ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৪ ১৪৩০

কৃত্রিম উপগ্রহের যুগে বাংলাদেশ

গোলাম সারোয়ার

প্রকাশিত : ০৭:৫৪ পিএম, ১০ মে ২০১৮ বৃহস্পতিবার

মানুষ পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ জীব। এটি শুধু এ কারণে নয় যে, প্রকৃতি জগতে মানুষই সবচেয়ে সুন্দর অবয়বের সৃষ্টি। এটি এ কারণেও নয় যে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে মানুষই একমাত্র উদ্ধত প্রাণী, আর সব সৃষ্টি অবনত। বরং এ করণে যে, মানুষ প্রায় একশ বিলিয়ন নিউরনে তৈরি তার মস্তিষ্কটি ব্যবহার করে সমগ্র প্রকৃতি জগতটিকে বশ করার দু:সাহস দেখিয়েছে। আমরা যে মহাবিশ্বে বসবাস করি তার ব্যাপ্তি বিশাল। বিজ্ঞানীরা এগুলো নিয়ে বিস্তর চিন্তা ভাবনা করেছেন। এখন পর্যন্ত যে সিদ্ধান্ত তাঁরা আমাদের দিয়েছেন সে হিসেবে আমাদের এই মহাবিশ্ব প্রায় একশ বিলিয়ন আলোকবর্ষ বিস্তৃত! হিসাবটা সহজ করে দেখে নিই। আলো প্রতি সেকেন্ডে এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল বেগে যায়। এই গতিতে আলো সূর্য থেকে পৃথিবীতে আসতে সময় লাগে ৮ মিনিট ১৯ সেকেন্ড। এই গতিতে আলো এক বছর যেতে থাকলে যতটুকু দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে তাকে বলে, এক আলোক বর্ষ দূরত্ব। এই রকম দশ লক্ষ আলোকবর্ষ দূরত্বকে বলা হয় এক মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরত্ব। আর এক হাজার মিলিয়নে হবে এক বিলিয়ন। আমাদের মহাবিশ্বের বিস্তৃতি হলো একশ বিলিয়ন আলোকবর্ষ!

এই বিস্তৃত বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে আছে প্রায় একশ ট্রিলিয়ন গ্যালাক্সি। এক ট্রিলিয়ন মানে এক হাজার বিলিয়ন। একশ ট্রিলিয়ন গ্যালাক্সির মধ্যে আমরা যেটাতে আছি সেটার নাম মিল্কিওয়ে বা আকাশগঙ্গা। প্রতিটি গ্যালাক্সিতে আছে অগণিত সূর্য। আমাদের আকাশগঙ্গাতেও আছে অসংখ্য সূর্য। এক একটি সূর্য নিয়ে এক একটি সৌরপরিবার। আমাদের সৌর জগতের মা-বাপ হলো সূর্য। এই সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরতেছে নয়টি গ্রহ। আমাদের পৃথিবীও তেমনি একটি গ্রহ। পৃথিবী নামক এই গ্রহে অসংখ্য প্রাণী আছে। তার ভিতরে আমরাই একমাত্র প্রাণী যারা সমস্ত জগতের অপার রহস্য ভেদ করার দু:সাহস দেখিয়ে বসে আছি! সেজন্যেই আমরা মহাবিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ জীব। আমরা জানি এই মহাবিশ্বের প্রকাণ্ড এইসব কর্মকাণ্ড বেহুদা নয়। এখানে বহু প্রাকৃতিক নিয়ম আছে যা মানব কল্যাণে ব্যবহার করা সম্ভব। বিজ্ঞানীরা শুধু চিন্তা করেই ক্ষান্ত হয়ে বসে রইলো না। তারা কাজেও লেগে গেলো। বিজ্ঞানীরা দেখলো যে, গ্রহগুলো সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে, তারা আবার নিজেদের অক্ষের উপরও ঘুরছে। গ্রহগুলোকে কেন্দ্র করে আবার ঘুরছে তাদের উপগ্রহগুলো। আমাদের পৃথিবীর উপগ্রহ হলো চাঁদ মামা। কোন কোন গ্রহের একাধিক উপগ্রহ আছে। যেমন, মঙ্গল গ্রহের আছে ২টি উপগ্রহ, নেপচুনের ১৩টি, ইউরেনাসের ২৭টি,  শনি ৩৪ টি আর  বৃহস্পতির ৬৩ টি উপগ্রহ।  বিজ্ঞান বললো, এরা গ্রহের মাধ্যাকর্ষণ বলের প্রভাবে গ্রহের চারদিকে ঘুরছে।

