ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৫ ১৪৩০

ফেসবুকের সাতকাহন, আছে ইহুদি কানেকশন

মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান

প্রকাশিত : ০৭:৩১ পিএম, ৭ মে ২০১৮ সোমবার | আপডেট: ১০:০৭ পিএম, ৭ মে ২০১৮ সোমবার

হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে যখন ফেসবুকের যাত্রা শুরু হয়, সে সময় হার্ভার্ডের প্রেসিডেন্ট ছিলেন লরেন্স (সংক্ষেপে ল্যারি) সামারস। যিনি একজন ইহুদি রাজনীতিক হিসেবে বেশি খ্যাত। ইহুদি স্বার্থ রক্ষায় তিনি সক্রিয়। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের চিফ ইকোনমিস্ট ছিলেন তিনি। হোয়াইট হাউসে ক্লিনটন এবং ওবামা প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন ল্যারি সামারস।

হার্ভার্ডের প্রেসিডেন্ট থাকার সময় সেখানকার অ-ইহুদি ছাত্র উইনকলেভস জমজ ভ্রাতৃদ্বয় ল্যারি সামারসের কাছে একটি গুরুতর চুরির অভিযোগ নিয়ে আসেন। তারা অভিযোগ করেন, সহপাঠী মার্ক জাকারবার্গ তাদের দুইজনের তৈরি করা সোশ্যাল নেটওয়ার্কের ডিজাইন চুরি করে ফেসবুক প্রতিষ্ঠা করেছেন। এই অভিযোগ শুনে ল্যারি সামারস ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন এবং অভিযোগ ছুঁড়ে ফেলে দেন। তাদের হুমকি দিয়ে রুম থেকে চলে যেতে বলেন। এমনকি ২০ জুলাই ২০১১ সালে সিএনএন টিভি চ্যানেলের মানি প্রোগ্রামের এক সাক্ষাৎকারে ল্যারি সামারস জমজ দুই ভাই সম্পর্কে প্রকাশ্যে ‘অ্যাসহোল’ মন্তব্য করেন, যা ভদ্রতা বিবর্জিত কাজ বলে ধরা হয়। ল্যারি সামারসের এ ধরণের নগ্ন সহযোগিতার কারণে হার্ভার্ডে জাকারবার্গ ও তার সঙ্গী ইহুদি তরুণদের এই কাজে আর কেউ বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে নি।

মার্ক জাকারবার্গ হার্ভার্ডে ফেসবুক প্রজেক্টকে বিস্তৃত করতে প্রথমেই যে বন্ধুর সহযোগিতা চান তিনি হলেন ইহুদি তরুণ ডাস্টিন মোসকোভিচ। যিনি পরে ফেসবুকের ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট হন। ব্রাজিলিয়ান ইহুদি এডুয়ার্ডো স্যাভেরিন ফেসবুকের অন্যতম কো ফাউন্ডার বা সহ-প্রতিষ্ঠাতা যেখানে তিনি শুরুতে বিজনেস ম্যানেজার এবং চিফ ফাইন্যানশিয়াল অফিসার-সিএফও হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। হার্ভার্ডে থাকা অবস্থায় ইহুদি ভ্রাতৃসংঘ আলফা এপসিলন পাই নামের সংগঠনটির সঙ্গে জড়িত ছিলেন মার্ক জাকারবার্গ এবং স্যাভেরিন। তারা ছিলেন এক অপরের ‘বেস্ট ফ্রেন্ড’।

আলফা এপসিলন পাই সংগঠনটি তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানিয়েছে, ‘এটি আন্তর্জাতিক ইহুদি ভ্রাতৃসংঘ। এ সংগঠনটি তৈরি হয়েছে ইহুদি পুরুষদের জন্য সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ করে দেয়া এবং সংঘবদ্ধতার অভিজ্ঞতা অর্জনের লক্ষ্যে। আমরা আমাদের বন্ধন দৃঢ়তার সঙ্গে বজায় রাখি এবং ছাত্রদের হাই স্কুল থেকে ক্যারিয়ার পর্যন্ত সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিই।’

