ঢাকা, বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ১০ ১৪৩১

বিপাকে শিক্ষার্থীরা

সৃজনশীল বুঝেন না ৪১ শতাংশ শিক্ষক

তবিবুর রহমান

প্রকাশিত : ০৫:৪৯ পিএম, ১৩ মে ২০১৮ রবিবার | আপডেট: ১০:৪৫ এএম, ১৪ মে ২০১৮ সোমবার

শিক্ষার মান বৃদ্ধি ও পাঠ্য বইয়ের বিষয়বস্তু শিক্ষার্থীরা কতটা হৃদয়ঙ্গম করতে পারে তা যাচাইয়ে ২০০৮ সালে সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতি চালু করে সরকার। তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যাথাযথ তদারিক অভাবে ১০ বছর পার হলেও এক্ষেত্রে ততটা অগ্রগতি হয়নি। এখনো জোড়াতালি দিয়েই এই পদ্ধতি চলছে বলে মনে করেন শিক্ষাবিদরা।

শিক্ষাবিদরা বলছেন, মাধ্যমিক স্কুলের ৫৪ শতাংশ শিক্ষক সৃজনশীল পদ্ধতি আয়ত্ত করতে পারেননি। তাঁদের ২২ শতাংশের অবস্থা খুবই নাজুক। বাকিরা এ সম্পর্কে যে ধারণা রাখেন, তা দিয়ে আংশিক প্রশ্নপত্র তৈরি করা সম্ভব নয়। আর এখনও ৪১ শতাংশ শিক্ষক সৃজনশীল পদ্ধতি বোঝেন না। প্রশ্নও করতে পারেন না। তাহলে এই শিক্ষকরা যে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করেন তারা কিভাবে সৃজনশীল পদ্ধতি বুঝব? যে কারণে একদিকে প্রতিনিয়ত ঘটছে প্রশ্নফাঁস। অন্যদিকে বিপাকে পড়ে গাইড বই নির্ভর হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। ফলে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা হুমকির মুখে পড়ছে। অনেকটায় মেধাহীন হয়ে পড়ছে বর্তমান প্রজন্ম।

শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করতে সনাতনি পদ্ধতি বাদ দিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতি চালু করে সরকার। এই পদ্ধতিতে বলা হয়, পরীক্ষায় কী ধরনের প্রশ্ন থাকবে সে সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের কোনো ধারণা থাকবে না। প্রশ্ন থাকবে নির্দিষ্ট সিলেবাস থেকে এবং তারা নিজেদের মতো করে উত্তর লিখবে। বর্তমানে প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে এই পদ্ধতি চালু রয়েছে। এছাড়া এই পদ্ধতি চালুর সময় বলা হয়েছিলো এক ঝাঁক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক দ্বারা সারা দেশের স্কুল কলেজের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু  ১০ বছর পার হলেও তেমন উদ্যোগ চোখে পড়েনি। ফলে এক প্রকার বাধ্য হয়েই শিক্ষার্থীর বিভিন্ন কোচিং এর উপর নির্ভর হচ্ছে। আর কোচিং এর মাধ্যমে ফাঁস হচ্ছে প্রশ্নপত্র। ফলে মেধাবীরা তার সঠিক মূল্যায়ন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

রিসার্চ ফর অ্যাডভান্সমেন্ট অব কমপ্লিট এডুকেশনের (রেইস) জরিপে জানা যায়, মোট শিক্ষার্থীর এক-চতুর্থাংশই পরীক্ষার প্রশ্ন বুঝতে অক্ষম। তাদের কাছে কঠিন মনে হয় বিশেষ করে গণিত ও ইংরেজির মতো বিষয়গুলো। এতে আরো বলা হয়, শিক্ষার্থীদের ৯২ শতাংশই গাইড বই নির্ভর। তাদের দুই-তৃতীয়াংশ সৃজনশীল পদ্ধতি বোঝার জন্য গৃহশিক্ষকের সাহায্য নেয়। অন্যদিকে শিক্ষকদের মাত্র ৪৫ শতাংশ এ পদ্ধতি বোঝে, ৪২ শতাংশ অল্প অল্প বোঝে, ১৩ শতাংশ এ পদ্ধতি বুঝতেই পারেনি।

গত বছরের এইচএসসির জীববিজ্ঞান পরীক্ষায় একটি প্রশ্ন ছিল এমন—‘রফিক গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যায়। অসাবধানতাবশত তার হাত কেটে রক্তপাত শুরু হয়। কিছুক্ষণ পর রক্ত পড়া বন্ধ হয়।’ এটি হলো সৃজনশীল পদ্ধতিতে উদ্দীপকের অনুধাবনমূলক একটি প্রশ্ন। এ প্রশ্নের উত্তর জানতে বলা হয়— উদ্দীপকের রক্তপাত বন্ধের কৌশলটি বর্ণনা করো। মূলত এই প্রশ্নের উত্তরে রক্ত জমাট বাঁধার যে চারটি বৈজ্ঞানিক কারণ রয়েছে তা জানতে চাওয়া হয়েছে। একজন জীববিজ্ঞানের শিক্ষক গত বছর পরীক্ষার ২০৫টি খাতা দেখেছেন। এর মধ্যে মাত্র সাতজন পরীক্ষার্থী এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পেরেছে। অন্য পরীক্ষার্থীদের বেশির ভাগ অপ্রাসঙ্গিক উত্তর লিখেছে। অনেকে লিখেছে, ‘রফিক হাত চেপে ধরেছিল বলে রক্ত পড়া বন্ধ হয়েছে।

সম্প্রতি ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. নাছিম আখতার এই উদ্দীপকটির নমুনা তুলে ধরে বর্ণনা দিয়ে বলেন, জীববিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের নতুন জ্ঞান সৃষ্টির জন্য রক্ত জমাটবাঁধার চারটি বৈজ্ঞানিক কারণ জানা অত্যাবশ্যক। এখন সৃজনশীল পদ্ধতিতে প্রশ্ন না করে যদি সরাসরি রক্ত জমাটবাঁধার কারণ বর্ণনা করতে বলা হতো তাহলে ৫০ শতাংশ পরীক্ষার্থী সঠিক উত্তর দিতে পারত। অন্যদের কেউ তিনটি, কেউ দুটি বা একটি কারণ লিখতে পারত। অপ্রাসঙ্গিক উত্তর কেউ দিত না। বর্তমানে সৃজনশীল পদ্ধতিতে পাঠ্য বইয়ের অপরিহার্য বিষয়গুলো হৃদয়ঙ্গম করার ক্ষেত্রে ঘাটতি থেকে যাচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পর্যাপ্ত অবকাঠামো এবং তেমন সুযোগ সুবিধা না থাকায় নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা সম্ভব হচ্ছে না। শিক্ষার্থীদের যারা প্রশিক্ষণ দিবেন তারও সৃজনশীল এর উপরে ভালো প্রশিক্ষণ পাচ্ছে না। ফলে বাড়তি চাপ পড়ছে শিক্ষার্থীদের উপর। শিক্ষার্থীরা জ্ঞান অর্জনের মূল বিষয় থেকে সরে অনেক সময় নষ্ট করছে সৃজনশীল এর উপর। পরীক্ষায় বই থেকে কি কি বিষয় পরীক্ষায় আসবে তা বুঝতে না পেরে অনেকেই পড়াশুনা করে না। ফলে বর্তমান প্রজন্মে সৃজনশীল এর হতাশা থেকে শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপ ও শারীরিক চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এবিষয় জানতে চাইলে মিরপুর বাংলা স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থী আসমা আক্তার একুশে টিভি অনলাইনকে বলেন, পরীক্ষায় কোন ধরনের প্রশ্ন আসবে তার কোন ধারণা থাকে না। যে কারণে সারাদিন বই নিয়ে থাকতে হয়। অনেক সময় প্রশ্ন অনেক কঠিন হয়। যে কারণে বাধ্য হয়ে কোচিং নির্ভর হতে হয়। সৃজনশীল না হয়ে যদি সরাসরি প্রশ্ন আসলে তাহলে ভাল হতো।

এব্যাপারে জানতে চাইলে আসমা আক্তার মা আফরোজা বলেন, সৃজনশীল পদ্ধতি আমরা ঠিক ভাবে বুঝি না। যে কারণে স্কুলে কি পড়ানো হয় সে বিষয়েও কিছু জানি না।  এই কারণে বাধ্য হয়ে প্রাইভেট পড়াতে হয়। কোচিংয়ে দিতে হয়। ফলে মেয়ের উপর বাড়তি চাপ তৈরি হচ্ছে। বাড়তি চাপের কারণে অনেক সময় মা মেয়ের মধ্যে সর্ম্পকে অশান্তি সৃষ্টি হচ্ছে।

রাজধানীর একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক এবং এসএসসি পরীক্ষার প্রধান পরীক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘সৃজনশীল পদ্ধতি অধিকাংশ শিক্ষকই বোঝেন না। ফলে তাঁরা নোট-গাইড থেকে প্রশ্ন করেন। শুধু নাম-স্থান ঘুরিয়ে দিলেই হয়ে যায় নতুন প্রশ্ন। শিক্ষার্থীরাও নোট-গাইড পড়ে। পাবলিক পরীক্ষায় কিন্তু কোনো সমস্যা নেই। লিখলেই পাস, এটাই নিয়ম। কিন্তু যে শিক্ষার্থী সৃজনশীল পদ্ধতির কিছুই বোঝে না, সে আবোলতাবোল লিখে খাতা ভরে রাখে। তাকেও আমাদের পাস করাতে হয়। আর স্কুলের পরীক্ষায় প্রতিষ্ঠানের মান-সম্মান বিবেচনা করে আমরা তেমন একটা ফেল করাই না। এভাবেই চলছে সৃজনশীল পদ্ধতি।

সৃজনশীল পদ্ধতির ১০ বছর পার হলেও শিক্ষক-শিক্ষার্থী কেউই এখনো ঠিকমতো সৃজনশীল বোঝে না। গত জানুয়ারি মাসে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মনিটরিং শাখার ‘একাডেমি তদারকি প্রতিবেদন’ জানিয়েছে, মাধ্যমিক স্কুলের ৫৪ শতাংশ শিক্ষক সৃজনশীল পদ্ধতি আয়ত্ত করতে পারেননি। তাঁদের ২২ শতাংশের অবস্থা খুবই নাজুক। বাকিরা এ সম্পর্কে যে ধারণা রাখেন, তা দিয়ে আংশিক প্রশ্নপত্র তৈরি করা সম্ভব নয়। আর উচ্চ মাধ্যমিক স্তরেও প্রায় একই চিত্র পাওয়া গেছে।

সরকারি হিসাবেই এখনো ৪১ শতাংশ শিক্ষক সৃজনশীল পদ্ধতি বোঝেন না। প্রশ্নও করতে পারেন না। তাহলে এই শিক্ষকরা যে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করেন তারা কিভাবে সৃজনশীল পদ্ধতি বুঝবে— এটাই সংশ্লিষ্টদের প্রশ্ন। আর এই সৃজনশীল পদ্ধতির প্রশিক্ষণের নামেও চলছে শুভংকরের ফাঁকি। এখন পর্যন্ত অর্ধেকেরও কম শিক্ষককে সৃজনশীল পদ্ধতির বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। নামকাওয়াস্তে এই প্রশিক্ষণ হলো মাত্র তিন দিনের। এই স্বল্প সময়ের প্রশিক্ষণে একটি বিষয়ের সৃজনশীল পদ্ধতি সম্পর্কে শিক্ষকদের বোঝা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। ফলে তাঁদের বেশির ভাগ সৃজনশীল পদ্ধতি আত্মস্থ করতে পারছেন না। এ কারণে ১০ বছর পার হওয়ার পরও জোড়াতালি দিয়েই চলছে সৃজনশীল পদ্ধতি।

গত নভেম্বরে প্রকাশিত মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তরের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের একাডেমি তদারকি প্রতিবেদন অনুযায়ী, এখনো ৪০.৮১ শতাংশ শিক্ষক নিজেরা সৃজনশীল পদ্ধতির প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করতে পারেন না। গত বছর সাত হাজার ৩৫৮টি বিদ্যালয় সুপারভিশন করে এ তথ্য পায় তারা।

একাডেমি তদারকি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ৫৯.১৯ শতাংশ শিক্ষক নিজেরা সৃজনশীল পদ্ধতির প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করতে পারেন। অন্য বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সহায়তায় প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করেন ২৫.৯৯ শতাংশ শিক্ষক। আর বাইরে থেকে প্রশ্ন প্রণয়ন করেন ১৪.৮৩ শতাংশ শিক্ষক। সর্বাধিক খুলনা অঞ্চলের ৭৮.০৬ শতাংশ শিক্ষক নিজেদের প্রশ্ন নিজেরা করতে পারেন। আর সর্বাধিক পিছিয়ে রয়েছে বরিশাল অঞ্চল। এই অঞ্চলের মাত্র ২৬.৫৯ শতাংশ শিক্ষক নিজেরা সৃজনশীল পদ্ধতির প্রশ্ন করতে পারেন। অর্থাৎ ৭৩.৩৯ শতাংশ শিক্ষকই সৃজনশীল পদ্ধতি বোঝেন না। ঢাকা অঞ্চলের ৪৪.১৪ শতাংশ, ময়মনসিংহ অঞ্চলের ৩২.৩১ শতাংশ, সিলেট অঞ্চলের ৪২.৩৬ শতাংশ, চট্টগ্রাম অঞ্চলের ৩৭.৩৮ শতাংশ, রংপুর অঞ্চলের ৪২.৯৬ শতাংশ, রাজশাহী অঞ্চলের ৪১.১৩ শতাংশ এবং কুমিল্লা অঞ্চলের ৪৫.৪৪ শতাংশ শিক্ষক নিজেরা সৃজনশীল প্রশ্ন করতে পারেন না। তদারকি করা সাত হাজার ৩৫৮টি বিদ্যালয়ে শিক্ষকের সংখ্যা ৯৪ হাজার ৭৩৩ জন। এর মধ্যে সৃজনশীল পদ্ধতির ওপর প্রশিক্ষণ পেয়েছেন ৫৪ হাজার ১৯৬ জন। সর্বাধিক প্রশিক্ষণ পেয়েছেন ময়মনসিংহ অঞ্চলের ১৩ হাজার ৪৬২ জন শিক্ষক। আর সবচেয়ে কম প্রশিক্ষণ পেয়েছেন চট্টগ্রাম অঞ্চলের এক হাজার ৭৮১ জন শিক্ষক।

মাউশি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘সৃজনশীল পদ্ধতি নিয়ে আগে শিক্ষকদের তিন দিনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তিন দিনের এই প্রশিক্ষণ খুব একটা কার্যকর হয়নি। ফলে সম্প্রতি নতুন করে আরো এক হাজার মাস্টার ট্রেইনার তৈরি করা হয়েছে। যাঁরা এখন সৃজনশীল পদ্ধতি বিষয়ে তিন দিনের পরিবর্তে ছয় দিনের প্রশিক্ষণ দেবেন। আশা করছি এতে শিক্ষকরা এবার ভালোভাবে সৃজনশীল পদ্ধতি বুঝতে পারবেন। 

সূত্র জানায়, সৃজনশীলতা বিষয়ে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে সেকেন্ডারি এডুকেশন সেক্টর ইনভেস্টমেন্ট প্রগ্রাম (সেসিপ) নামের একটি প্রকল্পের আওতায়। এ ছাড়া মাউশি অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ শাখা থেকেও সৃজনশীল বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদরাসার শিক্ষকের সংখ্যা প্রায় সাড়ে চার লাখ। তাঁদের মধ্যে কতজন সৃজনশীল প্রশিক্ষণ পেয়েছেন এর সঠিক হিসাব কারো কাছে নেই। তবে সেসিপ প্রগ্রাম থেকে স্থানীয় প্রশিক্ষণ খাতে পরীক্ষা পদ্ধতি উন্নয়ন বিষয়ে দুই লাখ ২৪ হাজার শিক্ষকের প্রশিক্ষণ চলমান। এ ছাড়া ২০১৪ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ৬০ হাজার ৭৭০ জন শিক্ষককে সৃজনশীল বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।

 এই প্রশিক্ষণেও রয়েছে অনেক ফাঁকি। কারণ সৃজনশীল প্রশিক্ষণের জন্য প্রথমে তৈরি করা হয় মাস্টার ট্রেইনার। এই মাস্টার ট্রেইনাররাই মূলত শিক্ষকদের তিন দিনের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, মাস্টার ট্রেইনাররাই ঠিকমতো সৃজনশীল পদ্ধতি বোঝেন না। তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, কিভাবে তাঁরা প্রশিক্ষণ দিয়েছেন? এ ছাড়া প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পার্টটাইম বা খণ্ডকালীন শিক্ষক রয়েছেন, যাঁদের প্রশিক্ষণের আওতায় আনা হয়নি। দেখা যাচ্ছে তাঁরাও ক্লাসে নিয়মিত সৃজনশীল পড়াচ্ছেন।

২০০৮ সালে শুরু হয় সৃজনশীল পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে পাঠ্য বইয়ে যে মূল পাঠ রয়েছে এর থেকে প্রশ্ন না করে এরই মূলভাবের আলোকে বাইরের দৃষ্টান্ত নিয়ে প্রশ্ন করা হয়। সেই দৃষ্টান্ত থেকে জ্ঞানমূলক, অনুধাবন, প্রয়োগ ও উচ্চতর দক্ষতা—এই চারটি স্তরে বিন্যাস করে প্রশ্ন করা হয়। শিক্ষার্থীরা মূল পাঠের দৃষ্টান্ত অনুসরণে প্রশ্নের উত্তর দিয়ে থাকে। আগে মূল পাঠ থেকে পাঠ্য বইয়ে প্রশ্নপত্র থাকত। শিক্ষকরা পরীক্ষার সময় তা দেখে প্রশ্ন তৈরি করতেন। কিন্তু বর্তমানে নমুনা প্রশ্ন থাকে মাত্র একটি। পাঠ বিশ্লেষণ করে বাইরের দৃষ্টান্ত দিয়ে প্রশ্ন করার কারণে সময় নিয়ে উদ্দীপক (এক ধরনের দৃষ্টান্ত) তৈরি করতে হয়। কিন্তু এই পদ্ধতি কোনোভাবেই আত্মস্থ করতে পারছেন না শিক্ষকরা। ফলে শিক্ষার্থীদেরও ভালোভাবে বোঝাতে পারছেন না তাঁরা।

রাজধানীর কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যক্ষ মো. রহমত উল্লাহ একুশে টিভি অনলাইনকে  বলেন, ‘শিক্ষকদের আর্থিক সুবিধা কম এবং নিয়োগে অনিয়ম থাকায় এত দিন মেধাবীরা এ পেশায় আসেননি। এ কারণে এখনো অনেক অদক্ষ শিক্ষক রয়ে গেছেন। সরকারের প্রশিক্ষণ সবার জন্য একই ধরনের। একজন মেধাবী শিক্ষককে যে লেভেলে প্রশিক্ষণ দিলে তিনি তা আত্মস্থ করতে পারেন, একজন কম মেধাবী শিক্ষককে সেই লেভেলে প্রশিক্ষণ দিলে তিনি তো বুঝতে পারবেন না। তাই দক্ষ ও অদক্ষদের আলাদাভাবে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। কেউ যদি না বোঝেন তাঁকে পুনরায় প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। সৃজনশীল এই প্রশিক্ষণের ধারাবাহিকতাও থাকতে হবে।

এবিষয় জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গণযোগাযোগ ও সাংবাদিক বিভাগের অধ্যাপক আবুল মনসুর আহমেদ একুশে টিভি অনলাইনকে বলেন, সৃজনশীল নিয়ে যারা পড়াবেন  আগে তাদের সঠিক প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের দেশের শিক্ষকরা সৃজনশীন ভালো ভাবে বুঝে না। তার কিভাবে ছাত্রদের বুঝবেন। সৃজনশীল চালু হওয়ার সময় বলা হয়েছিলো শিক্ষকদের উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু তেমন কোন প্রশক্ষিণে ব্যবস্থা না থাকার কারণে সঠিক শিক্ষা পাচ্ছে না শিক্ষার্থীরা। ফলে শিক্ষার্থীর উপরে বাড়তি চাপ তৈরি হচ্ছে। শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংসের মুখে পড়ছে। এই ব্যবস্থা থেকে উত্তারণের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণায়ের উচিত তদারিক বাড়ানো। শিক্ষকদের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত ও উন্নতি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। মেধাবীদের শিক্ষকর্তা পেশায় আসতে সুযোগ সৃষ্টি করা।

এবিষয় জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরেটাস অধ্যাপক ড.আনিসুজ্জামান একুশে টিভি অনলাইনকে বলেন, সৃজনশীলের মাধ্যমে কিভাবে পাঠদান করে এ বিষয় আমার তেমন ধারণা নেই। তবে আমার মনে হয় শিক্ষার্থীদের আগে সৃজনশীল পদ্ধতি সর্ম্পকে শিক্ষকদের ধারণা দিতে হতে। শিক্ষকদের এ বিষয়ে বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদেরকে নিজেদের মতো করে লিখতে আগ্রহ তৈরি করেন না। তার চান ছাত্ররা মুখস্থ করে এসে পরীক্ষা দিক। ছাত্ররা নিজেদের থেকে লিখলে লিখার মান একটু খারাপ হবে এটাই স্বাভাবিক। এটাকে তার মেনে নিতে চান না। ফলে সৃজনশীল মুখস্থ করতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের উপর অনেক চাপ পড়ছে। তাই শিক্ষার সঠিক মান নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। এ জন্য শিক্ষার মান নিশ্চিত করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তদারকি বাড়ানো প্রয়োজন।

এব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রফেসর ইমেরিটাস ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী একুশে টিভি অনলাইনকে বলেন,  সৃজনশীল পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের আরও বেশি পরীক্ষার্থী হিসাবে গড়ে উঠছে। এ পদ্ধতি আরও বেশি সমস্যার সৃষ্টি করছে শিক্ষা ব্যবস্থায়। শিক্ষক-শিক্ষার্থী কেউ সৃজনশীল বোঝে না। তারা নোট-গাইডের আশ্রয় নেয়। শিক্ষার্থীরা গাইড পড়ে, কোচিংয়ে যায়। শিক্ষকরাও গাইড থেকে প্রশ্ন করে। এখন যারা সৃজনশীল পড়াবেন তাদের সঠিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।

টিকে