ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৮ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৪ ১৪৩০

ঢাবিতে সান্ধ্যকোর্সের দাপটে দিশেহারা নিয়মিত শিক্ষার্থীরা

তবিবুর রহমান

প্রকাশিত : ০৩:১৩ পিএম, ২১ জুলাই ২০১৮ শনিবার | আপডেট: ১১:৪৯ এএম, ২২ জুলাই ২০১৮ রবিবার

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) দিন দিন বাড়ছে সান্ধ্যকালীর কোর্সের দাপট। সহজেই ঢাবির সনদ লাভের আশায় অনেকেই ভর্তি হচ্ছে এই কোর্সে। ভর্তি পরীক্ষা সহজ হওয়ায় তুলনামূলক অল্প মেধাবীরাও এখানে ভর্তির সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে। এর ফলে সান্ধ্যকালীন কোর্সগুলোয় শিক্ষার্থীর সংখ্যা নিয়মিত শিক্ষার্থীদের দ্বিগুণের চেয়েও বেশি হয়ে যাচ্ছে।

এদিকে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হলেও ঢাবির সান্ধ্যকোর্সে নেওয়া হচ্ছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো টিউশন ফি। বাড়তি আয়ের আশায় শিক্ষকরা নিয়মিত ব্যাচগুলোর চেয়ে সন্ধ্যাকোর্সে ক্লাস নিতে বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছেন। এ নিয়ে নিয়মিত শিক্ষার্থীদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। চাকরি বাজারে প্রতিযোগী বেড়ে যাওয়ায় তারা কিছুটা দিশেহারাও।

সান্ধ্যকালীন কোর্সে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেশ কয়েকটি কারণে সান্ধ্যকোর্সে শিক্ষার্থীদের ভিড় বাড়ছে। প্রথমত : এখানে ভর্তি হতে পারলে খুব সহজেই ঢাবির সার্টিফিকেট মিলছে। দ্বিতীয়ত: নিয়মিত কোর্সগুলোতে ভর্তির জন্য যে পরীক্ষা নেওয়া হয় তা খুবই কমপিটিটিভ। কিন্তু বেশিরভাগ বিভাগে সান্ধ্যকোর্সে ভর্তির জন্য নামকাওয়াস্তে পরীক্ষা নেওয়া হয়। যে কারণে তুলনামূলক  কম মেধাবীরাও সহজেই এখানে ভর্তি হতে পারছেন। তৃতীয়ত: ছাত্র রাজনীতি, ছাত্র সংগঠনের পদপদবির আশায় ছাত্রত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থে অনেকেই এই কোর্সগুলোয় ভর্তি হচ্ছে। চতুর্থত: ঢাবিতে পড়ার ক্র্যাজ। অনেক তরুণের মধ্যেই ঢাবির ছাত্র পরিচিতিটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ক্যাম্পাসের মজা নিতেও অনেকে এসব কোর্সে ভর্তি হচ্ছে।    

ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীরা জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সান্ধ্যকার্সের ভর্তির সুবিধা হচ্ছে- এখানে পড়ে খুব সহজেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট পাওয়া যায়। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত শ্রেণীকক্ষ, লাইব্রেরি ফ্যাসিলিটি, পরিবহণসহ নানা সুবিধা রয়েছে। এসব সুবিধার কারণে কোনো কোনো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে দ্বিগুন অর্থ ব্যয় করে হলেও শিক্ষার্থীরা ঢাবিতে ভর্তিতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন।

এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিটি বিভাগেই বাড়ানো হয়েছে সান্ধ্যকালীন কোর্সের ফি। এমবিএ বিভাগে এক শিক্ষার্থী জানান, ১বছর মেয়াদী কোর্সে ২ লাখ ৮৬ হাজার টাকা গুনতে হয়, এর মধ্যে সেমিস্টার ফি প্রতি সেমিস্টারে ৫ হাজার টাকা। রেজিস্ট্রেশন ফি ১০ হাজার টাকা, কম্পিউটার ব্যবহার ফি ৫ হাজার টাকা লাগে। উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগে দেড় বছর মেয়াদী মাস্টার্স প্রোগ্রামে কোর্স ফি গুনতে হয় ১ লাখ ৫০ হাজার টাকার মতো। তবুও কমতি নেই শিক্ষার্থীর।