ইসরায়েলে আলফা এপসিলন পাই সংগঠনটির এক দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। ইসরায়েলের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক উন্নয়নে কাজ করে এই সংগঠন। তারা সমাজসেবার পরিচয়ে সরাসরি অর্থ সাহায্য করে ‘ফ্রেন্ডস অফ দি ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্স’ এবং ইহুদি ন্যাশনাল ফান্ডে। ফেসবুকের প্রথম ব্যবহারকারী হিসাবে পরিচয় দেন মার্ক জাকারবার্গের হার্ভার্ডের সহপাঠী ও রুমমেট অ্যারিয়াল হাসিট। যিনি ফেসবুকের ইউআরএল আইডি সেভেন ধারণ করেন। তিনি এক সময় অধিকৃত প্যালেস্টাইনে বসবাস শুরু করেন ইহুদি ‘ল অফ রিটার্ন’ থিওরি অনুসারে। তিনি সেখানে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর সঙ্গে কাজ শুরু করেন। পরবর্তীতে ইসরায়েলের ডিফেন্স ফোর্সের প্রচারণা সেলের স্পোকসপারসন ইউনিটে কাজ শুরু করেন। সম্প্রতি তিনি ইহুদি ধর্মযাজক বা রেবাই হিসাবে শপথ গ্রহণ করেছেন। তার সম্পর্কে ইসরায়েলের প্রভাবশালী পত্রিকা হারেটজ ১০ মে ২০০৯ সালে এক প্রতিবেদনে জানায়, ‘পাঁচ বছর আগেও কেউ ফেসবুকের নাম জানতো না। এখন ইসরায়েল বা পৃথিবীর কোথাও কারো জানতে বাকি নেই এই সামাজিক যোগযোগ ওয়েবসাইট সম্পর্কে।.. তিনি এবং জাকারবার্গ একই ইহুদি সংগঠনে কাজ করেন।’

একই প্রতিবেদনে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে অ্যারিয়াল হাসিট বলেন, ‘২০০২ সালে আমি মার্ক জাকারবার্গের সঙ্গে পরিচিত হই। আমরা একই ফ্র্যাটারনিটি বা ভ্রাতৃসংঘে যোগ দিই। যা ইহুদি কমিউনিটির কল্যাণে কাজ করে। হাসিট আরো বলেন, ‘আমরা সাবাথ ডিনার (ইহুদি ধর্মীয় খাবার আয়োজন) এক সঙ্গে খেয়েছি। প্রতি বছর আমরা ইসরায়েলের চ্যারিটির জন্য অর্থ সংগ্রহ করেছি। মার্ক জাকারবার্গ হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে পড়া অন্যান্য ইহুদি ছাত্রদের মতো এই সংগঠনের সদস্য ছিল। মার্ক জাকারবার্গ নিয়মিত ইয়ম কিপার এ উপবাস করতো। মাঝে মাঝে হিলেল হাউসে আসতো যা বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ইহুদি কমিউনিটিতে পরিচিত ছিল।’

মার্ক জাকারবার্গ ‘ইহুদিবাদ’ সম্পর্কে ‘আন্তরিক যোগসূত্র’ অনুভব করেন। ইসরায়েলের চ্যারিটির জন্য তিনি নিয়মিত দান এবং অর্থ সংগ্রহ করেন। ফেসবুকের সূচনা সময়ে এই ইহুদি তরুণদের আর্থিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন আরেক ইহুদি, জার্মানিতে জন্ম নেয়া আমেরিকার প্রভাবশালী প্রযুক্তি উদ্যোক্তা পিটার থিয়েল। যিনি অনলাইনে অর্থ লেনদেনের বিশাল প্ল্যাটফরম পেপল-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। ইহুদিদের প্রথাগত ঐতিহ্য অনুসারে পিটার থিয়েল তার সব ব্যবসা শুধু ইহুদিদের সঙ্গেই করতে পছন্দ করেন। ১৪ জানুয়ারি ২০০৮ সালে প্রভাবশালী বৃটিশ দৈনিক দি গার্ডিয়ান প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে ফেসবুকের নেপথ্য নায়কদের প্রসঙ্গ তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদনে পিটার থিয়েল সম্পর্কে মন্তব্য করা হয়, ‘ফেসবুকের পেছনের আসল মুখটি হলেন ৪০ বছর বয়সী সিলিকন ভ্যালির ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট (বিনিয়োগকারী) ফিউচারিস্ট দার্শনিক পিটার থিয়েল।’

