ঢাকা, শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ৫ ১৪৩১

এসিডে পুড়ে যাওয়া মানুষের ঠিকানা এএসএফ

প্রকাশিত : ১০:৪৮ পিএম, ১৬ জুলাই ২০১৮ সোমবার

সমাজে সহিংসতার অনেকগুলো রকমের মধ্যে একটি এসিড নিক্ষেপ। এক সময় শুধুমাত্র নারীরা এসিড সন্ত্রাসের শিকার হলেও সাম্প্রতিক সময়ে পুরুষরাও এসিডে আক্রান্ত হচ্ছে এমন ঘটনা অহরহ দেখা যায়।

এসিডে পুড়ে যাওয়া মানুষের চিকিৎসা করা, আইনী সহায়তা দেওয়া, এসিড সন্ত্রাস প্রতিরোধ করাসহ নানা বিষয় নিয়ে কাজ কাজ করে এসিড সার্ভাইভারস ফাউন্ডেশন। প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন দিক নিয়ে আলী আদনানের দুই পর্বের প্রতিবেদনের প্রথম পর্ব।

পারভীন আক্তার। গ্রামের সবাই ডাকে ডলি নামে। বাবা দিনমজুর। অনেকগুলো ভাইবোন। নুন আনতে পানতা ফুরায় অবস্থা। পেটে যখন ভাত থাকেনা পড়াশুনা তখন বিলাসিতা। ফলে স্কুলে যাওয়া হয়না ডলি`র। ক্লাস ফাইভ পাস করা ডলি চাকরী নেয় স্থানীয় একটি রি রোলিং মিলে। আসা যাওয়ার পথে ডলির পরিচয় হয় স্থানীয় ট্যাক্সি চালক জাফরের সঙ্গে। সেই পরিচয় সকল সময়ের ব্যবধানে রূপ নেয় প্রেম থেকে বিয়েতে।

অবশ্য বিয়েতে জাফরের পরিবার পক্ষের কেউ রাজী ছিলেন না। এরপরও জেদাজেদীর কাছে হার মানে সবাই। বিয়ের পর প্রথম কিছুদিন সুখেই কাটে ডলির। তারপর থেকেই বেরিয়ে আসতে থাকে জাফরের আসল চেহারা। যৌতুকের জন্য চাপ দিতে শুরু করে ডলিকে। সেই চাপে বাধ্য হয়ে প্রথম প্রথম ডলির দিনমজুর বাবা ছোট খাট দাবি মেটালেও একপর্যায়ে গিয়ে তা আর সম্ভব হয়না। তখন নেমে আসে ডলির উপর অত্যাচার। এক সময়ের প্রেমিক পুরুষটি হয়ে উঠে বিভীষীকাময়। রাতের অন্ধাকারে ঘুমন্ত অবস্থায় ডলির গায়ে (গলা থেকে তলপেট পর্যন্ত) এসিড ঢেলে দেয় জাফর।

সে এক অবর্ণনীয় কঠিন সময়। নিম্নবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর জন্য দেশে চিকিৎসা ব্যবস্থা এমনিতেই কঠিন ও ব্যায়বহুল। তার উপর এসিড দগ্ধদের জন্য দেশের প্রেক্ষাপট ছিল সম্পূর্ণ প্রতিকূলে।

 

এতোক্ষণ যে ঘটনাটি বলছিলাম তা ১৯৯৬ সালের ঘটনা। ইতোমধ্যে দেশে পাল্টে গেছে অনেক কিছু। পরিচিত দৃশ্য হয়ে গেছে অপরিচিত। ডলি যদিও ভাল আছে তবে তার জন্য তাকে দেশ বিদেশে নিতে হয়েছে প্রচুর চিকিৎসা। ২০১২ সালের মধ্যে তাকে নিতে হয়েছে সতেরটি অস্ত্রোপাচার। এখনো পর্যন্ত তার শরীরে অস্ত্রোপাচারের সংখ্যা বাইশটি। তবু ডলি মনে করছে সে পুরোপুরি সুস্থ নয়। গরম বেশি পড়লে আক্রান্ত স্থান চুলকায়। আঙ্গুলগুলো বেঁকে গেছে।

