ঢাকা, বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ১১ ১৪৩১

ঘুরে এলাম পাহাড়-সমুদ্রের মালয়েশিয়ার পাংকোর দ্বীপ     

শেখ আরিফুজ্জামান, মালয়েশিয়া থেকে

প্রকাশিত : ১২:১৫ এএম, ২৭ আগস্ট ২০১৮ সোমবার | আপডেট: ০৭:৪৪ পিএম, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮ শনিবার

ঈদ মানে খুশি, ঈদ মানে আনন্দ।  ঈদের আনন্দ অন্য যে কোনো আনন্দের চেয়ে একটু ভিন্ন যা বলার অপেক্ষা রাখেনা।  এইসব আনন্দঘন উৎসবগুলো মানব জীবনে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে আছে। 

তবে আমার মতো যারা প্রবাসী। পরিবার ছাড়া প্রবাসে ঈদ উদযাপন কেমন যেন মলিন আর ফ্যাকাসে, নেই কোনো আমেজ। 

এ যেন জীবনের গভীর শূন্যতার বহিঃপ্রকাশ। প্রবাসীর জীবনকে পরিবার-পরিজনের সাথে কাটানো ঈদ স্মৃতিগুলো বার বার তাড়া দেয়।

ভারি হয়ে উঠে শ্বাস-প্রশ্বাস।  ফেলে আসা স্মৃতি নিজ শহর, আড্ডা, চেনা পথ, পথের ধুলি আলোড়িত করে হৃদয়।

প্রবাসে ঈদের অভিজ্ঞতা একেক জনের একেক রকম। তবে দেশের বাইরে একজন বাঙালী হয়ে উঠে অপর বাঙালীর প্রিয় স্বজন। আমাদের ঈদ কাটে এই বাঙালী বন্ধুদের সাথে সময় কাটিয়ে। 

এবারের কোরবানি ঈদে সকল দু:খ কষ্টকে দূরে ঠেলে কিছুটা আনন্দে থাকার জন্য ঈদ-উল-আযহা`য় আমাদের এবারের গন্তব্য ছিল মালয়েশিয়ার পাংকোর দ্বীপ।  

দ্বীপটি নাম `পাং কো` থেকে এসেছে।  যার অর্থ সুন্দর দ্বীপ। দ্বীপটি  কুয়ালালামপুর থেকে প্রায় ২৫০ কিলোমিটার মালয়েশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর ইপো থেকে ৮৫ কিলোমিটার দূরে পেরাকের রাজ্যে অবস্থিত।  দ্বীপের জনসংখ্যা প্রায় ৩৫ হাজার এবং প্রধান আয়ের উৎস্য মৎস্য শিকার ও টুরিস্ট।  

দুই জায়গা থেকে ফেরিতে করে দ্বীপটিতে যাওয়া যায়। কুয়ালালামপুরের টিবিএস বাস স্ট্যান্ড থেকে প্রতি ১ ঘন্টা পর পর বাসের ব্যবস্থা রয়েছে।

ভাড়া পড়বে প্রতি টিকেট ২৭ রিঙ্গিত ও শিশুদের জন্য ২০ রিঙ্গিত।  বাসে করে যেতে হলে প্রথমে নামতে হবে লুমুট নামক স্থানে।  সেখান থেকে ফেরিতে বা ট্রলারে করে পাংকোর দ্বীপের জেটিতে নামতে হবে।

সময় লাগবে ৩০ থেকে ৩৫ মিনিট। ফেরি ভাড়া জনপ্রতি টিকিট ১২ রিঙ্গিত।  একটা বিষয় অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে, কোনোভাবেই ওই টিকিট ছিড়ে বা ফেলা যাবে না।  কারণ আসার সময় ওই টিকিটেই চলে আসতে পারবে।  নতুন করে টিকিট কাটা লাগবে না।    

এছাড়া ব্যক্তিগত গাড়ি বা তাড়াতাড়ি যেতে চাইলে মেরিন আইল্যান্ড থেকে অতি সহজে পাংকোর দ্বীপের জেটিতে যেতে পারবে।  এর জন্য সময় লাগবে মাত্র ১০ মিনিট ও ভাড়া ৮ রিঙ্গিত জনপ্রতি।