২০০৪ সালের জুন মাসে যখন তিন ইহুদি ছাত্র মার্ক জাকারবার্গ, ডাস্টিন মোসকোভিচ ও ক্রিস হিউজেস তার সঙ্গে ফেসবুকের আইডিয়া নিয়ে দেখা করতে যান তখন তিনি পাঁচ লাখ ডলার বিনিয়োগ করেন। যা দিয়ে ফেসবুকের যাত্রা শুরু হয়। পিটার থিয়েলকে ইন্টারনেট জগতে ‘স্যাভি ইনভেস্টর’ বা বৈষয়িক বুদ্ধিসম্পন্ন বিনিয়োগকারী হিসাবে বলা হয়। পেপলের পর ফেসবুকের সূচনা সময়ে তার পাঁচ লাখ ডলার বিনিয়োগকে ‘গোল্ডেন টাচ’ হিসাবে বর্ণনা করা হয়।

ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাকালীন পরিচালনা বোর্ডে ছিলেন তিন ইহুদি পিটার থিয়েল, মার্ক জাকারবার্গ এবং জিম ব্রেয়ার। ইহুদি উদ্যোক্তা জিম ব্রেয়ার একজন ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট হিসাবে সিলিকন ভ্যালিতে পরিচিত। ২০০৫ সালে তিনি ফেসবুকে ১২.৭ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেন। তিনি ডেল,ওয়ালমার্ট, মারভেলসহ বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা বোর্ডের সদস্য। ২০০৯ সালে ফেসবুকে ২০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেন ইহুদি-রাশান বিলিওনেয়ার ইউরি মিলনার। টুইটারেও তার বিনিয়োগ আছে।
নিউজউইক ও ওয়াশিংটন পোস্ট পরিচালনাকারী ইহুদি পরিবার মেয়ার গ্রাহামের সদস্য ডোনাল্ড ই গ্রহাম ফেসবুকের পরিচালনা বোর্ডের অন্যতম সদস্য।

ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাকালীন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের মধ্যে মার্ক অ্যানড্রেসেন হলেন নেটসক্যাপের প্রতিষ্ঠাতা। ইসরায়েলের প্রভাবশালী ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট জোনাথান মেডভেড-এর সঙ্গে ইসরায়েল সিড পার্টনারস-এ বিনিয়োগ করেন। তিনি নিজে ইহুদি না হলেও ইহুদি মালিকানাধীন ব্যবসায় তিনি তার সব বিনিয়োগ করেন।
ফেসবুকের গুরুত্বপর্ণ সদস্যদের মধ্যে আছেন চিফ অপারেটিং অফিসার শেরিল স্যান্ডবার্গ। এই ইহুদি নারী ২০০৮ সালে গুগল ছেড়ে ফেসবুকে যোগ দেন। বিশ্বজুড়ে ফেসবুকের বিস্তার, মার্কেটিং, সেলস, বিজনেস ডেভেলপমেন্ট, হিউম্যান রিসোর্স, পাবলিক পলিসি, প্রাইভেসি এবং কমিউনিকেশনের সকল বিষয় তিনি দেখেন। শেরিল সরাসরি রিপোর্ট করেন মার্ক জাকারবার্গকে। শেরিল গুগলে যোগ দেয়ার আগে ছিলেন ইহুদি ইকোনমিস্ট ও হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির সাবেক প্রেসিডেন্ট ল্যারি সামারসের সহকর্মী। যিনি ফেসবুক প্রতিষ্ঠার সময়ে জাকারবার্গকে সহায়তা করেন। পরবর্তীতে তিনি ক্লিনটন প্রশাসনের ট্রেজারি সেক্রেটারি হলে শেরিল স্যান্ডবার্গ হন তার চিফ অফ স্টাফ।
ল্যারি সামারসের আরেক ইহুদি নারী সহকর্মী মারলে লেভিন। তিনি বারাক ওবামার সময়ে ল্যারির সরাসরি তত্ত্বাবধানে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক উন্নয়নে সমন্বয়ের কাজ করতেন। মারলে লেভিন তার ক্যারিয়ার শুরু করেন ডিপার্টমেন্ট অফ ট্রেজারিতে ক্লিনটন প্রশাসনের অধীনে। যেখানে তিনি আইন প্রণয়ন ও জনসংযোগ বিভাগে কর্মরত ছিলেন। তার শ্বশুর জন ডাচ ছিলেন সিআইএ-র সাবেক পরিচালক। তার স্বামী ইহুদি ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট ফিলিপ ডাচ। ফলে তার পক্ষে সিআইএর সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা সহজ হয়। ২০১০ সালে ফেসবুকের গ্লোবাল পাবলিক পলিসির ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট হন মারলে লেভিন। বিশে^র বিভিন্ন দেশের বিশেষ করে আমেরিকা, এশিয়া, ইওরোপের দেশগুলোর সরকার ও এনজিওগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি করে ফেসবুকের ব্যবসার ক্ষেত্র বাড়ানোর দায়িত্ব তাকে দেয়া হয়। মারলে লেভিন আমেরিকার পলিটিক্যাল সেন্টারের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত।