এমন ডলি দেশে একজন নয়। ডলিদের এমন আর্তনাদের কাহিনীও নতুন নয়। অসংখ্য ডলি জীবন-মরণ লড়াইয়ের কোল ঘেঁষে ঘুরে দাঁড়ালেও লড়াই করতে করতে জীবনের সকল শক্তি নি:শেষ হয়ে যায়।

এরকম ডলিদের কথা চিন্তা করেই ১৯৯৯ সালে গঠিত হয় এসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশন বা এএসএফ। এএসএফের প্রতিষ্ঠার আগে এসিড হামলায় আক্রান্তদের চিকিৎসার ও পুনর্বাসন এবং এসিড সন্ত্রাসের প্রতিরোধের জন্য কোন সমন্বিত উদ্যোগ ছিল না। ফলে বাংলাদেশে এসিড সন্ত্রাস ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করে।

ঢাকা মেডিকেলের বার্ণ ইউনিটে এসিডদগ্ধদের চিকিৎসা হতো। অবশ্য বেশ কিছু এনজিও বিচ্ছিন্নভাবে এসিড আক্রান্ত নারীদের আইনি ও অন্যান্য সহযোগিতা করত। কিন্তু তা ছিল অপর্যাপ্ত।

এই চিন্তাধারা থেকেই শুধুমাত্র এসিডকে উপলক্ষ করে একটি স্বাবলম্বী প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। এই প্রেক্ষাপটের এক পর্যায়ে ১৯৯৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ইউনিসেফ প্রণীত একটি প্রতিবেদনে এসিড হামলায় আক্রান্তদের সাহায্য এবং পুনর্বার আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি রোধকল্পে এ ধরনের একটি ফাউন্ডেশন গঠনের সুপারিশ করা হয় এবং পাশাপাশি এর অপরিহার্যতার প্রতিও সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় কানাডিয়ান ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এজেন্সি এবং ইউনিসেফ একসাথে কাজ করা শুরু করে। ১৯৯৯ সালের ১২ মে যাত্রা শুরু করে এএসএফ। তখন এর কার্যালয় ছিল রাজধানীর বনানীতে। পরে তা মীরপুরের ১৪ নম্বর সড়কে স্থানান্তর করা হয়।

মূলত এসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশন বা এএসএফ-এর লক্ষ্য হচ্ছে এসিড সন্ত্রাসের নিয়ন্ত্রণ করতে করতে শূণ্যের কোঠায় নিয়ে যাওয়া। বাংলাদেশে এসিড আক্রান্তরা যাতে মাথা তুলে বাঁচতে পারে সেটা নিশ্চিত করাও তাদের লক্ষ্য।

প্রতিষ্ঠানটি গঠনের পর থেকেই এএসএফ বৈশ্বিক পরিচিতি লাভ করে লিঙ্গ বৈষম্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য। এসিড সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কার্যকরী পদক্ষেপ নেয় এমন সংস্থা খুব কমই আছে। এসিডে পুড়ে যাওয়া ব্যক্তির জন্য উন্নত সেবাদান করে থাকে এএসএফ। ২০ শয্যার পূর্ণ হাসপাতাল রয়েছে এখানে। প্লাস্টিক সার্জারী ও চেহারায় আকার আকৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ এমন কিছু যন্ত্রপাতি আছে যা আধুনিক প্রযুক্তির ও দগ্ধ হয়ে যাওয়া ব্যক্তির চিকিৎসার জন্য প্রযোজ্য। এএসএফ-এর হাসপাতালগুলো আক্রান্ত ব্যক্তিকে মানসিক সেবা, আইনী ও আর্থিক সহায়তা দিয়ে থাকে পুরোপুরি।

