বছরের জুলাই থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত ট্যাক্স রেভিনিউ কালেকশন বেড়েছে ১৫ দশমিক ৩ শতাংশ। গত বছরের একই সময়ে বেড়েছিল প্রায় ১৯ দশমিক ৩৮ শতাংশ। তার মানে প্রায় সাড়ে ৪ শতাংশ নিচে আছে। এটাও ৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধিকে সমর্থন করছে না।

বাজেটের বাস্তব চিত্র যদি আমি দেখি তবে ২০১২ সাল থেকে ২০১৫-১৬ সাল পর্যন্ত প্রতি বছরেই বাস্তবায়নের হার কমেছে। বাজেট আর্থিকভাবে বাস্তবায়নে ২০১২ সালে ছিল ৯৩ শতাংশ। প্রত্যেক বছর কমতে কমতে এটা নেমে এসেছে ৭২ শতাংশে।  এ বছরও এখনও পর্যন্ত যে  ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে না যে এ ৭২ শতাংশের খুব একটা উপরে আমরা উঠতে পারবো।

একুশে টেলিভিশন: বাস্তবায়নে অগ্রগতি আনার জন্য করণীয় কী হতে পারে বলে আপনি মনে করেন?   

মির্জ্জা আজিজুল: বাজেট প্রণয়নের আগে বাস্তবায়নের বিষয়টা ভেবে নিতে হবে। বাজেট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রণোদনা কোন ইতিবাচক ভূমিকা রাখে না। প্রণোদনার ক্ষেত্রে জবাবদিহিতা ও স্বচ্চতা আনতে হবে। যারা  ভালো করছেন ঠিক তাদেরই পুরস্কৃত করতে হবে। খারাপ করলে তিরস্কৃত করতে হবে।

একুশে টেলিভিশন: বাজেটে আপনার কোন প্রত্যাশা বা যোগ করার কিছু আছে কী না ?

মির্জ্জা আজিজুল: প্রথম প্রত্যাশা বাজেটটা বস্তুনিষ্ঠ ভাবে প্রণয়ন করা হোক। দ্বিতীয়ত আমাদের দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা এখনও অনেক। এদের ক্ষেত্রে সামাজিক নিরাপত্তায় বরাদ্দ বাড়াতে হবে। আমাদের দেশে বড় শক্তি হচ্ছে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট। সেজন্য কর্মমুখী শিক্ষাকে কিভাবে গুরুত্ব দেওয়া যায় সে জন্য বাজেটে বরাদ্দ থাকতে হবে। এছাড়া মানুষে দুটি হাত যেন কাজে লাগাতে পারে সে জন্য সুস্থ্য থাকা দরকার। আর তার জন্য দরকার স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ। 

অনুলিখন: রিজাউল করিম

টিকে