জেটি থেকে মটর সাইকেল ভাড়া অথবা মাইক্রো ভাড়া করে দ্বীপের যে কোনো সিবিচে যেতে পারবে।  মটর সাইকেল ২৪ ঘণ্টার জন্য ভাড়া পড়বে ৫০ রিঙ্গিত এবং মাইক্রোতে একজন ৮ রিঙ্গিত করে।  অথবা পুরো মাইক্রো নিলে ৩৫/৪০ রিঙ্গিত ভাড়া লাগবে গৌন্তব্যে পৌঁছাতে। 

যেমন কথা, তেমন কাজ। অফিস কলিগ, বন্ধু-বান্ধব মিলে আমরা ১৩ জনের একটি গ্রুপে মিলিত হলাম। বিষাদের আনন্দকে ভুলে থাকার জন্য আমাদের সঙ্গী হয়ে দাঁড়ায় প্রকৃতি, পাহাড় ও সমুদ্র। 

গ্রুপের নাম দেওয়া হলো `ওকে বস`।  যতই ঈদ ঘনিয়ে আসছে ভ্রমণকে কেন্দ্র করে আমাদের ব্যস্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে।  শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হলো সারাদিনের অফিস শেষে প্রয়োজনীয় কেনাকাটা শেষ করে চাঁদ রাতে ৩টার সময় রওনা দেবো।  কিন্তু কয়েকজনের অবহেলার কারণে ভোর ৫ টায় রওনা দিতে হয়েছে। 

কুয়ালালামপুর থেকে ৪ ঘন্টার পথ অর্থাৎ ৩৫০ কিলোমিটার দূরে হলেও উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ও ওয়ানওয়ে রাস্তার কারণে প্রাইভেটকারে কিছু কম সময়ের মধ্যে পৌঁছালাম মেরিন আইল্যান্ড নামক স্থানে।  সবুজ অরন্য ও পাহাড়ের বুক চিড়ে ছুটে চলা, পথিমধ্যে কিছু সময়ের বিরতি। 

এদিকে, ঈদের নামাজের জন্য ৩টি গাড়ি যেন একে অন্যকে পাল্লা দিতে থাকলো।  গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণের জন্য রাস্তায় কয়েক কিলোমিটার পর পর রয়েছে স্বয়ংক্রিয় ক্যামেরা।  যা নির্দিষ্ট গতির উপরে উঠলে অটোমেটিক গাড়ির নাম্বারসহ ছবি তুলে নেবে।  আর এজন্য গুনতে হবে জরিমানা। 

পথিমধ্যে ঈদ-উল-আযহা`র নামাজ শেষে আবারও ছুটে চলা। মেরিন আইল্যান্ডে গাড়ি পার্কিংয়ের সুবিশাল ব্যবস্থা রয়েছে।  যা ১০০% নিরাপত্তাবলায়ের মধ্যে রয়েছে।  বিন্দু মাত্র চিন্তার কোনো কারণ নেই।  আর এ জন্য ২৪ ঘণ্টায় খরচ পড়বে ১৫ রিঙ্গিত করে।

অবশেষে গাড়ি পার্কিং করে সকালের ফেরিতে রওনা দিলাম পাংকোরের উদ্দেশ্যে।  দ্বীপটিতে অনেকগুলো সিবিচ থাকার কারণে আমরা পছন্দ করলাম `তেলুক নিপা` সিবিচ নামক স্থান।

তেলুক নীপা সিবিচে পৌঁছানোর পর বের হলাম হোটেল বুকিংয়ের জন্য।  অনলাইনেও হোটেল বুকিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে।  কিন্তু আমাদের হঠাৎ সিদ্ধান্তের কারণে অনলাইনেও বুকিং সম্ভব হয়নি।

এ জন্য কিছু সময় খোঁজার পর একে একে খোঁজ পেলাম অনেকগুলো বাংলাদেশী ভাই।  যারা বিভিন্ন হোটেলে কর্মরত আছে।  তাদেরই সহযোগিতায় কম খরছে পেয়ে গেলাম বাংলাদেশী ম্যানেজারের তত্বাবধানে থাকা হর্নবিল পাংকোর রিসোর্ট।  ভাড়া পড়বে ডাবল রুম ১০০ রিঙ্গিত।  অফ সিজেনে আরও কম। 

হোটেলের ম্যানেজার রহমান ভাই থেকে শুরু করে সকলের সহযোগিতা এবং সার্ভিসে মুগ্ধ `ওকে বস` গ্রুপ।  রাত বা দিন যে কোনো সময় ডাকা মাত্রই ছুটে আসে। 

