ঢাকা, শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ৬ ১৪৩১

সাক্ষাৎকারে আলী হায়দার চৌধুরী

আমিরাতের শ্রমবাজার সিন্ডিকেটে যেন হারিয়ে না যায়

প্রকাশিত : ০৬:৩৬ পিএম, ২৩ এপ্রিল ২০১৮ সোমবার | আপডেট: ০৪:৫১ পিএম, ২৪ এপ্রিল ২০১৮ মঙ্গলবার

দীর্ঘদিন ধরে আরব আমিরাতে বাংলাদেশের শ্রমবাজার বন্ধ ছিল। আশার কথা হচ্ছে ছয়বছর ফের বাংলাদেশ থেকে শ্রমশক্তি নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে আমিরাত। সিন্ডিকেট কিংবা অন্য কোনো কারণে যেন মালয়েশিয়ার মত পরিস্থিতি আমিরাতে না হয়। সেদিকে মন্ত্রণালয় এবং সরকারকে আরও বেশি নজরদারি বাড়াতে হবে। মধ্যপ্রাচ্যে নতুন শ্রমবাজার নিয়ে এক সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সি-বায়রার সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট আলী হায়দার চৌধুরী বাবলু

একুশে টেলিভিশন: অনেক দিন পরে আরব আমিরাতে কাজের সুযোগ তৈরি হয়েছে এটা আমাদের সকলের জন্য বিশেষ সুখবর। এ ব্যাপারে আপনার অভিমত কি?

আলী হায়দার চৌধুরীঃ আরব আমিরাতে কাজের সুযোগ সৃষ্টির জন্য প্রথমে আমি ধন্যবাদ জানাতে চাই আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। একই সঙ্গে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সবাইকে।  আরব আমিরাত আমাদের অনেক বড় শ্রম বাজার। আমাদের  শ্রমবাজারে আরব আমিরাত এবং সৌদি আরব হচ্ছে সবচেয়ে  বড় মার্কেট। আমাদের দেশের লোকজন এই দুটি দেশকে কাজের জন্য বেশি পছন্দ করে। দীর্ঘ ছয়বছর এই শ্রমবাজার একেবারেই বন্ধ ছিল। এমইউ স্বাক্ষর হওয়ার পরে মানুষের মনে একটা স্বপ্ন জেগে উঠেছিল। আমাদের এজেন্সিগুলো অনেক দিন ধরেই বসে আছে। লোক পাঠাতে পারছিল না। নিঃসন্দেহে এটি একটি খুশির সংবাদ আমাদের সবার জন্য।

একুশে টেলিভিশনঃ এর আগে মালয়েশিয়ার শ্রম বাজারও বাংলাদেশিদের কাজের নতুন সুযোগ সৃষ্টির কথা ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা আলোর মুখ দেখেনি। আমিরাতের ক্ষেত্রেও এই শঙ্কা থেকে যায় কি না?

আলী হায়দার চৌধুরীঃ  গত ছয় থেকে সাত মাস ধরে একটা গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল যে, শেষ পর্যন্ত মালয়েশিয়ার মত আমিরাতের মার্কেট না জানি সিন্ডিকেটের আওতায় চলে যায়। মালেশিয়ায় যারা এই সিন্ডিকেটে কাজ করে তারা বুঝি এটাকে গ্রাস করবে। আমি চাই এই গুঞ্জন থেমে যাক, মিথ্যা হোক। আমরা চাই না এই সরকারের আমলে আরেকটা সিন্ডিকেট হোক। সিন্ডিকেটের যে প্রভাব মার্কেটে পরেছে।

বায়রার ১৩শ’ সদস্য। এরা প্রত্যেকে অনেক স্বপ্ন নিয়ে বসে আছে। আমাদের সরকার যেন কোন রকম  সিন্ডিকেটকে প্রশ্রয় না দেয়। মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে কোন রূপ সিন্ডিকেট প্রশ্রয় দেয় না। অর্থনীতির জন্য সিন্ডিকেট কোন গুরুত্ববহন করে না। বরং অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দেয়। এই মালয়েশিয়ার কথা ধরুন, সেখানে এক লাখ যাক আর এক লাখ বিশ হাজার লোক যাক, আজ যদি মার্কেটটা ওপেন থাকতো তাহলে অন্তত দুই তিন লক্ষ লোক সেখানে চলে যেত। প্রত্যেক মানুষের একটা সক্ষমতা রয়েছে। এক মাসে কত লোক ডেপলয় করতে পারি, সেটা যদি সবাই মিলে করতাম তাহলে আরও বেড়ে যেত। এই অংকটুকু আমাদের সরকার এবং আমাদের মন্ত্রণালয়কে বুঝতে হবে। এইভাবে সিন্ডিকেটের আওতায় গেলে সরকার এবং মন্ত্রণালয়েরও সুনাম নষ্ট হবে। গুঞ্জনও শুরু হবে। আমাদের ফেয়ার মাইগ্রেশন নিয়ে, ডিসেন্ট ওয়ার্ক নিয়ে ইথিকাল ইকুপমেন্ট নিয়ে সারাদেশে তুমুল সমালোচনা শুরু হবে।  

একুশে টেলিভিশনঃ যাদের সিন্ডিকেটের কারণে আমরা বাজার হারাতে বসেছি, যেখানে অনেক লোক যেতে পারত, যাদের অর্থে আমাদের রিজার্ভ সমৃদ্ধ হচ্ছে তাদের জন্যে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা কতটুকু সমন্বয় করছে বলে আপনি মনে করেন?