অনেকগুলো ইহুদি ওয়েবসাইট মার্ক জাকারবার্গকে তার ধর্ম ও বিধিবিধান মেনে চলার কারণে ‘১০০% ইহুদি’ বা শতভাগ ইহুদি হিসাবে বর্ণনা করেছে। ওয়ার্ল্ড ইহুদি ডাইজেস্ট-এর বর্ণনায় ‘ইহুদি- আমেরিকান পরিবারে জন্ম নেয়া’ জাকারবার্গ শীর্ষ দশ প্রভাবশালী ইহুদির তালিকায় তিন নাম্বারে জায়গা করে নেন। তবে বর্তমানে জেরুসালেম পোস্টের বিবেচনায় তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে প্রভাবশালী ইহুদির তালিকায় এক নাম্বারে আছেন।

১৩ মে ২০০৯ সালে দি নিউ ইয়র্ক টাইমস এক রিপোর্টে ইসরায়েলি পত্রিকা হারেটজের সূত্র উল্লেখ করে জানায়, ‘হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির সাবেক ইহুদি ছাত্র মার্ক জাকারবার্গ ফেসবুক প্রতিষ্ঠা করেন।’কয়েক বছর আগে ফেসবুকের মুখপাত্র স্কনিট এবিসি চ্যানেলের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, ‘আমাদের অনেকেই ফেসবুকে আছেন যারা সরাসরি হলোকস্টের ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত। এদের বাবা-মায়েরা ইওরোপ থেকে চলে আসতে বাধ্য হন। অথবা সেটা যারা করতে পারেন নি, তাদের আত্মীয় স্বজন এখানে আছেন।’

ইসরায়েল কানেকশন:

ফেসবুক শুধু ইহুদি নিয়ন্ত্রিত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম-ই নয়, ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলের সঙ্গে ফেসবুকের সরাসরি সংযুক্তি রয়েছে শুরু থেকেই। মার্ক জাকারবার্গকে ইসরায়েলি সরকার সব সময়ই গুরুত্ব দিয়ে এসেছে। ২০০৮ সালে জেরুসালেম কনফারেন্সে টেকনোলজির ওপর প্রেসিডেন্টশিয়াল প্যানেলে গুগলের সের্গেই ব্রিন এবং ইয়াহুর প্রেসিডেন্ট সুসান ডেকার-এর সঙ্গে জাকারবার্গ উপস্থিত ছিলেন। ইসরায়েলের ৬০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ১৩ থেকে ১৫ মে ২০০৮ সালে জেরুসালেম ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সেন্টারে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ইসরায়েলের সে সময়ের প্রেসিডেন্ট শিমন পেরেজের উদ্যোগে এই সম্মেলনে অন্যতম আলোচনার বিষয় ছিল, বর্তমান ও আগামীর জন্য টেকনোলজিকে কীভাবে মোকাবেলা করতে হবে, বিশেষ করে ইসরায়েল ও ইহুদি বিশ্বে এটা কতটা প্রভাব ফেলবে।

