ঢাকা, শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ৫ ১৪৩১

কোটা সংস্কার দাবির ন্যায্যতা আছে : অধ্যাপক ফাহমিদুল হক

প্রকাশিত : ০৭:১৯ পিএম, ১২ মে ২০১৮ শনিবার | আপডেট: ০৭:২৪ পিএম, ১৩ মে ২০১৮ রবিবার

বিসিএসসহ সরকারি সব ধরণের চাকরিতে প্রচলিত কোটা পদ্ধতির সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের একপর্যায়ে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে কোটা তুলে দেওয়ার কথা বলেছেন। শিক্ষার্থীরা তার এই বক্তব্যকে সাধুবাদ জানিয়ে আন্দোলন স্থগিত করেছে। কিন্তু বেশকিছু দিন অতিবাহিত হলেও কোটা বাতিলের ব্যাপারে কোনো প্রজ্ঞাপন জারি হয়নি। ফলে ছাত্রদের মাঝে কিছুটা হতাশা দেখা দিয়েছে। আশা-নিরাশার দোলাচলে কাটছে চাকরি প্রত্যাশী লাখো তরুণের সময়।

এ পরিস্থিতিতে কোটা পদ্ধতি সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা, চাকরিতের প্রবেশের বয়সসীমা, গ্রাজুয়েশনের পরও চাকরির জন্য দীর্ঘ অপেক্ষা, বেকারত্ব, কর্মসংস্থান, পাবলিক ও চাকরির পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসসহ শিক্ষা ব্যবস্থার সামগ্রিক বিষয় নিয়ে সম্প্রতি একুশে টেলিভিশন অনলাইন মুখোমুখি হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ফাহমিদুল হকের

একুশে টেলিভিশন অনলাইনকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, এদেশে মুক্তিযোদ্ধা কোটা চালু হয়েছিল ১৯৭২ সালে, বঙ্গবন্ধুর সময়ে। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর এটি স্থগিত করা হয়। ১৯৯৬ সালে ফের আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে মুক্তিযোদ্ধা কোটা চালু করে, যেটি নি:সন্দেহের প্রশংসার দাবিদার। ৭২ এ মুক্তিযোদ্ধা কোটা যদি ৫০ শতাংশও করা হতো কারো কোনো আপত্তি থাকতো না। কারণ তখন সবেমাত্র যুদ্ধ শেষ হয়, মুক্তিযোদ্ধাদের একটা সম্মান-সুবিধা দেওয়াটা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল। সামরিক শাসকদের সময়ে স্থগিত থাকার পর ১৯৯৬ সালে যখন এটি ফের চালু করা হয় তখন এর পরিমানটা কিছুটা কমানো উচিত ছিল বলে আমি মনে করি। তার পরবর্তীতে কোটা ধীরে ধীরে আরও কমিয়ে আনা উচিত ছিল। সেটি হলে আজকে কেউ এ নিয়ে আপত্তি করতে পারতো না। সেটি না করায় তরুণ প্রজন্মের কাছে আজ কোটা পদ্ধতিটা একটা সাংঘর্ষিক জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। বৈষম্যমূলক কোটা পদ্ধতি বহাল রেখে তাদের জীবন-জীবিকায় একটা বৈপরীত্য দেখা দিয়েছে। সার্বিক বিবেচনায় আমার মনে হয় কোটা সংস্কার করার এখনই যথাযথ সময়।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন একুশে টেলিভিশন অনলাইন প্রতিবেদক রিজাউল করিম। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের প্রথম পর্ব পাঠকদের উদ্দেশ্যে তুলে ধরা হলো-

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: কোটা পদ্ধতি সংস্কারে জোর দাবি উঠেছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এ নিয়ে সংসদে কথা বলেছেন। আসলে কোটার সংস্কারটা কিভাবে হতে পারে বলে আপনি মনে করেন?

ফাহমিদুল হক: কোটা সংস্কারের দাবি আমার কাছে যৌক্তিকই মনে হয়। কোটা দেওয়া হয় সমাজের পিছিয়ে পড়া অবহেলিত, দরিদ্র ও অসহায় নাগরিকদের জন্য। অবহেলিতদের দেওয়া এ কোটার সুবিধা তো দেশের মোট সাধারণ জনগোষ্ঠীর চেয়ে বেশি হতে পারে না। এ কোটা চিরস্থায়ী কোনো ব্যাপারও না। এটা সময়ের বিবেচনায় পরিবর্তিত হতে বাধ্য। তাই শিক্ষার্থীদের দাবিটার ন্যায্যতা আছে।