আলী হায়দার চৌধুরীঃ যারা সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত তারা তো দেশের অর্থনীতির কথা চিন্তা করবে না। তারা তাদের উন্নতির কথা চিন্তা করবেন এই জন্য তো সিন্ডিকেট। শ্রম বাজার যদি উন্মুক্ত থাকতো  তাহলে তো সিন্ডিকেট খুব একটা ফ্যাক্টর হতো না। এই সেক্টরে যারা আছেন, বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সি তাদের কথায় চিন্তা করতে হবে। সরকারের এই ক্ষেত্রে পলিসি কি? সেটা ভাবতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারের পলিসি অত্যন্ত পরিস্কার। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন,‘মাইগ্র্যান্ড উইথ ডিগনিটি’। আমাকে মিনিমাম মাইগ্রেশন খরচে যেতে হবে। আমাদের শ্রমিকেরা ভালো মজুরি পাই, তারা যেন ভালো আবাসন সুবিধা পাই, সুচিকিৎসা পাই সেটাই হবে আমাদের সরকারের উদ্দেশ্য । আমাদের সরকারের উদ্দেশ্য  কতিপয় লোককে সুবিধে দেওয়া নয়।

আমাদের সরকারের উদ্দেশ্য হচ্ছে পুরো রাষ্ট্র ব্যবস্থা নিয়ে।সমগ্র রাষ্ট্রের অর্থনীতি নিয়ে। সরকারের যদি নজরদারি থাকে তবে সিন্ডিকেট কিছুই করতে পারবে না। মালয়েশিয়া নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে, অনেক সমালোচনা হয়েছে, আমার মনে হয় সরকারের সুযোগ এসেছে এসব সমালোচনার জবাব দেওয়ার।

একুশে টেলিভিশনঃ বিশটি ক্যাটাগরিতে আরব আমিরাতে লোক যাবে। ন্যূনতম  বেতন কাঠামো কতো হবে? এক্ষেত্রে বাংলাদেশের শ্রমিকরা পার্শ্ববর্তী দেশ নেপাল এবং ভারত থেকে পিছিয়ে পড়ছে কি না?

আলী হায়দার চৌধুরীঃ নেপালের শ্রমবাজার আর আমাদের শ্রমবাজারের মধ্যে অনেক তফাৎ রয়েছে। আমাদের এই বাজার ১৯৭৬ সাল থেকে। নেপাল মাত্র ১০ বছর ধরে কাজ শুরু করেছে। সমঝোতা লেভেল তাদের অনেক ভালো ছিল বিধায় তারা অনেক ভালো করেছে। আমাদের কূটনৈতিক লেভেলটা একেবারেই যে খারাপ তা কিন্তু নয়। আমাদের সরকারের সুন্দর কূটনৈতিক প্রচেষ্টার জন্য সৌদি আরবে শ্রম বাজার স্বল্প পরিসরে চালু হয়েছে। যেখানে দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল। তারা প্রথমে গৃহপরিচায়িকার জন্য লোক চেয়েছে। ১২টা ক্যাটাগরি দিয়ে আমরা সৌদি মার্কেটে ইন করেছি। দুই তিন মাস পরে পর্যায়ক্রমে শ্রমিক যাওয়া শুরু করেছে। আমাদের সচিব মহোদয় বলেছেন, এটা প্রথম পেইজ, পরবর্তীতে দ্বিতীয় পেইজে লোক যাওয়া শুরু করবে।এর মাধ্যমে আমাদের সাকসেস রেইট বাড়বে।  দ্বিতীয় চুক্তিতে আমাদের শ্রমিকেরা কীভাবে বাহিরে যাবে সেক্ষেত্রেও আলোচনা হবে।

একুশে টেলিভিশনঃ অভিবাসন ব্যয় নিয়ে অনেক অভিযোগ রয়েছে । সেটাকে কেন সহনীয় পর্যায়ে আনা যাচ্ছে না। এক্ষেত্রে আপনার অভিমত কি?