রিসোর্টের ব্যতিক্রম একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে চাইলে ৯ জন মিলে একটি রুমে থাকা যাবে। রুমটির মধ্যে ৩টি কুইন সাইজের বেড, এয়ারকন, ফ্যান সবই আছে।  ডাবল রুম থেকে ভাড়ার পার্থক্য সামান্য। 

লম্বা জার্নি এবং রাতে ঘুম না হওয়ার কারণে কিছু সময়ের জন্য রেস্ট নিয়ে এবারের পালা দল বেঁধে বের হয়ে দর্শনীয় স্থান পরিদর্শন।  এ জন্য ম্যানেজার রহমানের ভাইয়ের সহযোগিতায় ২৪ ঘন্টার জন্য মটর সাইকেল ভাড়া করে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ছুটে চলা।

চাইনিজ টেম্পেল, সমুদ্রের মধ্যে মনোমুগ্ধকর মসজিদ দেখা ও জোহরের নামাজ আদায় করাসহ বিভিন্ন সিবিচ পরিদর্শন ও আড্ডা দেওয়ার মধ্যে কেটে যায়।

পাংকোর দ্বীপের প্রধান বাহন মটর সাইকেল। আমাদের গ্রুপের অধিকাংশই মটর সাইকেল চালানোয় দক্ষ থাকার কারণে কোনো রকম দুর্ঘটনা ছাড়ায় পাহাড়ের উঁচু-নিচু রাস্তা দিয়ে দলবেঁধে বাইক চালানো, বিভিন্ন স্পট ঘুরে দেখা ও ছবি তোলা। 

শুধু তাই নয় মটর সাইকেলে তেলুক নিপা সিবিচ থেকে রওনা দিয়ে কখন সমতল আবার কখনও পাহাড়ের উপর দিয়ে আবার কখনও সমুদ্রের পাশ দিয়ে পুরো দ্বীপটাকে ঘুরে দেখা সে এক অন্য রকম অনুভূতি।  যেটা দক্ষ চালক ছাড়া সম্পূর্ন দ্বীপটাকে ঘুরে দেখা অসম্ভব। 

দ্বীপটি পাহাড় দ্বারা বেস্টিত হওয়ায় একদিকে যেমন আকা-বাঁকা, উঁচু-নিচু, ঢেউ তোলা সবুজ পাহাড়ের বুক চিড়ে কালো পিচের সার্পিলের রাস্তা, অন্যদিকে সুনশান নিরবতার কারণে খুব কম মানুষই দিনের আলোয় মটর সাইকেল নিয়ে পুরো দ্বীপটি ঘুরে দেখেন। 

দ্বীপগুলোর মধ্যে পাংকোর দ্বীপটি পাহাড় বেস্টিত হওয়ায় সৌন্দর্য বর্ধণ ও যোগাযোগের জন্য চারিদিকে পাকা রাস্তা তৈরি করা হয়েছে।  যা দ্বীপের এক প্রান্ত থেকে রওনা দিয়ে অন্য প্রান্তে আসতে মটর সাইকেলে ১ ঘন্টারও বেশি সময় লাগে।

ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য দ্বীপে বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক হোটেল/রিসোর্ট রয়েছে।  পাংকোর দেখার কোন নির্দিষ্ট সময় নেই।  কারণ দ্বীপটির আবহাওয়া সারা বছর একই রকম থাকে (যদিও এটি এখনও একটি গ্রীষ্মমন্ডলীয় দ্বীপ)।

সমুদ্রসৈকত, সামুদ্রিক মাছ, ১২১৬ মিটার উঁচু পাহাড়, সূর্যাস্ত উপভোগ করা ছিল মনে রাখার মতো।  পাহাড়ের গায়ে লেগে থাকা সবুজ অরন্য, সমুদ্রের নীল জলরাশি — সব মিলিয়ে মনে হলো স্বর্গের একটি খণ্ড যেন ছিটকে পড়েছে এই দ্বীপে। 

জীবনের ডাইরিতে যুক্ত হলো আরও কিছু স্মৃতি।  এমনটি শোনা গেল সানজি ইসলাম, নওরিন, টানভির, রাসেল, সাঈদ, ফয়েজ-ওদের মুখ। 

সবারই কথা প্রবাসের একঘেয়েমি জীবনযাত্রা থেকে অনেক ঘুরতে হবে।  জানা যাবে ইতিহাস, ঐহিত্য আর দেখা যাবে মায়াবি রূপ। 

এমএইচ/এসি