এছাড়া শিক্ষার্থীরা তো কোটা পুরোপুরি বাতিল করতে বলছে না। কোটার যে সর্বোচ্চ ফিগার ৫৬ শতাংশ আছে। সেটা কমিয়ে ১০ শতাংশ আনার কথা বলছে। এখানে মুশকিল হয়ে গেছে, মুক্তিযোদ্ধা সন্তান ও নাতি-নাতনীদের কোটা অংশের পরিমানটাই, যা ত্রিশ শতাংশ।

এখানে মনে রাখতে হবে যে, দেশে মুক্তিযোদ্ধা কোটা চালু হয়েছিল ১৯৭২ সালে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সময়ে। ১৯৭৫ এ বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর এটি স্থগিত করা হয়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ফের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসে কোটা চালু করে। ৭২ এ মুক্তিযোদ্ধা কোটা যে পরিমাণ ছিল (৩০ শতাংশ), ১৯৯৬ তে ফের চালু করার সময়ও তা একই পরিমাণ রাখা হয়। এমনকি স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরও মুক্তিযোদ্ধা কোটা একই পরিমাণে আছে। মুক্তিযোদ্ধা কোটা চালু করার সময় যদি ৫০ শতাংশও করা হতো, কারো কোনো আপত্তি থাকতো না। কারণ সবেমাত্র যুদ্ধ শেষ হয়েছে। সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধাদের একটা সম্মান ও সুবিধা দেওয়াটা যৌক্তিক। ১৯৯৬ সালে এটা যখন ফিরিয়ে আনা হলো, তখন এর পরিমাণটা কমানো যেতো। এমনকি তার পরবর্তীতেও ধীরে ধীরে এটি কমিয়ে আনা উচিত ছিল।

এমনটি না করায় তরুণ প্রজন্ম, যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখে নাই, প্রত্যক্ষ যোগাযোগ নাই মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে, ইতিহাস পাঠের মাধ্যমে যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে, তাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ চেতনা একটা বিপরীত জায়গায় দাঁড় করিয়ে দেওয়া হলো। বৈষম্যমূলক কোটা পদ্ধতি বহাল রেখে তাদের জীবন-জীবিকায় একটা বৈপরীত্য দেখা দিল। সেটা একটা দুঃখজনক ব্যাপারে পরিণত হলো। যার কারণে ফের প্রবর্তনের হারটা বিবেচনাপ্রসূত ছিল বলে আমার মনে হয় না। এসব বিষয় বিবেচনায় আমার মনে হয় কোটা সংস্কার করার এখনই যথাযথ সময়। ছাত্র সমাজ যে দাবি করছে, তাদের দাবির পেছনে একটা ন্যায্যতা আছে বলে আমি মনে করি।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: আপনি বলছিলেন দেশ স্বাধীনের পরপরই মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৫০ শতাংশ হলেও আপত্তি থাকতো না। মুক্তিযুদ্ধের ৪৭ বছর পরে এসে মুক্তিযোদ্ধা কোটা আগের মতোই আছে, বিষয়টি কতটা যৌক্তিক বলে মনে করেন?    

ফাহমিদুল হক: বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধা কোটা শূণ্যে নামিয়ে আনলেও আমি কোনো সমস্যা দেখি না। তবে যে সব মুক্তিযোদ্ধা পরিবার এখনও অনেক পিছিয়ে আছে তাদেরকে চিহ্ণিত করা দরকার।তাদের তৃতীয় প্রজন্মকেও বিশেষ সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। তবে সেটা সঠিক যাচাইয়ের মাধ্যমে। আসল কথা হচ্ছে- কোটা পদ্ধতি একপর্যায়ে অবশ্যই শূণ্য হয়ে যাওয়া উচিত। মুক্তিযোদ্ধা কোটা যে বিবেচনাতেই ৩০ শতাংশ করা হয়েছে। সেই বিবেচনাতেই ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা উচিত। আগামী এক দশক পরে তা পুরো উঠিয়ে দেওয়া উচিত।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: প্রধানমন্ত্রী সংসদে কোটা বাদ দেওয়ার কথা বলেছেন। বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখছেন ?

ফাহমিদুল হক: মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কোটা পদ্ধতিটাই বাতিল করতে বলেছেন, সেটা আমি সমর্থন করছি না। বাতিল না করে বরং ছাত্র-ছাত্রীদের যে দাবি ১০  শতাংশ কিংবা বড় জোর ১৫ শতাংশ রাখা যেতে পারে।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: সেক্ষেত্রে কোটা সংস্কারটা আসলে কিভাবে হওয়া উচিত ?