আলী হায়দার চৌধুরীঃ অভিবাসন খরচ সহনীয় মাত্রায় আনতে হলে সরকার দূতাবাস, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একসঙ্গে সমন্বয় করতে হবে। তাহলে এই খরচ কমানো যাবে। আইএলও কনভেনশনে আমরা স্বাক্ষর করেছি, অথচ ভারত অনুস্বাক্ষর পর্যন্ত স্বাক্ষর করেনি এই চুক্তিতে। খরচটা কিন্তু ওয়ান ওয়ে ট্রাফিক নয়। বাড়তি যে খরচ সেটা কিন্তু গরীব শ্রমিকের পকেট থেকে যাচ্ছে। এই সেক্টরে একসময় হাই মাইগ্রেশন ছিল। মন্ত্রণালয় থেকে যুক্তিযুক্ত মাইগ্রেশন খরচ নির্ধারণ করা হয়েছিল। যে খরচ নির্ধারণ করা হয়েছে সেটা আধো কতোটুকু হচ্ছে, মনিটরিং হচ্ছে কি না সেটা খেয়াল রাখা উচিত। আইন করে সমাধানে আসা যায় না। আইন বেশি করলে খরচের খাতও বাড়ে। মন্ত্রণালয় যদি নজরদারি বাড়ায় তবে সেটা সমাধানযোগ্য। তাদের আইনগত অধিকার রয়ে গেছে আমাদের উপর নজরদারি বাড়ানোর। আমাদের মাইগ্রেশন খরচ কমানোর।

বায়রার প্রতিটি সদস্য চায় মিনিমাম মাইগ্রেশন খরচ কমানোর। আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে শ্রমবাজারে স্বল্প খরচে বেশি সংখ্যক লোক পাঠানো। বেশি খরচ যুক্ত করে বিদেশে লোক পাঠানো আমাদের জন্যও ঝুঁকিপূর্ণও বটে।

একুশে টেলিভিশনঃ আমাদের শ্রমিকদের অভিযোগ রয়েছে, ভারতের শ্রমিকরা বিপদে পরলে দূতাবাস এবং কোম্পানির থেকে সুবিধে পায়, কিন্তু আমাদের শ্রমিকদের ক্ষেত্রে তার উল্টো চিত্র। এক্ষেত্রে আমরা কি করতে পারি?

আলী হায়দার চৌধুরীঃ দেখুন, সৌদি আরবের কথা যদি ধরেন, সেখানে আমাদের বিশ লক্ষাধিক লোক রয়েছে, কিন্তু তাদের সেবা দেওয়ার জন্য আমাদের দূতাবাসে কতজন লোক আছে? ভারত এবং ফিলিপাইন এই ক্ষেত্রে কমিউনিটি সেবাটা নেয়। তারা সেখানে সোশ্যাল ক্লাব গড়ে তুলেছে। তারা তাদের কমিউনিটিতে বিষয়গুলি আলোচনা করে। যেটা আমাদের লোকজন করে না।বিদেশে শুধু লোক পাঠালে হবে না। তার সুখ-দুঃখের দায়িত্বটাও সরকারকে নিতে হবে। তাদের সমস্যাগুলি সঠিক জায়গায় পৌঁছে দেওয়াটা হচ্ছে আসল কথা। যদি আমরা পাঁচ হাজার শ্রমিক পাঠাই তার মধ্যে পাঁচজনের সমস্যা থাকতেই পারে। আমি এই পাঁচজনের সমস্যা সমাধান  দূর থেকে করতে পারব না। এখানে বসে বিদেশের সমস্যা সমাধান করা যায় না। এক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা নিতে হবে, দূতাবাসের সহযোগিতা নিতে হবে। শাস্তি দিয়ে কাজ আদায় করা যাবে না, সমাধানের পথে হাঁটতে হবে।

একুশে টেলিভিশনঃ আরব আমিরাতের সুখবরটি যেন আমরা ভালোভাবে কাজে লাগাতে পারি, দক্ষ শ্রমিক  যেন পাঠাতে পারি, এক্ষেত্রে সরকারের প্রতি আপনারা যদি কোনো পরামর্শ থাকে সেটা বলতে পারেন?

আলী হায়দার চৌধুরীঃ সরকারের কাছে বিনীত নিবেদন, আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা  হিসেবে জাতির কাছে আমার কিছু দায়বদ্ধতা আছে। যে সমৃদ্ধ অর্থনীতির বাংলাদেশের স্বপ্ন বঙ্গবন্ধু দেখেছিল তার বড় অংশ এই সেক্টর থেকে যেন আসে আমি সেটাই আশা করব।এই বিষয়গুলোর  প্রতি নজরদারি বাড়াতে হবে। শ্রম বাজার নিয়ে  সিন্ডিকেট করলে সরকারের দুর্নাম অবধারিত। তাই সরকারের কাছে বলবো কোন রকম সিন্ডিকেট নয়। সিন্ডিকেট ঠেকাতে পারলে এই খাতে আমাদের দেশ ভালো করবে।

ভিডিও দেখুন...

/ এআর /