চিন্তাশীল মানুষেরা চিন্তা করে। চিন্তা থেকে কবি সাহিত্যিক আর শিল্পীরা গড়ে তোলেন কল্প। আর কল্প থেকে কেউ কেউ গড়ে তোলেন গল্প চিত্রকল্প। তেমনি একটি মজার কল্পকাহিনীতে কৃত্রিম উপগ্রহের ধারনা দেন একজন মার্কিন গল্পকার ১৮৬৯ সালে। এডওয়ার্ড ইভারেট হেল নামের সেই ছোট গল্পকার ‘দ্য ব্রিক মুন’ নামের এই গল্পে দেখান, একটি দুইশ ফুট ব্যাসের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের ভিতরে বসে যন্ত্রটির চালকরা ভুল বোতামে চাপ দেন। তারপরে যন্ত্রটি নিজেই পৃথিবীর বাইরে চলে যায় এবং পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরতে শুরু করে। এই হলো গল্প। এই গল্পের একশ বছর পর অ্যাপোলো ১১ যানে চড়ে মানুষ ঠিকই চাঁদে পৌঁছে গেছে। ১৯০৩ সালে ‘এক্সপ্লোরিং স্পেস ইউজিং জেট প্রপালশন ডিভাইসেস’ নামের বইয়ে কৃত্রিম উপগ্রহের ধারনার প্রথম বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেন কনস্তানতিন সিলকভোস্কি।

তারপর ১৯৫৭ সালের ৪ অক্টোবর মহাকাশ যাত্রার প্রথম পদক্ষেপটির সূচনা করেন সোভিয়েত ইউনিয়ন। তারা প্রথম উৎক্ষিপ্ত কৃত্রিম উপগ্রহটির নাম দেন ‘স্পুটনিক-১’ ।  স্পুটনিক মানে হলো ভ্রমণসঙ্গী। সেই একই বছর ২ নভেম্বর তারা মহাকাশে পাঠান ‘স্পুটনিক-২’, যেটি লাইকা নামের একটি কুকুরকে বহন করে নিয়ে যায় । তখন যুক্তরাষ্ট্র আর সোভিয়েত ইউনিয়নের মাঝে চলছিলো জেদাজেদি,--শক্তি, চিন্তা, বিজ্ঞান, অর্থনীতি আর রাজনৈতিক দর্শনের প্রতিযোগিতা। ১৯৫৮ সালের ২ ফেব্রুয়ারি মার্কিনিরা মহাকাশে প্রথম ‘এক্সপ্লোরার-১’ নামের কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠায়। তারপর ভস্টক-১ নামক সোভিয়েত কৃত্রিম উপগ্রহ মানুষ নিয়ে প্রথম পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে। প্রথম মহাকাশচারী মানুষ হন সোভিয়েত আদম সন্তান ইউরি গ্যাগারিন।  তিনি ১৯৬১ সালের ১২ এপ্রিল ভস্টক-১ এ চড়ে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করেন। প্রথম সোভিয়েত মহিলা মহাকাশচারী ভেলেন্তিনা তেরেসকোভা মহাকাশে ঘুরে আসেন ১৯৬৩ সালে। তারপর থেকে এ পর্যন্ত ৫৬টি দেশ থেকে কয়েকহাজার স্যাটেলাইট মহাকাশে উৎক্ষেপণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ এই যাত্রায় হলো ৫৭তম দেশ। তবে পৃথিবীর মাত্র ১০ টি দেশ নিজস্ব প্রযুক্তিতে ও নিজস্ব উৎক্ষেপণ কেন্দ্র থেকে মহাকাশে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করতে সক্ষম হয়েছে। দেশগুলো হলো- সোভিয়েত ইউনিয়ন (১৯৫৭), যুক্তরাষ্ট্র (১৯৫৮), ফ্রান্স (১৯৬৫), জাপান (১৯৭০), চীন (১৯৭০), যুক্তরাজ্য (১৯৭১), ভারত (১৯৮০), ইসরায়েল (১৯৮৮), ইউক্রেন (১৯৯২) ও ইরান (২০০৯)। বর্তমানে মহাকাশে সক্রিয় স্যাটেলাইটের সংখ্যা প্রায় দেড় হাজার, বাকিগুলো নিষ্ক্রিয় আর দিকভ্রান্ত। আর উৎক্ষিপ্ত উপগ্রহগুলোর ভিতরে কর্মক্ষম প্রায় অর্ধেক হলো যুক্তরাষ্ট্রের।