এদিকে শিক্ষকরা নিয়মিত ব্যাচগুলোর চেয়ে সন্ধ্যাকালীন কোর্সের ক্লাস নিতেই বেশি আগ্রহী বলেই অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে নিয়মিত শিক্ষার্থীদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। নিয়মিত শিক্ষার্থীর অভিযোগ, অসুস্থর কারণ দেখিয়ে নিয়মিত ক্লাস ও পরীক্ষার জন্য যে শিক্ষক আসতে পারেননি সেই শিক্ষকই আসেন সন্ধ্যাকালীন কোর্সে ক্লাস নেওয়ার জন্য। আবার কেউ কেউ আসেন শুধু সন্ধ্যাকালীন কোর্সের ক্লাস নেওয়ার জন্য। ফলে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত শিক্ষার্থীরা।  

এদিকে ব্যাংকসহ বেশ কিছু চাকরিতে এমবিএ ডিগ্রিধারীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। ওইসব ক্ষেত্রে সান্ধ্যাকোর্সের ডিগ্রিধারীরাও পরীক্ষার সুযোগ পেয়ে যাচ্ছেন। ঢাবির নিয়মিত শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, এতে করে চাকরি বাজারে তাদের প্রতিযোগী বেড়ে যাচ্ছে। এমনিতেই চাকরি পেতে বেশ বেগ পোহাতে হচ্ছে, সেখানে অনিয়মিতদের দাপটে নিয়মিতদের দিশেহারা অবস্থা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুধুমাত্র সান্ধ্যকালীন বিভিন্ন বিভাগে আলাদা অফিস খোলা হয়েছে, যাদের কাজ শুধু সান্ধ্যকালীন শিক্ষার্থীদের প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনা করা। সান্ধ্যকালীন কোর্সের মাত্রাতিরিক্ত ঝোক নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে বিভিন্ন মহলে। বিভিন্ন সময় সান্ধ্যকালীন কোর্সবন্ধে দাবি জানিয়ে আসছেন শিক্ষার্থীরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ২৫টি বিভাগ ও ৮টি ইনস্টিটিউটেই সান্ধ্যকোর্স চালু রয়েছে। প্রতিবছর এই ৩৩টি বিভাগ ও ইনস্টিটিউটে স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে নির্বাচিত হয়ে চূড়ান্তভাবে ভর্তি হতে পারেন সর্বোচ্চ আড়াই হাজার নিয়মিত শিক্ষার্থী। আবার এই ৩৩টি বিভাগ ও ইনস্টিটিউটেই সান্ধ্যকোর্সে প্রতি বছর ভর্তি হন প্রায় চার হাজার শিক্ষার্থী। এই চার হাজার শিক্ষার্থীর কাছ থেকে প্রতি বছর আদায় করা হয় অন্তত ৬৬ কোটি টাকা। এই অর্থের ৬০ শতাংশই পান কোর্স সংশ্লিষ্ট শিক্ষকরা। সান্ধ্যকোর্সের আয়ের একটি নির্দিষ্ট অংশ বিশ্ববিদ্যালয় কোষাগারে জমা দেওয়ার নিয়ম থাকলেও খুব কম বিভাগই এটি মানছে। 

ঢাবির কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. কামাল উদ্দিন বলেন, সান্ধ্যকালীন কোর্সের কারণে গত কয়েক বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যুৎ বিল কয়েকগুণ বেড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ হচ্ছে জ্ঞান সৃষ্টি ও বিতরণ; কিন্তু অর্থবিহীন ও নামে-বেনামে অসংখ্য সান্ধ্যকালীন মাস্টার্স প্রোগ্রাম খোলা হচ্ছে। কখনও কখনও ভর্তি পরীক্ষা ছাড়াই নিম্নমানের শিক্ষার্থী ভর্তি করা হচ্ছে। দায়সারা ক্লাস-পরীক্ষা নিয়ে দ্রুত কোর্স শেষ করে শিক্ষার্থীদের পাশের সার্টিফিকেট তো দেওয়া হচ্ছে। একটাই উদ্দেশ্য- বেশি শিক্ষার্থী, বেশি টাকা।

ডিন অফিস সূত্রে জানা যায়, ব্যবসায় অনুষদে ২০০১ সাল থেকে সান্ধ্যকালীন এমবিএ কোর্স শুরু হয়। এরপর থেকে প্রতিবছর নয়টি বিভাগে তিনটি সেশনে প্রায় এক হাজার ৮০০ শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়।  সঙ্গে থাকে বিভিন্ন সেমিস্টারে ফেল করা শিক্ষার্থীরাও। সব মিলিয়ে সান্ধ্যকালীন দুই হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করেন। অনুষদের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন স্টাডিস বিভাগের এক প্রশাসনিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ প্রতিবেদককে বলেন, সান্ধ্যকালীন এমবিএতে একেকজন শিক্ষার্থীর পড়তে ব্যয় হয় প্রায় তিন লাখ টাকা। অনেককেই সেমিস্টারে অকৃতকার্য হওয়ার দরুন পুনঃভর্তি বাবদ গুনতে হয় আরও অতিরিক্ত টাকা। আর নিয়মিত এমবিএ শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে পুরো কোর্স সম্পন্ন করতে খরচ হয় মাত্র ১১ হাজার টাকা।