এই অনুষ্ঠানে ইহুদি ধর্মীয় নেতা, উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদসহ ইহুদী স্বার্থে কট্টরবাদী হিসাবে পরিচিত জায়ানিস্ট নেতাদের সঙ্গেও মতবিনিময় করেন মার্ক জাকারবার্গ। ১১ মার্চ ২০০৮ সালে নিক ওনিয়েল লেখেন, সম্প্রতি প্রেসিডেন্ট শিমন পেরেস ইসরায়েলি ও বিশ্বব্যাপী ইহুদিদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন যে, অ্যান্টি সেমিটিজম প্রতিরোধ যুদ্ধে সবাই যেন ফেসবুক ব্যবহার করেন।

২০১২ সালের মার্চে আমেরিকায় ফেসবুকের হেড কোয়াটার্স পরিদর্শন করেন শিমন পেরেস। এ সময় তার অফিশিয়াল ফেসবুক পেজ খুলে প্রথম ‘লাইক’ দেন মার্ক জাকারবার্গ নিজে। এ বিষয়ে ইসরায়েলি দৈনিক হারটেজ লেখে, মার্ক জাকারবার্গ পেসিডেন্টের ইন্টারন্যাশনাল পেজ উন্মুক্ত করেছেন। এই অনুষ্ঠানে ফেসবুকের অ্যাডভার্টাইজিং অ্যান্ড গ্লোবাল অপারেশনসের ভাইস প্রেসিডেন্ট ডেভিড ফিশার বলেন, ‘আমাদের সময়ের মহান নেতা ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট শিমন পেরেসকে স্বাগত জানাচ্ছি।’ এসময় ফেসবুকের চিফ অপারেটিং অফিসার শেরিল স্যান্ডবার্গ তার পাশে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন।

৪ ফেব্রুয়ারি ২০১১ সালে ইসরেয়েলি ওয়াইনেট নিউজ জানায়, ইসরায়েল ফেসবুকের মাধ্যমে দেশটির পক্ষে প্রচারণার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়, ইসরায়েলের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেনিয়েল অ্যালন আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ায় ফেসবুক অফিসে বেশ কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তার সঙ্গে অনলাইনে জনসংযোগ বাড়াতে ফেসবুকের ব্যবহার ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে আলাপ করেন। সেখানে ইসরায়েলি সরকারের ভাবনা তুলে ধরে উপমন্ত্রী বলেন, ইসরায়েলের অনলাইন পিআর বা জনসংযোগের প্রধান প্ল্যাটফরম হিসাবে ফেসবুককে ব্যবহার করা হবে। তিনি সেখানে ফেসবুকের চিফ অপারেটিং অফিসার শেরিল স্যান্ডবার্গ ও ভাইস প্রেসিডেন্ট ডেভিড ফিশারের সঙ্গে দীর্ঘ সময় মিটিং করেন।

ডেভিড ফিশারের বাবা স্ট্যানলি ফিশার ইসরায়েলের কেন্দ্রীয় ব্যাংক অফ ইসরায়েলের গভর্নর ছিলেন। বৈঠকে ইসরায়েলের উপ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেনিয়েল অ্যালন বলেন, ইংরেজি ও আরবি দুই ভাষাতেই ইসরায়েলের মেইন প্ল্যাটফরম হিসাবে ফেসবুক ব্যবহৃত হবে। ইসরায়েলের প্রতিটি দূতাবাসে ফেসবুক পেজ আছে। সেগুলোকে আরো উন্নত করে দেশের ভাবমূর্তি বৃদ্ধি করার ওপর তিনি জোর দেন। তিনি ফেসবুকের গুরুত্বপূর্ণ পদের অধিকারীদের ইসরায়েলে গিয়ে সেখানকার আইটি ও অন্যান্য প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে মত বিনিময়ের আমন্ত্রণ জানান।