এই যে এত এত কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠানো হচ্ছে মহাকাশে, এর কাজ কী তাহলে! আমাদের কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘বিশ্বজগত দেখবো আমি আপন হাতের মুঠোয় পুরে।‘ হ্যা, কৃত্রিম উপগ্রহগুলো বিশ্বজগতটাকে আমাদের আপন হাতের মুঠোতে এনে দিয়েছে। পৃথিবীর যেকোন দেশের যেকোন অনুষ্ঠান আমরা এখন ইউটিউবে দেখতে পারি হাতের মুঠোতে মোবাইলে। যেকোন জ্ঞান গুগলে সার্চ দিয়েই আমরা পেতে পারি মোবাইলে, ল্যাপটপে। যেকোন দেশের মানুষের সাথে আমরা মুহূর্তে যোগাযোগ করতে পারি, কথা বলতে পারি, ছবি দেখতে পারি। পৃথিবীর তাবত যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, আবহাওয়া ও জলবায়ু পর্যবেক্ষণ, গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেমের (জিপিএস) অবস্থান নির্ণয়, গোয়েন্দা কর্মকাণ্ড, জরিপ ও সেনা সংশ্লিষ্ট কাজে কৃত্রিম ব্যবহার করা হয়। মোটকথা মহাকাশ ও জ্যোতির্বিজ্ঞান গবেষণা, আবহাওয়ার পূর্বাভাস, টেলিভিশন বা রেডিও চ্যানেলের সম্প্রচার কাজ, মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট যোগাযোগ প্রযুক্তি, আকাশ-সড়ক ও জলপথে দিক নির্ণয় ও নির্দেশনায়, দূর সংবেদনশীল অনুসন্ধান, মাটি বা পানির নিচে অনুসন্ধান ও উদ্ধার কাজে, মহাশূন্যে উদ্ভাবন ও আবিষ্কার, ছবি তোলা ও তথ্যসংগ্রহ, বন্যা-ঝড়সহ প্রাকৃতিক বিভিন্ন ঘটনা ও বিপর্যয়ের পূর্বাভাসে উপগ্রহের সাহায্য নেওয়া ছাড়া এই যুগ চলবেনা। তাহলে যাদের নেই তারা কিভাবে চলছে, আমরা কিভাবে চললাম এতদিন ! যাদের নেই তারা, যাদের আছে তাদের থেকে সেবা কিনে চলে তাদের মর্জির উপর ভর করে। এছাড়া বিভিন্ন রশ্মি শনাক্তকরণ, দুর্গম অঞ্চলে উদ্ধারকাজে সহায়তা, তেল-গ্যাসসহ বিভিন্ন খনি শনাক্তকরণ ইত্যাদি কাজেও কৃত্তিম উপগ্রহের ভূমিকা আছে।