এসিড সার্ভাইভারস ফাউন্ডেশন জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে প্রতিরোধ ক্যাম্পেইন গড়ে তোলে। এবং আক্রান্তদের সহ সবার কাছে সতর্কতামূলক বার্তা পৌঁছে দেয়। এসিড সন্ত্রাস থেকে কিভাবে রুখে দাঁড়াতে হয় সেই বিষয়ে তথ্যমূলক বইও প্রচার করে থাকে তারা। অস্বীকার করার উপায় নেই সাম্প্রতিক সময়ে এসিড সন্ত্রাসের ভয়াবহতা অনেক কমেছে। এর থেকে বুঝা যায় এসিড সার্ভাইভারস ফাউন্ডেশনের সফলতা দৃশ্যমান হচ্ছে ধীরে ধীরে। আর এই সাফল্যের পেছনে সরকারি সাহায্য ও সামাজিক চিন্তা চেতনার উন্নতি রয়েছে। ২০০২ সাল থেকে এএসএফ-এর ক্যাম্পেইন শুরু করে।

এক. এসিডদগ্ধদের সর্বোন্নত চিকিৎসা-সহায়তা নিশ্চিত করা

দুই. এসিডদগ্ধদের সুবিচার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি

তিন. এসিডদগ্ধদের আর্থিক পুনর্বাসনসহ তাদের সমাজ ও উন্নয়নের মূলধারায় সম্পৃক্ত করা

চার. এসিড-সহিংসতা ধীরে ধীরে কমিয়ে এনে বন্ধ করার লক্ষ্যে সমাজের সব শ্রেণী, পেশা ও স্তরের মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা ও এ সহিংসতা মোকাবিলায় যুক্ত করা।

উপরোক্ত চারটি উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য এএসএফ পাঁচটি ইউনিটের মাধ্যমে কাজ করে চলেছে। ইউনিটগুলো হলো নোটিফিকেশন ইউনিট, মেডিকেল ইউনিট, আইনি সহায়তা ইউনিট, সামাজিক পুণর্বাসন ইউনিট, গবেষণা অ্যাডভোকেসি ও প্রতিরোধ ইউনিট।

এসিড হামলার ঘটনা বাংলাদেশের যে স্থানেই ঘটুক না কেন, এএসএফ যাতে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে জানতে পারে ও রেকর্ডভুক্ত করতে পারে এবং রিপোর্ট পাওয়ার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে যেন এসিডদগ্ধ ব্যক্তিকে চিকিৎসার আওতায় নিয়ে আসতে পারে।

আক্রান্ত ব্যক্তিকে যত দ্রুত সম্ভব এএসএফের হাসপাতাল জীবনতারায় স্থানান্তর করে। ২০ শয্যাবিশিষ্ট এই হাসপাতালে গড়ে তোলা হয়েছে দেশে-বিদেশে পাওয়া সর্বোন্নত চিকিৎসা ও নার্সিং কেয়ার ব্যবস্থা।

এ ইউনিট মামলাগুলো সহযোগী সংস্থার কাছে পাঠিয়ে দিয়ে মামলার অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করে, আক্রান্তদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে এবং মামলার গৃহীত ব্যবস্থা সম্পর্কে তাদের ও তাদের পরিবারের কাছে ব্যাখ্যা করে। নিয়মিত আইন ও আইনি পদক্ষেপ বিষয়ে প্রশিক্ষণ কর্মশালার আয়োজন করে যাচ্ছে।

এসিড-আক্রান্তদের পরিবারকে তাৎক্ষণিক দুর্যোগ মোকাবিলায় আর্থিক সহায়তা দেওয়া, আক্রান্ত ছেলেমেয়ের লেখাপড়া চালিয়ে যেতে বৃত্তি দেওয়া, দক্ষতা উন্নয়নমূলক ও কাজভিত্তিক প্রশিক্ষণের আয়োজন, আক্রান্তদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা এবং উদ্যোক্তাদের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন।

সমাজের চোখে এসিড নিক্ষেপকে ঘৃণ্য অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করার জন্য পুরুষদের অংশগ্রহণে তারা নিয়মিত আয়োজন করে চলেছে সভা, সেমিনার ও কর্মশালা। এসিড-সহিংসতা সম্পর্কিত আইনের প্রচার, এসিড অপরাধীদের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন, বিনা লাইসেন্সে এসিড বিক্রি প্রতিরোধ  এসবও এএসএফ- এর কর্মসূচীর আওতাভুক্ত।

/আআ/