উপমন্ত্রী ইসরায়েলের ইন্টারনেট সক্ষমতার ওপর বর্ণনা করেন। তিনি টেকনোলজির এগিয়ে যাওয়ার বিষয়টি বর্ণনা করেন। তিনি জানান, ইহুদিদের সবচেয়ে বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ইন্টেল সাত হাজারেরও বেশি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে। ফিলিস্তিনি মুক্তিসংগ্রাম আন্দোলনের অংশ ‘ইনতিফাদা’-কে ‘সন্ত্রাসী কার্যক্রম’ হিসাবে উল্লেখ করে ফেসবুক কর্মকর্তারা ইসরায়েলের পররাষ্ট্র উপমন্ত্রীকে জানান, তারা ইসরায়েল বিরোধী পেজ ‘থার্ড ইনতিফাদা’ বন্ধ করে দিয়েছেন। পেজটি বন্ধ করার প্রতিক্রিয়া সর্ম্পকেও উপমন্ত্রীকে তারা অবহিত করেন। তারা বলেন, ‘ভবিষ্যতেও যে কোনো সন্ত্রাসী কার্যক্রম প্রতিরোধে সন্ত্রাসের প্রচারক পেজগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ তারা আরো জানান, ইসরায়েলে ফেসবুক একটি মার্কেটিং সেন্টার খুলতে আগ্রহী। এ বিষয়ে তারা বিস্তারিত পরিকল্পনা তুলে ধরেন।

২০১২ সালে ফেসবুকের কো-ফাউন্ডার মার্ক জাকারবার্গের ছোট বোন অ্যারিয়াল জাকারবার্গ ও তার কয়েকজন সঙ্গী ইসরায়েলের শিক্ষামূলক সংগঠন ট্যাগলিট বার্থরাইট-এর আমন্ত্রণে দেশটিতে যান। প্রকাশ্যে এই সংগঠন ইসরায়েলের গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক স্থানগুলোকে প্রতিভাশালী তরুণ ইহুদিদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। যেন তারা যেখানেই থাকুক না কেন, ইহুদি ঐতিহ্য নিয়ে কাজ করেন। গোপনে ট্যাগলিট বার্থরাইট সংগঠনটির সঙ্গে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর সরাসরি সর্ম্পক আছে। প্রবাসী ইহুদিরা এই ভ্রমণে সামরিক সদস্যদের সঙ্গে ভাব বিনিময় করার সুযোগ পান।

অ্যারিয়েল জাকারবার্গ ও তার সঙ্গীদের আমন্ত্রণ জানান ইসরায়েলি প্রেসিডেন্ট শিমন পেরেস। প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘আমি গভীর ভাবে শ্রদ্ধা জানাই জাকারবার্গ পরিবারের প্রতি। শুধু তাদের সৃষ্টিশীলতার জন্য নয়, বরং নিজস্ব ঐতিহ্যকে হৃদয়ের গভীরে লালন করার জন্য। অ্যারিয়েল ও তার সঙ্গী যারা ইসরায়েলে এসেছেন তাদের নিয়ে আমি গর্বিত।’

ইসরায়েলের স্বার্থে ফেসবুক নিয়মিত ভাবে সেন্সরশিপ চালিয়ে থাকে। আবার ফেসবুকের স্বার্থ দেখে ইসরায়েল। কয়েকটি ইসরায়েলি পত্রিকার শিরোনাম দেখা যায়,
ইসরায়েল তার প্রচারণায় ফেসবুক ব্যবহার করছে (ওয়াইনেট নিউজ)
ফেসবুক ও টুইটারের শত্রæদের বিপক্ষে যুদ্ধ করছে নতুন আইডিএফ ইউনিট (হারেটজ)

জেরুসালেম পোস্ট-এর কয়েকটি শিরোনাম:
ইসরায়েলি মন্ত্রী জাকারবার্গকে ইনতিফাদা পেজ বন্ধের আহ্বান জানান
ফেসবুক ‘ইনতিফাদা ৩’ পেজ বন্ধ করে দিয়েছে
ফেসবুক গান্ধীর উক্তি বন্ধ করেছে
পিস টিভির অ্যাকাউন্ট বন্ধ করেছে ফেসবুক
১৩২ জনের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট সম্পর্কে জানতে চেয়েছে ইসরায়েল
ইহুদি ইন্টারনেট ডিফেন্স ফোর্স ইসরায়েল বিরোধী ফেসবুক গ্রুপের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেছে

চুরি হচ্ছে ব্যবহারকারীর তথ্য:

ফেসবুকসহ সোশ্যাল মিডিয়াগুলো নানা ভাবে ব্যবহারকারীর তথ্য সংগ্রহ করছে। ব্যবহারকারীদের নানা ধরণের তথ্য দিতে প্রলুব্ধ করছে। ফলে একজন তার সারাদিনের কর্মকাণ্ড, পরিবার, আবেগ অনুভূতি সব কিছুই সোশ্যাল মিডিয়ায় দিয়ে দিচ্ছেন কোনো রকম চিন্তা ছাড়া। এই কোটি কোটি মানুষের তথ্য তারা সংগ্রহ করে সেখানকার রাজনীতি, ব্যবসা, সমাজ সব কিছুতেই প্রভাব ফেলছে। সম্প্রতি মিয়ানমারে রোহিঙ্গা গণহত্যার পেছনেও কাজ করেছে ফেসবুক। মার্কিন নির্বাচনকে প্রভাবিত করেছে ফেসবুকের তথ্য। এছাড়া ব্যক্তিগত নিরাপত্তাহীনতার কথা তো জানিয়ে গুগল তার মাই অ্যাকটিভিটি অ্যাপের মাধ্যমে ব্যবহারকারীর সকল তথ্য সংগ্রহ করে রাখছে। একজন মানুষ প্রতিমুহূর্তে কী করছেন তা জানা যায় ‘মাই অ্যাকটিভিটিতে’।

সম্প্রতি আমেরিকায় প্রায় নয় কোটি ব্যবহারকারীর তথ্য ফাঁসের ঘটনা সোশাল মিডিয়ার প্রকৃত চেহারা প্রকাশ পেতে সাহায্য করেছে। তথ্য ফাঁসের ঘটনায় আমেরিকান কংগ্রেসের ৪৪জন সিনেটরের সমন্বয়ে গঠিত বাণিজ্যবিষয়ক ও বিচারক কমিটির যৌথ শুনানিতে ডাকা হয় জাকারবার্গকে। তার কাছে জানতে চাওয়া হয়, যাদের ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট নেই তাদের সম্পর্কে ফেসবুক কোনো তথ্য সংগ্রহ করে কিনা। উত্তরে জাকারবার্গ সরাসরি কিছু না বলে জানান, ‘নিরাপত্তার প্রয়োজনে অনেক সময় যাঁরা ফেসবুক ব্যবহার করেন না, তাঁদের তথ্য সংগ্রহ করে ফেসবুক।’ প্রাইভেসি-বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনলাইন থেকে তথ্য সংগ্রহের এ পদ্ধতিতে শ্যাডো প্রোফাইল তৈরি করে রাখা যায়।

ফেসবুক থেকে লগ আউট করার পর কেউ অন্য কোথাও অনলাইনে কাজ করলে বা কথা বললে সেটা ফেসবুক জানতে পারে কি না, এমন প্রশ্নে জবাবে জাকারবার্গ বলেন, ‘ফেসবুক ব্যবহার-সংক্রান্ত কিছু নির্দিষ্ট বিষয় রয়েছে। যদি লগ ইন করা নাও থাকে, তবেও ফেসবুক ব্যবহারকারীকে অনুসরণ করতে পারে। কেউ ফেসবুক সিস্টেমকে অনৈতিক কাজে লাগাচ্ছে কি না, তা বোঝার জন্য ওই ট্র্যাকিং করার প্রয়োজন পড়ে।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘ফেসবুক ব্যবহার করুক বা না করুক, মানুষের অনলাইন ব্যবহারের অভ্যাস সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে ফেসবুক। বিভিন্ন থার্ড পার্টি ওয়েবসাইট ও মোবাইল অ্যাপকে কুকি ও পিক্সেল বসানোর জন্য অর্থ দেয়। এ ছাড়া লাইক, শেয়ার বাটন তো আছেই। এসবের মাধ্যমে ফেসবুকের কাছে উন্নত বিজ্ঞাপন দেখানোর জন্য তথ্য চলে যায়।’

কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার মাধ্যমে ফেসবুকের তথ্য ফাঁসের ঘটনায় উদ্বিগ্ন সারা পৃথিবীর ব্যবহারকারীগণ। প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা যায়, “বাংলাদেশে ফেসবুক ব্যবহারকারী প্রায় ২০ লাখ লোকের ব্যক্তিগত তথ্য ঝুঁকির মধ্যে ছিল এবং তাদের অনেকেরই তথ্য তাদের অজান্তেই বেহাত হয়েছে বলে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ স্বীকার করেছে। ফেসবুকের প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা মাইক শ্রোয়েফার ফেসবুক নিউজরুমের এক ব্লগে এ তথ্য জানিয়েছেন। মাইক শ্রোয়েফার এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উদাহরণ দিয়ে বলেন, দেশটিতে ফেসবুকে প্রোফাইল খোঁজা বা অনুসন্ধানের ৭ শতাংশই হয়েছে টেলিফোন নাম্বার বা ই- মেইল ঠিকানা ব্যবহারের মাধ্যমে। বাংলাদেশে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে ছিল ২ কোটি ৮০ লাখ (সূত্র: ইন্টারনেট ওয়ার্ল্ড স্ট্যাটাস)। সেই হিসাবে ঝুঁকির মুখে থাকা ব্যবহারকারীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১৯ লাখ ৬০ হাজার। সাধারণত, ব্যবহারকারীদের অ্যাকাউন্ট বা পাসওয়ার্ড পুনরুদ্ধারের সময় এই টেলিফোন নাম্বার বা ই-মেইল ঠিকানা দিতে হয়েছে এবং তারপর সেগুলো সংরক্ষণে যথাযথ নিরাপত্তার ব্যবস্থা ছিল না বলেই তার ব্যাখ্যায় ধারণা পাওয়া যায়। যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন, কানাডা এবং ইওরোপিয়ান ইউনিয়ন ফেসবুক ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষায় ব্যর্থতা এবং সংশ্লিষ্ট দেশ বা জোটের আইন লঙ্ঘনের জন্য আলাদা আলাদা তদন্ত শুরু করেছে। তবে বাংলাদেশে ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষায় কোনো আইন নেই।...কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা এবং তার অভিভাবক প্রতিষ্ঠান এসসিএলের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দেশে নির্বাচন প্রভাবিত করায় ফেসবুকের তথ্যগুলো বেআইনিভাবে ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে। কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা ভারত, শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনে কাজ করার লক্ষ্যে আলোচনা চালাচ্ছে বলেও ভারতের হিন্দুস্তান টাইমস পত্রিকা জানিয়েছে।”

ফেসবুকের গোয়েন্দাগিরি, তথ্যপাচার, অবৈধ কর্মকা- এবং সামাজিক অস্থিরতা তৈরির কারণে সারা পৃথিবীতেই ভারসাম্যহীনতার জন্ম হয়েছে। ইকোনমিস্ট ম্যাগাজিন ফেসবুকসহ সোশাল মিডিয়াকে চিহ্নিত করেছে ‘অ্যান্টি সোশাল মিডিয়া’ হিসেবে। জাতিসংঘের কর্মকর্তা ইয়াংহি লি ফেসবুককে বর্ণনা করেছেন ‘দানব’ হিসাবে। এই দানবকে দমন করার জন্য ফেসবুক থেকে বেরিয়ে আসার কোনো বিকল্প নেই। বিভিন্ন দেশে ‘ডিলিট ফেসবুক’ আন্দোলন শুরু হয়েছে। বাংলাদেশে ফেসবুক বিরোধী শক্তিশালী ক্যাম্পেইন শুরু হয়েছে সবার আগে।
দানবের দাস নয়, সৃষ্টির সেরা মানব হিসেবেই আমরা পৃথিবীতে এসেছি। এখন প্রয়োজন সচেতনতার। আমরা প্রযুক্তির বিরুদ্ধে নই, কিন্তু প্রযুক্তি যেন আমাদের দাস না বানাতে পারে সে বিষয়ে সব সময় সতর্ক থাকতে হবে। প্রকৃতপক্ষে মানুষ হিসেবে আমাদের অস্তিত্বের প্রশ্ন এখানে। দানবের বিরুদ্ধে মানবের লড়াই শুরু হয়েছে।

লেখক: সাংবাদিক ও সম্পাদক, বিপরীত স্রোত

এমজে/