আমরা এবার বিশ্ব স্যাটেলাইট ক্লাবের সদস্য হওয়ার গৌরব অর্জন করলাম। এর ফলে দেশের সম্প্রচার খাতে বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয়সহ উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার সহজ হবে। আমরা প্রায় দুই হাজার ৭০০ কোটি টাকা ব্যয়ে যে কৃত্রিম উপগ্রহের মালিক হলাম এই প্রযুক্তি নিজেরা ব্যবহার করে যেসব দেশ আজো এই পর্যায়ে পৌঁছাতে পারেনি তাদের নিকট সেবা বিক্রয়ও করতে পারবো। যখন ফ্রান্সে আমাদের উপগ্রহের নির্মাণ কাজ শেষ হলো, যখন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা থেকে মহাকাশে নিজের কক্ষপথে রওয়ানা হবে ‘বঙ্গবন্ধু-১’ নামের বাংলাদেশের স্বপ্ন, যখন ‘ফ্যালকন-৯’ নামের মহাকাশযানে আমাদের উপগ্রহটির উৎক্ষেপ্ত হবে ‘কেপ কারনিভাল স্পেসএক্স’ থেকে তখন আমরাই ইতিহাসের অংশ, তখন হেনরি কিসিঞ্জাররা দেখুক, ‘তলা বিহীন ঝুড়ি’ মহাকাশের পথ ধরেছে।

আমাদের মহাকাশ জয়ের স্বপ্নের ইতিহাস শুরু হয়েছিলো ১৯৯৯ সালে। তারপর বহুধাপ পেরিয়ে বাংলাদেশ ২০০৮ সালে আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নের কাছে আবেদন করে এবং অনুমোদন পাওয়ার পর নির্মাণ ও উৎক্ষেপণের দরপত্র চাওয়া হয়। এরপর ফরাসি-ইতালিয়ান মহাকাশযান নির্মাতা প্রতিষ্ঠান থ্যালেস আলেনিয়া স্পেসকে এই উপগ্রহটি নির্মাণের কাজ দেওয়া হয়েছিলো। যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি ‘স্পেস পার্টনারশিপ ইন্টারন্যাশনাল’ এ প্রকল্পের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে উপগ্রহের নকশা তৈরি করে। আর উপগ্রহটির কক্ষপথ (অরবিটাল স্লট) কেনা হয়েছে রাশিয়ার প্রতিষ্ঠান ইন্টারস্পুটনিকের কাছ থেকে।  চুক্তির মেয়াদ অনুসারে প্রাথমিকভাবে ১৫ বছরের জন্য এ কক্ষপথ কেনা হয়েছে। এছাড়া আরও ৩০ বছর বাড়ানো যাবে এই চুক্তির মেয়াদ। তার মানে এখন পর্যন্ত অ্যারেজমেন্টে এই উপগ্রহের মেয়াদকাল ৪৫ বছর। মহাকাশের ১১৯ দশমিক ১ পূর্ব দ্রাঘিমায় প্রায় ২১৯ কোটি টাকায় কেনা হয়েছে এ কক্ষপথের অবস্থান। এই ঠিকানায় অবিরত ঘুরবে ‘বঙ্গবন্ধু-১’। সেবা দিয়ে যাবে বাংলাদেশের কোটি মানুষসহ বিশ্বের অগণিত মানুষকে।

এই ঠিকানায় ঘুরবে বাংলাদেশের স্বপ্ন, ঘুরবে পৃথিবীর সব মুক্তকামী মানুষেরও স্বপ্ন। আমরা দলে মতে বিভক্ত, রাজনৈতিক দর্শনে, ধর্মে আর বিশ্বাসে বিভক্ত। কিন্তু আমরা এই সব মহাজাগতিক জাতীয় অর্জনে একই প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে বলতে চাই, পৃথিবীর সব ন্যায়যোদ্ধা, মুক্তিকামী মানুষেরা এখানে দেখে যাও, মুক্তিকামী মানুষের জয় হয়, মুক্তির মন্দির সোপান তলে বারবার হয়েছে সূর্যোদয়।  

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট