ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৫ ১৪৩০

ক্রেডিট কার্ডের উচ্চ সুদে পকেট শূন্য গ্রাহকদের 

রিজাউল করিম

প্রকাশিত : ০৯:৩২ পিএম, ১৯ জুলাই ২০১৮ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ০৪:৫২ পিএম, ২১ জুলাই ২০১৮ শনিবার

দেশের ব্যাংকগুলোতে শিল্প ও প্রস্তুতকারক খাতের মেয়াদি ও চলতি মূলধন ঋণের সুদ সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনা হয়েছে। ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানেও এ সুদহার কমানো হয়েছে। ব্যাংক ঋণে সুদ কমানোর এ স্রোতধারার উল্টো পথে ক্রেডিট কার্ডের সুদ হার। অন্যান্য ঋণে সুদ হার যখন ৯ শতাংশের নিচে, তখন ক্রেডিট কার্ডে সুদহার সর্বোচ্চ ৩৬ শতাংশ পর্যন্ত। কোনো ধরনের নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে ব্যাংকগুলো উচ্চ সুদের যাতাকলে ক্রেডিট কার্ডধারীদের পকেট শূণ্য করছে বলে গ্রাহকদের অভিযোগ।     

শিল্প ঋণের পাশাপাশি কোনো কোনো ব্যাংক এসএমই ও নারী উদ্যোক্তাদের ঋণের সুদও কমিয়ে ৯ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। সম্প্রতি আইপিডিসি ফাইন্যান্স নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ৮ শতাংশ সুদে ঋণ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। অথচ ঋণ কমানোর এ প্রভাব পড়েনি ক্রেডিট কার্ডে।ফলে ক্রেডিট কার্ডে ঋণের সুদহার এখনও অনেক বেশিই রয়ে গেছে।  

তবে দীর্ঘদিন ধরেই ক্রেডিট কার্ডের ঋণের সুদহার অন্যান্য ঋণের থেকে বেশি। ক্রেডিট কার্ডের সুদহার সহনীয় মাত্রায় রাখার জন্য গত বছরে মে মাসে ক্রেডিট কার্ড নীতিমালা জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে ভোক্তা ঋণের সর্বোচ্চ সুদহারের সঙ্গে আরো ৫ শতাংশ যোগ করে ক্রেটিট কার্ডের ঋণের সুদহার নির্ধারণের সুযোগ দেওয়া হয়। কিন্তু পরে ব্যাংকগুলোর চাপে ওই বছরের আগস্টে ওই নির্দেশনা বদলে বিদ্যমান ঋণের মধ্যে সর্বোচ্চ সুদহারের সঙ্গে আরো ৫ শতাংশ সুদ যোগ করে ক্রেডিট কার্ডের ঋণের সুদহার নির্ধারণের সুযোগ দেওয়া হয়। চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি থেকে এই নীতিমালা কার্যকর করতে বলা হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশণা পালন করা হলে বর্তমানে শিল্পঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ৯ ডিজিট ধরে ক্রেডিট কার্ডে সর্বোচ্চ সুদ হার হওয়ার কথা ১৪ শতাংশ। অথচ ব্যাংকগুলোতে এখন ক্রেডিট কার্ডে সর্বোচ্চ সুদ ৩৬ শতাংশ পর্যন্ত নেওয়া হচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বেসরকারি বিদেশি স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের ভিসা ও মাস্টারসহ কয়েক ধরনের ক্রেডিট কার্ড রয়েছে। এই ব্যাংকটির ক্রেডিট কার্ড গ্রাহকরা কার্ডের বিপরীতে কোনো ঋণ নিলে বছরে সুদ দিতে হবে ৩৬ শতাংশ। এ ছাড়া ঋণ প্রক্রিয়াকরণ ফি ও বার্ষিক ফিসহ অন্যান্য ফি এবং এর ওপর ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট বা মূসক তো রয়েছেই।

ব্র্যাক ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ডের ঋণের বার্ষিক সুদহার ২৭ শতাংশ। মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ডের ঋণের বার্ষিক সুদহার ২১ থেকে ২৩.৫০ শতাংশ (কার্ড ভেদে)।

দি সিটি ব্যাংকের ভিসা ক্রেডিট কার্ডের ঋণের সুদ মাসে ২.৫ শতাংশ। অর্থাৎ এই ব্যাংকটির ভিসা ক্রেডিট কার্ডের বিপরীতে ঋণ নিলে বছরে ৩০ শতাংশ হারে ১০০ টাকা সুদ দিতে হবে ৩০ টাকা। ব্যাংকটির আমেরিকান এক্সপ্রেস ক্রেডিট কার্ডের ঋণের মাসিক সুদহার ২.২৫ শতাংশ। অর্থাৎ আমেরিকান এক্সপ্রেস ক্রেডিট কার্ডের বিপরীতে ঋণ নিলে বছরে ১০০ টাকায় সুদ গুনতে হবে ২৭ টাকা। এ ছাড়া এই কার্ড ব্যবহার করে কিস্তিতে পণ্য কিনলে সমান মাসিক কিস্তির (ইএমআই) জন্য বার্ষিক সুদ গুনতে হবে ১৭ শতাংশ হারে।

ইস্টার্ন ব্যাংকের সব ধরনের ক্রেডিট কার্ডের ঋণের সুদহার মাসিক ২ শতাংশ। অর্থাৎ এই ব্যাংকটির ক্রেডিট কার্ডধারীদের ঋণের বিপরীতে বছরে সুদ গুনতে হবে ২৪ শতাংশ হারে। এই ব্যাংকটি সমান মাসিক কিস্তির ঋণে কোনো সুদ আরোপ করে না।

যমুনা ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ডে ১৫ শতাংশ, ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ১৮ শতাংশ, ঢাকা ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ডে ২৪ শতাংশ, এবি ব্যাংকের ২৫ শতাংশ, আইএফআইসি ব্যাংকের ২৭ শতাংশ সুদ দিতে হচ্ছে ক্রেডিট কার্ডধারীদের।

দেশের দ্বিতীয় প্রজন্মের একটি বেসরকারি ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারকারী মুসলিমা করিম। তিনি সুদের এ উচ্চ হারে ক্ষোব প্রকাশ করে বলেন, ১ পয়সাও লিমিট ক্রস করলে ৪শ’ থেকে সাড়ে ৪শ’ টাকা ‘ওভার লিমিট ফি’, আবার লাস্ট ডেট ছুটির দিন হলেও ‘লেটপেমেন্ট ফি’সহ নানা রকম হিডেন চার্য। নানা অজুহাতে ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ সুদ হারের এ তালবাহনার ঋণ ‘মরণ ফাঁদ’ ছাড়া আর কিছুই না। লাস্ট ডেট ছুটির দিন হলেও পরের অফিস ডেতে লেটপেমেন্ট ফি ছাড়া বিল পরিশোধ করা যায় না। সবচেয়ে বড় ধরনের ধোঁকাবাজি। বহু কষ্টে এর থেকে বের হতে পেরেছি। উচ্চ সুদ হার থেকে রক্ষা পেতে আমি কার্ডটি এরই মধ্যে ফিরিয়ে দিয়েছি।

তিনি বলেন, এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের যথাযথ ও সুনির্দিষ্ট দিক নির্দেশনা থাকা দরকার। তা না হলে গ্রাহকরা এভাবে ঠকতেই থাকবে। ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের চুষে নিজেদের পেট ভরবে।   

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা অর্থনীতিবীদ ড. এবি মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, দেশের শিল্প বা উৎপাদনমুখী খাতের ঋণে সুদ হার আর ক্রেডিট কার্ডে সুদ হার এক হবে না, ক্রেডিট কার্ডে একটু বেশি হবে এটাই স্বাভাবিক।কিন্তু সেটা খুব বেশি হলেই আপত্তিকর। ব্যাংক সংশ্লিষ্টে এসব অযাচিত বিষয়ের নিয়ন্ত্রণকারী বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন ক্রেডিট কার্ডে সুদের হার বেশি মনে হলে তার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়ন্ত্রণমূলক নির্দেষণা দিতে পারে। এ ক্ষেত্রে প্রকাশ্য সুদের পাশাপাশি যদি হিডেন চার্জ নিয়ে তফসিলি ব্যাংকগুলো কোন অনিয়ম করে, তবে ভুক্তভোগীদের উচিত হবে সরাসরি বাংলাদেশ ব্যাংকে অভিযোগ দেয়া। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরও উচিত হবে অভিযোগ অনুযায়ী কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া।  

বেসরকারি স্ট্যান্ডার্ন্ড ব্যাংক লিমিটেডের সাবেক ব্যাবস্থাপনা পরিচালক (বর্তমান স্বতন্ত্র পরিচালক) মো. নাজমুস সালেহীন বলেন, ক্রেডিট কার্ডে সুদহার আসলেই অনেক বেশি। এটা আমিও স্বীকার করি।তবে এটাও সত্য যে ক্রেডিট কার্ড সমাজের বিত্তবানরাই ব্যবহার করেন। এ কার্ডের ঋণ উৎপাদনমুখী কোন খাতের নয়। তাছাড়া ক্রেডিট কার্ডে একজন গ্রাহককে সাধারণত ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা ঋণ দেওয়া হয়। আর শিল্প ঋণে ৫ লাখ থেকে কোটি টাকা পর্যন্ত দেওয়া হয়। উভয় ঋণ হিসাবে রাখতে খরচ একই হয়। অথচ ক্রেডিট কার্ডে স্বল্প ঋণের কারণে সুদ কম হয়।সব মিলিয়ে ব্যাংকের খরচ পোশাতে ক্রেডিট কার্ডে সুদ বেশি হয়। তবে এটা বর্তমানের চেয়ে কমানো উচিত বলে আমি মনে করি।  

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, সরকার উৎপাদনমুখী খাতে দেওয়া ঋণে সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে কমানোর কথা বলেছেন।যদিও এখনও তা সব ব্যাংকে কমেছে কিনা প্রশ্নসাপেক্ষে। এখন কথা হলো ক্রেডিট কার্ডে ঋণের সুদ হার অন্য ঋণে সুদহারের তুলনায় বেশি। এই বেশিটা এতো বেশি, যে পৃথীবীর সব দেশকেও টপকে গেছে। এটা কমিয়ে আনতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরদারি বাড়াতে হবে।

তবে ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ব্যাংকগুলো অনেক ধরনের ঋণের সুদহার কমিয়েছে। তার পরও কোনো কোনো ঋণের সুদহার ১৮ থেকে ১৯ শতাংশ আছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, বিদ্যমান ঋণের মধ্যে যেটা সর্বোচ্চ হার সেই হারের সঙ্গে ৫ শতাংশ যোগ করে ক্রেডিট কার্ডের সুদহার নির্ধারণ করতে। ব্যাংকগুলো সেটাই করছে।

তিনি বলেন, ক্রেডিট কার্ড মূলত কেনাকাটার জন্য দেওয়া হয়। এটা দিয়ে একজন গ্রাহক ৪৫ দিন পর্যন্ত বিনা সুদে ব্যাংকের টাকায় কেনাকাটা করতে পারে। কেউ যদি ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে ঋণ করতে চায় তাহলে তাকে একটু বেশি সুদ দিতে হবে। সারা বিশ্বেই ক্রেডিট কার্ডের সুদহার বেশি।

আরকে//এসি