তবে ব্যবসায় অনুষদের ডিন অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াতুল ইসলাম বলেন ভিন্ন কথা। তিনি একুশে টিভি অনলাইনকে বলেন, সান্ধ্যকালীন কোর্সে মাধ্যমে অনেক শিক্ষার্থী ভালো কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে পারছে। এছাড়া শিক্ষার্থীদের কর্মসংস্থান ও বাজারমুখী শিক্ষা নিশ্চিত ও বেকারত্ব কমাতে দেশের ক্রমবর্ধমান প্রয়োজন মেটাতে সান্ধ্যকালীন চালু করা হয়। তিনি আরও বলেন, স্যান্ধ্যকালীন কোর্স বন্ধ শিক্ষার্থীদের সংখ্যা আরও বাড়ানো প্রয়োজন।

সান্ধ্যকালীন কোর্সের মান নিয়ে ঢাবির সিনেটের বার্ষিক অধিবেশনে নানা সমালোচনা উঠে এসেছে। সিনেট সদস্যরা বলেন, সান্ধ্যকালীন কোর্সের মাধ্যমে নিম্নমানের ডিগ্রিধারীরা বের হচ্ছেন। এ বিষয় জানতে চাইলে শিবলী রুবাইয়াতুল ইসলাম জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অর্নাসে যে পরিমাণ মেধাবী শিক্ষার্থী পেয়ে থাকে বিশ্ববিদ্যালয় সান্ধ্যকালীন কোর্সে তেমন শিক্ষার্থী পাওয়া যায় না। কারণ হিসাবে তিনি বলেন, এখানে ভর্তি হতে আসেন, তাদের বেশিরভাগই কোনো কলেজ বা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন করা । ফলে একটু কম মেধাবী হয় তারা। সান্ধ্যকালীন কোর্সে বাড়তি ফি বিষয় তিনি বলেন, সান্ধ্যকালীন কোর্সর টাকা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো নির্মাণে ব্যয় করা হয়। এ কোর্সের সিংহভাগ টাকা বিশ্ববিদ্যালয় পায়।

তিনি বলেন, যেহেতু সান্ধ্যকালীন অর্থ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন প্রয়োজন পূরণ হচ্ছে। সান্ধ্যকালীন ব্যয় একটু বেশি হলেও তা প্রতিষ্ঠানের জন্য ভালো। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য যখন বেতনের টাকার টান পড়েছিল, তখন এ খাত থেকে ধার দেওয়া হয়েছিল। এখান থেকে পাওয়া অর্থ দিয়ে অনুষদের নিয়মিত ছাত্রদের বিভিন্ন বৃত্তি, ট্যুর ও সাহায্য-সহযোগিতার ব্যবস্থা করা হয়।

এ বিষয় জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আলী আক্কাস একুশে টিভি অনলাইনকে বলেন, সান্ধ্যকালীন কালীন কোর্স যারা ভর্তি হয় তারা অবশ্যই নিয়মিত শিক্ষার্থীদের থেকে কম মেধাবী। অনেকেই বিভিন্ন কলেজ বিশ্ববিদ্যাল থেকে এখানে এসে ভর্তি হয়। বিশেষ করে তারা ইংরেজিতে বেশি দুর্বল হয়। আমাদের এখানে সব বিষয় যেহেতু ইংরেজি পড়ানো হয়। আমরা আশানুরূপ শিক্ষার্থী পাই না। তবে এখান থেকে পড়াশুনা করতে শেষ করতে পারলে শিক্ষার্থী চাকরির বাজারে অনেক সুবিধা পাওয়া যায় বলে জানান তিনি।

এ বিষয় জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভিসি অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান একুশে টিভি অনলাইনকে বলেন, সন্ধ্যাকালীন কোর্সের মাধ্যমে যারা পড়াশোনা শেষ করছে, তাদের শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন আছে কিনা এটা বলতে পারবো না। তবে এই কোর্স ঢাবির জন্য একটা বোঝা। আমাদের শিক্ষকদের অনেক কাজে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে। এ কারণে নিয়মিত কোর্সগুলোতে মানসম্মত পাঠদান কঠিন হয়ে পড়ছে। তবে কোর্সগুলো আপাতত বন্ধ করার কোনো পরিকল্পনা নেই বলেও জানান তিনি।

টিআর/ এআর