ভূমিকম্প
বাংলাদেশের ভূমিকম্প ঝুঁকির বিস্তারিত বিশ্লেষণ
জাহিদ আল আসাদ
প্রকাশিত : ১১:৩১ পিএম, ২৩ নভেম্বর ২০২৫ রবিবার | আপডেট: ১১:৩২ পিএম, ২৩ নভেম্বর ২০২৫ রবিবার
বাংলাদেশ ভূগঠনগত ভাবে প্রচন্ড ভূমিকম্প প্রবণ অঞ্চলে অবস্থান করছে। মাটির নিচের টেকটনিক প্লেট বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাংলাদেশের উত্তরে আছে ইন্ডিয়ান প্লেট এবং ইউরেশিয়ান প্লেটের সংযোগস্থল; পূর্বে বার্মিজ প্লেট ও ইন্ডিয়ান প্লেটের সংযোগস্থল। প্লেটগুলো গতিশীল থাকায় বাংলাদেশ ভূখণ্ড ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে।
ভূমিরূপ বিশ্লেষণ করে জানা যায়, আমাদের বাংলাদেশ নামের মূল ভূখণ্ডটি গড়ে উঠতে শুরু করে প্রায় চার কোটি বছর আগে। প্রথম অবস্থায় সাড়ে ৬ কোটি বছর আগে থেকে বাংলাদেশের টারশিয়ারি যুগের সোপানসমূহ গঠন শুরু হয়। তখন বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলের পাহাড়গুলো এবং সিলেট অঞ্চলের কিছু পাহাড় বাদে সমস্ত বাংলাদেশ ছিল সমুদ্রের গভীরে নিমজ্জিত।
টারসিয়ারি যুগের চট্টগ্রাম ও সিলেটের পাহাড়গুলোর গঠন সমাপ্ত হয় মোটামুটি আজ থেকে ২৫ লক্ষ বছর পূর্বে। এরপর আসে বরফ যুগ। সেই সময়টাতে বাংলাদেশের প্লাইসটোসিন কালের- ক) বরেন্দ্রভূমি, খ) মধুপুর গড়, এবং গ) লালমাই-ত্রিপুরা পৃষ্ঠ আস্তে আস্তে গড়ে ওঠে, এতে সময় লাগে ১০ হাজার থেকে ২৫ লক্ষ বছর। তখনো আজকের বাংলাদেশের প্রায় ৮০ শতাংশ ছিলো সমুদ্রের পানির নিচে। এরপর কালের পরিক্রমায় আজ থেকে ১০ থেকে ১২ হাজার বছর আগে গঙ্গা–ব্রহ্মপুত্র–মেঘনা নদীর অববাহিকার পলি জমে আমাদের বেঙ্গল ডেল্টা গঠনের কাজ মোটামুটি সমাপ্ত হয়। সে হিসেবে বলা যায়, বাংলাদেশের প্রায় ৮০ ভাগ ভূমির বয়স মাত্র ১০ হাজার বছর।
বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতির মূল সমস্যা, দেশের এই ৮০ ভাগ ভূমি দাঁড়িয়ে আছে ২২ কিমি পুরু পলি মাটির নরম sediment এর উপর। {সুত্রঃ Alam M, Alam M, Curray JR, Chowdhury MR, Gani M. 2003. An overview of the sedimentarygeology of the Bengal Basin in relation to the regional tectonic framework and basin-fill his-tory. Sediment Geol}। আর এই নরম কাদামটির ২২ কিলোমিটার পুরু স্তর ভূমিকম্পের ‘S তরঙ্গ’-কে খুব সহজে প্রবাহিত করে। নরম মাটি ভূমিকম্পের তরঙ্গকে শোষণ না করে বরং সেগুলোর তীব্রতা ২ থেকে ৩ গুণ বাড়িয়ে দেয়, যা ক্ষয়ক্ষতি বহুগুণ বাড়িয়ে তোলে।
এক দিকে, আমাদের দেশের ভূমি নরম কাদামাটি দিয়ে গঠিত তার উপর আমাদের অবস্থান ৩ টি টেকটনিক প্লেটের সংযোগস্থলে (Eurasian প্লেট, Indian প্লেট, and Burmese প্লেট) হওয়ার বিপদের মাত্রা বহুগুণ বাড়িয়েছে।
এদিকে আমাদের মাটির নিচে যেন বিপদের শেষ নেই। আমরা মুলত ভারতীয় টেকটনিক প্লেটে অবস্থান করছি। যা ৫ থেকে ৬ কোটি বছর আগে ছিল সূদূর এন্টার্কটিকা মহাদেশের সাথে লাগোয়া। তারপর ভারতীয় প্লেট দীর্ঘ পথ ভ্রমন করে একসময় ইউরেশিয়ান প্লেটের সাথে এসে ধাক্কা খায় এবং ভারতীয় প্লেটের একটা অংশ ইউরেশিয়ান প্লেটের নিচে ঢুকে যায়। যার ফলে ৫ কোটি বছর পূর্বে সৃষ্টি হয় বিশাল হিমালয় পর্বত মালা। তখন হিমালয়ের দক্ষিণে ভারতীয় প্লেট ও ইউরেশিয়ান প্লেটের সংযোগস্থলে সৃষ্টি হয় Himalayan Arc নামক পৃথিবীর সবচেয়ে সক্রিয় ভূমিকম্প প্রবণ অঞ্চল। এই হিমালয়ান আর্ক আমাদের দেশের উত্তরে অবস্থিত। এই আর্কের ঠিক নিচে অর্থাৎ বাংলাদেশের ঠিক উত্তরে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের মালভূমি শিলং প্লাটুর অবস্থান। এটি ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে স্থিতিশীল কিন্তু ভূমিকম্প-সক্রিয় অঞ্চল। এটি নিজে নড়ে না কিন্তু এর সাথে ধাক্কা খেয়ে এর দক্ষিণে বাংলাদেশ অংশের টেকটনিক প্লেটের বিভিন্ন অংশে ফাটল বা ফল্ট দেখা দিয়েছে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, শিলং প্লাটুর গা ঘেঁষে দক্ষিণেই অবস্থান করছে বাংলাদেশের অন্যতম ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল ডাউকি ফল্ট {সুত্রঃ Kamal ASMM. 2013. Earthquake risk and reduction approaches in Bangladesh. In: Shaw R,Mallick F, Islam A, editors. Urban risk reduct approaches Bangladesh. Tokyo: Springer;p. 103–130}।
ডাউকি ফল্টের দক্ষিণে আছে অন্যতম বিপজ্জনক ও সক্রিয় মধুপুর ফল্ট। এটি একটি blind fault — অর্থাৎ মাটির নিচে লুকানো, যা সরাসরি ম্যাপিং করা কঠিন। ১৮৮৫ সালের ৬.৯ মাত্রার বেঙ্গল ভূমিকম্প এর উৎপত্তিস্থল ছিল মানিকগঞ্জ। যা এই ফল্ট লাইনের কাছেই অবস্থিত। এছাড়া মধুপুর ও ডাউকি ফল্টের মাঝামাঝি ১৭৬২ সালে ৮.৫ মাত্রার ভুমিকম্পের ফলে ব্রহ্মপূত্র নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়ে যমুনা নদীর সৃষ্টি হয়েছিলো। ২০২৪ সালের ১ জুন রাজউক আয়োজিত ভূমিকম্প ঝুঁকি মোকাবিলা বিষয়ক এক সেমিনারে বলা হয়, মধুপুর ফল্টে ৬.৯ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকার ৪০% থেকে ৬৫% ভবন ধসে পড়তে পারে।
এখানেই শেষ নয়। আমাদের দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব অঞ্চলের মাটির নিচে বিশ্বের অন্যতম ভয়ংকর সুন্দা মেগাথ্রাস্টের উত্তর অংশের অবস্থান। Sunda Megathrust হলো বিশ্বের বৃহত্তম সাবডাকশন জোনগুলোর একটি, যেখানে ইন্দো-অস্ট্রেলিয়ান প্লেট ধীরে ধীরে সুন্দা প্লেট ও ইউরেশিয়ান প্লেটের নিচে ঢুকে যাচ্ছে। এটি পুরো দক্ষিণ এশিয়ার ভূমিকম্প ও সুনামি ঝুঁকির সবচেয়ে বড় উৎসগুলোর একটি। এর ৬ টি অংশের একটি অংশেই ২০০৪ সালে ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রায় ভূমিকম্প ও সুনামি হয়ে আড়াই লাখ মানুষ প্রাণ হারায়। মূলত সুন্দা মেগাথ্রাস্ট এর সর্ব উত্তরের অংশ আরাকান-বাংলাদেশ Megathrus নামে পরিচিত, এই মেগাথ্রাস্ট বাংলাদেশের জন্য ভূমিকম্পের সাথে সুনামির চরম ঝুঁকি সৃষ্টি করছে। [নোটঃ আরাকান-বাংলাদেশ Megathrus হলো ইন্দো-বর্মা (Indo-Burma) Subduction Zone–এর একটি অংশ, যা মায়ানমারের আরাকান অঞ্চল থেকে শুরু হয়ে বঙ্গোপসাগর হয়ে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব সীমা পর্যন্ত বিস্তৃত। প্রসঙ্গত, Megathrust হলো এক ধরনের অত্যন্ত বড় ও শক্তিশালী ভূমিকম্প সৃষ্টিকারী ফল্ট (fault) লাইন যা সাধারণত Subduction Zone–এ ঘটে। আর সাবডাকশন জোন বলতে, দুইটি টেকটনিক প্লেটের অংশবিশেষ যখন একটি আরেকটি ভেতরে ঢুকে যায়, ঐ অংশবিশেষকে বোঝায়। ]
বিশ্লেষণে দেখা যায়, এই Arakan-Bangladesh Megathrus অংশে বিগত ৪০০ বছরে ভূমিকম্প হয়নি। কিন্তু যেহেতু এর সন্নিহিত ইন্ডিয়ান প্লেট আস্তে আস্তে বার্মিজ প্লেটের ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে, তাই বিজ্ঞানীদের মতে এখানে ভূমিকম্প ও সুনামির ঝুকি অত্যাধিক। {সুত্রঃ Mallick R, Lindsey EO, Feng L, Hubbard J, Banerjee P, Hill EM. 2019. Active convergence ofthe India-Burma-Sunda plates revealed by a new continuous GPS network. JGR Solid Earth.124(3):3155–3171.}
এদিকে বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্ব অংশে ভারতীয় প্লেট বার্মিজ প্লেটের নিচে ঢুকে যাওয়ার ফলে আরাকান, পার্বত্য চট্টগ্রাম, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড ও মায়ানমারের চিন রাজ্যে ভঙ্গিল পর্বশ্রেণি সৃষ্টি হয়েছে ফলে এই অঞ্চলের আশেপাশেও ভূমিকম্প প্রবণ অঞ্চল গড়ে উঠেছে। কারণ এই অঞ্চল ১৮ মিলিমিটার করে প্রতি বছর সরে যাচ্ছে। {সুত্রঃ Wang Y, Sieh K, Tun ST, Lai K-Y, Myint T. 2014. Active tectonic and earthquake Myanmarregion. J Geophys Res Solid Earth.}
এছাড়া টেকনাফ থেকে মিয়ানমার পর্যন্ত প্রায় ৪০০ কিলোমিটার বিস্তৃত ফল্ট লাইনে ১৭৬২ সালে ৮ দশমিক ৫ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প হয়। ওই ভূমিকম্পেই সেন্টমার্টিন দ্বীপ প্রায় তিন মিটার ওপরে উঠে আসে; আগে সেটি ছিল ডুবন্ত দ্বীপ। এরইসাথে বঙ্গোপসাগরে সীমিত মাত্রার সুনামি দেখা দিয়েছিলো সেবার।
এদিকে কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানী ড. মাইকেল স্টেকলারের নেতৃত্বাধীন একটি গবেষক দল জানিয়েছে, বাংলাদেশের মাটির বহু মাইল পলির নিচে একটি ‘লকড অ্যান্ড লোডেড’ মেগাথ্রাস্ট ফল্ট সুপ্ত অবস্থায় রয়েছে, যা থেকে ৯.০ মাত্রা পর্যন্ত শক্তিশালী ভূমিকম্প ঘটতে পারে।
আমাদের স্থলভাগের নিচে নতুনভাবে চিহ্নিত সাবডাকশন জোন (যেখানে দুইটা প্লেট একে অপরের উপর পিছলে উঠে আটকে যায়) এর কথা জানিয়ে Columbia Climate School ২০১৬ সালে এক রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। যাতেও একই হুমকির কথা বলা হয়েছে। তা হচ্ছে, বাংলাদেশের স্থলভাগের নিচে নতুনভাবে চিহ্নিত সাবডাকশন জোন। আশ্চর্যজনক ব্যাপার হচ্ছে, সাধারণত এসব সাবডাকশন জোন মহাসাগরের নিচে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটি পুরোপুরি স্থলভাগের নিচে, যা বিপদের মাত্রাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। এ সংক্রান্ত গবেষণার ফলাফল নেচার জিওসায়েন্স–এর এক সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল।