ফাহমিদুল হক: সেক্ষেত্রে জেলা কোটা আর থাকার দরকার আছে বলে আমি মনে করি না। কারণ এখন দেশের ভেতরে যোগাযোগ বেড়েছে। জেলা উপজেলা পর্যায়ে অনেক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। সড়ক যোগাযোগ থেকে সব ধরণের যোগাযোগ আগের চেয়ে অনেক উন্নত হয়েছে। যেমন যমুনা সেতুর জন্য উত্তরবঙ্গের যোগাযোগ এখন সহজ। এসব বিবেচনায় জেলা কোটা শূণ্যে নিয়ে আসলেও অযৌক্তিক হবে বলে আমি মনে করি না।

তবে প্রতিবন্ধী, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠি এ জায়গাগুলো এখনও ভঙ্গুর রয়ে গেছে। উপজাতিদের মধ্যে চাকমা জনগোষ্ঠীর কিছুটা উন্নয়ন হলেও অন্যরা এখনও পিছিয়ে আছেন। তাইি উপজাতি কোটা বহাল থাকতে পারতো। আর নারী কোটা ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে আনা যেতে পারে।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: অভিযোগ আছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী শক্তি কোটা আন্দোলনে ইন্ধন দিচ্ছে। আপনার কি মনে হয় ?

ফাহমিদুল হক: কোটার বিষয়টি দেশ প্রেমের ঘাটতি কিংবা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী বলে কোনো আবেগ দিয়ে দেখলে হবে না। এই আন্দোলনে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি যুক্ত আছে, তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে না, এসব বলে বিষয়টি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা ঠিকও হবে না। ব্যাপারটি এভাবে না দেখে, বরং যৌক্তিকভাবে দেখা উচিত।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: প্রধানমন্ত্রী কোটা বাদ দেওয়ার কথা বলার পর বেশকিছু দিন পেরিয়ে গেল। এখন প্রজ্ঞাপন জারি হয়নি। শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ হতাশ হয়ে পড়ছেন। বিষয়টিকে কিভাবে দেখবেন?

ফাহমিদুল হক: বিলম্ব করার যৌক্তিকতা কিছুটা আছে। কারণ এ ধরণের রাষ্ট্রীয় নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে একটু গবেষণা বা যাচাই-বাঁছাইয়ের ব্যাপার থাকে। এ ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা, বিশেষজ্ঞদের মতামত জানার দরকার আছে। তার জন্য সময় একটু লাগতেই পারে।  প্রধানমন্ত্রী কোটা বাতিলের কথা বলছেন, সঙ্গে সঙ্গে তিনি প্রতিবন্ধী ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠির বিষয়টি দেখার কথাও বলেছেন। ওই আলাদা করে দেখা বা ওই প্রতিবন্ধী ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জায়গাটা একটু নির্ধারণ করার ব্যাপার আছে। যার জন্য একটা বিশেষজ্ঞ পর্যালোচনার দরকার আছে। যার কারণে প্রধানমন্ত্রীর মুখের কথা কাগজ-কলমে বাস্তবায়নে একটু সময় লাগবে। আবার এ প্রজ্ঞাপন দেওয়ার সঙ্গে এক ধরণের আমলাতন্ত্রের ব্যাপারও আছে। ফলে এটা স্বাভাবিকভাবেই একটু দেরি হতে পারে। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রী তো দেশেও ছিলেন না বেশিকিছু দিন।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: আন্দোলনকারী ছাত্রদের মধ্যে একটা সন্দেহ কাজ করছে যে, কালক্ষেপন করে তাদের দাবি শেষমেষ মানা হবে না। আপনিও কি এ ধারণায় একমত?

ফাহমিদুল হক:  আন্দোলনকারীদের সন্দেহ কিন্তু আমি অমূলক হিসেবে দেখছি না। কারণ এক ধরণের পীড়নের মাধ্যমে তাদের দমন করার চেষ্টা করা হয়েছে। তারপরও ছাত্ররা আন্দোলন চালিয়ে গেছে। আন্দোলনে তারা সারা দেশ প্রাই অচল করে দিলে একপর্যাযে রাষ্ট্রপক্ষ সেটা মেনে নেয়। ফলে এখানে না মানার ইচ্ছা প্রথম থেকেই রয়ে গেছে। ছাত্রদের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল গত ৭ মে একটা প্রজ্ঞাপন দেওয়া হবে। কিন্তু সে দিন পেরিয়ে গেলেও তা দেওয়া হয়নি। যদি এভাবে কালক্ষেপন হয়, তবে ছাত্ররা আন্দোলন চালিয়ে যাবে বলে মনে হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী যেহেতু ঘোষণা দিয়ে দিয়েছেন সেহেতু প্রজ্ঞাপন দ্রুত হয়ে যাওয়া উচিত। আমি মনে করি এ সপ্তাহের মধ্যে প্রজ্ঞাপন হওয়া উচিত।

দ্রুত প্রজ্ঞাপন না আসলে এ আন্দোলন আবারও ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে যেতে পারে। কারণ এ আন্দোলন সাধারণ শিক্ষার্থীদের ছাত্রদের হৃদয়ের আকাঙ্খাকে স্পর্ষ করেছে।

/ এআর /