ঢাকা, শনিবার   ১৮ মে ২০২৪,   জ্যৈষ্ঠ ৪ ১৪৩১

মানবিক মানুষ হতে চাই, গল্প নয় সত্যি!  

মাসুদ আকন্দ

প্রকাশিত : ০৭:৪২ পিএম, ৮ জুন ২০১৮ শুক্রবার | আপডেট: ০৬:০৬ পিএম, ৯ জুন ২০১৮ শনিবার

৩০শে মে, কক্সবাজার যাওয়ার পথে কর্ণফুলী ব্রিজের উপরে দাঁড়ালাম ব্রিজ থেকে নদীর কিছু ছবি তুলবো বলে। বিশাল ব্রিজ, চমৎকার ভিউ। দূরে ব্রিজের উপরের অংশে কাপড়ের পোটলার মতো কিছু একটা পড়ে আছে আর শত শত মানুষ তার পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। কেউ কেউ পোটলার দিকে তাকাচ্ছে কিন্তু কেউ থামছে না। প্রচণ্ড রোদে তেঁতে হয়ে আছে রাস্তা। আমার রোদে দাড়িয়ে থাকতেই কষ্ট হচ্ছিল তবু আরেকটু ভালো ভিউয়ের জন্যে আমার ফটোগ্রাফার নিকলাসকে বললাম, চলো উপরের দিকে যাই আরও ভালো ভিউ পাওয়া যাবে।

কিছু দুর উঠার পরেই কাপড়ের পোটলাটিকে আমার মনে হল এটা কোন কাপড়ের পোটলা নয় বরং একজন মানুষ পড়ে আছে। আমার হৃদপিণ্ডে ধাক্কার মতো লাগলো। আগুণের মতো গরম ব্রিজ, জুতা থাকার পরেও পায়ে গরম অনুভব করছি। এই রাস্তায় কারো পক্ষে শুয়ে থাকা সম্ভব না। আমি একটু দৌড়ের মতো করেই জোরে হেঁটে কাছে গেলাম ভালো ভাবে দেখার জন্যে।  

৭০/৭৫ বছরের একজন বৃদ্ধা পরে আছেন। ডাঙ্গায় তোলা মাছের মতো মুখ হা করে দম নিচ্ছেন। আর মুখ দিয়ে ফেনা গড়িয়ে পড়ছে। যে কোন মুহূর্তে আত্মা বেড়িয়ে যাবে মনে হচ্ছে। হয়তো পেশাব করে দিয়েছেন শারীরিক যন্ত্রণায়, কারন পানির একটা রেখা নিচের দিকে বয়ে গেছে তাঁর কোমরের কাছ থেকে। হয়তো রোজা রেখেছে হেঁটে ব্রিজ পাডর হচ্ছিলেন এবং তাঁর হিট স্ট্রোক হয়েছে।

আমার নিজের নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। কি করবো বুঝে উঠতে সময় লাগছিল। ততক্ষণে নিকলাস ও আমার সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার লর্স (স্টকহোম ফিল্মস্কুলে ২০০৬-২০০৮ আমাদের সাউন্ড পড়িয়েছেন তিনি) কাছে এসে পড়েছেন। লর্স আমার পাশে বসে বৃদ্ধার পালস দেখলেন। নিকলাস নিজের গায়ের জামা খুলে বৃদ্ধার উপরে ছায়া দিলেন। লর্স বৃদ্ধার মুখে পানি দিলেন। উনাকে এখনি হাসপাতালে নেয়া দরকার কিন্তু আমাদের গাড়ি রাস্তার উল্টা পাশে কক্সবাজারের দিকে মুখ করা। সেটাকে আসতে হলে অনেক দূর ঘুরে আসতে হবে। চট্ট্রগ্রামের ট্রাফিকে সেটা অনেক সময়ের ব্যপার। আমি লাফ দিয়ে রাস্তায় নেমে গেলাম রিক্সা গাড়ি যা পাই তাই থামানোর জন্যে। কিন্তু কেউ থামছে না। আমাকে পাশ কাটিয়ে সাই সাই করে চলে যাচ্ছে সবাই।

আমি আবেগপ্রবণ, মানুষের অবহেলা আর নিষ্ঠুরতা হজম করার শক্তি আমার নেই। চিৎকার করে মানুষকে গালাগালি শুরু করেছি। কেউ আমার গালির প্রতিবাদ করছে না, কাপুরুষেরা কখনো সেটা করেও না। তবে একজন নির্মাণ শ্রমিক এগিয়ে এলেন রাস্তার ওপার থেকে। সে আর আমার সহকারী খোকনদা একটা ব্যটারি রিক্সা থামালেন। লর্স কোলে করে বৃদ্ধাকে রিক্সায় তুললেন। তাঁকে হাসপাতালে নেয়া হল।

আমার বিদেশি বন্ধুদের কাছে আমি সব সময় বাঙালির কমল হৃদয়ের গল্প করি কিন্তু সেই দিনের সেই ব্রিজের উপরে যা হল তার লজ্জা আমাকে এখনো যন্ত্রণা দিচ্ছে। আমি কখনোই হয়তো আর বাঙালির কমল হৃদয় নিয়ে বিদেশি বন্ধুদের সামনে কোন বাক্য বলতে পারবো না।

একটা কাক মরে গেলে হাজার হাজার কাক জোড়ো হয়ে যায় কিন্তু মানুষ মানুষের জন্যে না! কি মানে আমাদের এই সভ্যতার যদি আমরা চোখের সামনে একজনকে মরতে দেখেও এক মুহূর্তের জন্যে না দাঁড়াই? এতো বিদ্যা, এতো উন্নয়ন দিয়ে আমাদের কি হবে যদি আমরা মানুষই হতে না পারি?

এসি