বিভিন্ন গবেষণা বলছে, গত এক দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চল বরাবর উত্তর দক্ষিণে সাবডাকশন চলছে, এবং প্লেটের একটি বড় অংশ লক হয়ে বা আটকে গিয়ে ভয়ংকর চাপ সঞ্চয় করছে। গবেষকরা বলছেন, এর দিকে এতোদিন নজর দেয়া হয়নি। কিন্তু গতকালের ঢাকার কাছে ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্প এই আটকে থাকা সাবডাকশনের ফলাফল হিসেবে দেখছেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ প্রফেসর হুমায়ূন আখতার।
২০১৬ সালে মার্কিন সংবাদমাধ্যম CNN এর এক রিপোর্টে আশংকা প্রকাশ করা হয়, ইতিহাসে অন্তত ৪০০ বছর ধরে এই সাবডাকশন জোনে বড় কোনো মেগা-ভূমিকম্পের প্রমাণ নেই। এ সংক্রান্ত গবেষণা দলের প্রধান ড. স্টেকলার বলেন, বড় ভূমিকম্প হলে তার শক্তি ৮.২ থেকে ৯.০ মাত্রার হতে পারে. তবে তা কখন ঘটবে—তা অনিশ্চিত। “আগামীকালও হতে পারে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পূরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদি আহমেদ আনসারী জানান, বাংলাদেশের মধ্যে টেকটোনিক প্লেটের যে পাঁচটি সোর্স রয়েছে তার মধ্যে নোয়াখালী থেকে শুরু করে কক্সবাজার, নোয়াখালী থেকে সিলেট এবং আরেকটি সিলেট থেকে ভারতের দিকে চলে গেছে”। তিনি বলেন, ‘নোয়াখালী থেকে সিলেট এর দিকে যে ফল্ট লাইন গিয়েছে তারই একটি ছোট অংশ নরসিংদী।
সার্বিক ঝুঁকির পাশাপাশি ঢাকা মহানগরীর জন্য ঝুঁকি বিশ্লেষণে দেখা যায়, ঢাকা মহানগরীর জন্য সবচেয়ে গুরুতর হুমকি হলো মধুপুর ফল্ট লাইন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ফল্টটির অবস্থান রাজধানী থেকে অল্প দূরে। মধুপুর ফল্টটি উত্তর-দক্ষিণ বরাবর প্রায় একশ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত এবং এটি জামালপুর থেকে শুরু হয়ে ঢাকা নগরীর পশ্চিম পাশ ঘেঁষে কেরানীগঞ্জে শেষ হয়েছে।
আশংকার বিষয় হচ্ছে, ২০১২ সালে মধুপুর অঞ্চলের মাটিতে ফাটল দেখা গিয়েছিলো। এ ফাটলের গভীরতা ছিলো ১৫ থেকে ২০ ফিট। এছাড়া, ২০২৩ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর দুপুরে ৪.২ মাত্রার মৃদু ভূমিকম্প অনুভূত হয়। যার কেন্দ্রস্থল ছিল টাঙ্গাইলে। ঢাকার আগারগাঁও আবহাওয়া অফিস থেকে এর দূরত্ব মাত্র ৫৯ কিলোমিটার । আর গতকালের ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্পের উতপত্তি ছিল সেই মধুপুর ফল্টের কাছে নরসিংদীতে। যার দূরত্ব ছিলো আগারগাঁও থেকে মাত্র ১৩ কিলোমিটার।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এগুলো যদি ৮ মাত্রার বড় কোনো ভূমিকম্পের ফোরশক হয়, তবে ঢাকাসহ দেশের মধ্যাঞ্চল ও দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের জন্য এক অকল্পনীয় ও ভয়াবহ পরিণতি অপেক্ষা করছে, যা হয়তো বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বিভৎষ ঘটনা হিসেবে কালো হরফে লিখা থাকবে।
