ইভিএম ব্যবহারের প্রস্তুতি আমাদের নেই: মাহবুব তালুকদার
প্রকাশিত : ০৬:২৮ পিএম, ৩০ আগস্ট ২০১৮ বৃহস্পতিবার

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন-ইভিএম ব্যবহারের জন্য যে প্রস্তুতি থাকা দরকার তা আমাদের নেই বলে মনে করেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। সেজন্যই ইভিএম ব্যবহারের বিধান রেখে আরপিও সংশোধনের বিরোধিতা করে নির্বাচন কমিশনের সভা থেকে বেরিয়ে এসেছেন তিনি।
আজ বৃহস্পতিবার বিকাল পৌচে ৬ টার দিকে নির্বাচন কমিশনের কার্যালয়ের নিজ কক্ষে সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন মাহবুব তালুকদার।
তিনি বলেন, আমি বুঝলাম জাতীয় নির্বাচনের আগে আগে ইভিএম কেন এতো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলো। অথচ ইভিএম ব্যবহারে আমাদের ভোটারদের অনীহা আছে। আমি মনে করি ভোটারদের অভ্যস্ত করতে না পারলে ইভিএম সফল হবে না।
তথ্য প্রযুক্তির উৎকর্ষতার এই যুগে নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিপক্ষে নন দাবি করে মাহবুব তালুকদার বলেন, ডিসেম্বরে অনুষ্ঠেয় একাদশ জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের জন্য যে প্রস্ততি থাকা দরকার তা আমাদের নেই। তবে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে যেভাবে ইভিএম ব্যবহার হচ্ছে তাতে করে আগামী ৫/৭ বছরে ভোটাররা এতে অভ্যস্ত হয়ে পড়বেন বলেও মনে করেন এই নির্বাচন কমিশনার। তিনি বলেন, আমি আশা করি আগামী ১০ বছর পর ইভিএম ব্যবহারে নির্বাচনে অনিবার্য হয়ে পড়বে।
এই নির্বাচন কমিশনার বলেন, আমার মনে হয় আমি এমন কিছু বলিটি যেটি আমি বিশ্বাস করি না। আমি যেটি অনুভব করেছি সেটি বৈঠকে বলেছি। আমার মন যেদিকে সায় দিয়েছে সেটি আমি করেছি। নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছি।
এদিকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন-ইভিএম ব্যবহারের বিধান রেখে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) ১৯৭২ সংশোধনের অনুমোদন দিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
আজ বিকাল ৫ টার দিকে নির্বাচন ভবনে এক সংবাদ সম্মেলন করে বিষয়টি জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা।
সিইসি বলেন, আরপিও সংশোধনটি আইনে পরিণত হলে সবার জন্য প্রদর্শনীর পর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
প্রসঙ্গত আরপিও সংশোধন নিয়ে আজ সকালে পূর্বনির্ধারিত বৈঠক করে নির্বাচন কমিশন। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিরোধীতা করে বৈঠক বয়কট করেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার।
নোট অব ডিসেন্টে যা লিখেছেন মাহবুব
সেখানে তিনি লিখেছেন, আমি মনে করি, স্থানীয় নির্বাচনে ধীরে ধীরে ইভিএমের ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে একাদশ সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারে আরপিও সংশোধনের উদ্যোগ সমর্থন করি না। ইভিএম ব্যবহারের বিষয়ে কমিশনের সিদ্ধান্তে ভিন্নমত পোষণ করে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ প্রদান করছি।
এই আপত্তির কারণ হিসেবে ইভিএম নিয়ে ‘বিদ্যমান রাজনৈতিক বিরোধিতা’ এবং ‘দক্ষ জনবলের অভাব’ এর কথা বলা হয়েছে ওই নোট অব ডিসেন্টে।
তিনি লিখেছেন, আমি ধারণা করি, জনমত বা সর্বসম্মত রাজনৈতিক মতের বিরুদ্ধে ইভিএম ব্যবহৃত হলে তা নিয়ে আদালতে অসংখ্য মামলার সূত্রপাত হবে। অন্য কারণ ছাড়া কেবল ইভিএম ব্যবহারের কারণেই সংসদ নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। বর্তমান ইসির পক্ষে এ ঝুঁকি নেওয়া সঙ্গত হবে না।
যন্ত্রের অগ্রগতির এ যুগে ইভিএম ব্যবহারের ‘বিরোধী নন’ জানিয়ে মাহবুব তালুকদার বলেছেন, স্বল্প সময়ে এতো বিশাল জনবলের প্রশিক্ষণের অপর্যাপ্ততা এবং ভোটারদের অজ্ঞতাপ্রসূত কারণে ইভিএম নিয়ে অনীহাও থাকবে।
সাম্প্রতিক সিটি নির্বাচনে কিছু ‘বিশৃঙ্খলা’ এবং ইভিএম কেন্দ্র দখলের অভিযোগের কথাও নোট অব ডিসেন্টে তুলে ধরেছেন তিনি।
রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপে ইভিএম নিয়ে সরকারি ও বিরোধী দলের অবস্থান ছিল পরস্পরবিরোধী। আর সিইসি প্রথম থেকেই বলে এসেছেন, রাজনৈতিক দলগুলো সম্মত হলেই কেবল জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা হবে। সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে আরও আলোচনা করার পরামর্শ দিয়েছেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার।
তিনি লিখেছেন, শুরুতে স্থানীয়ভাবে পরীক্ষামূলকভাবে ইভিএম ব্যবহার হয়েছিল। এজন্যে প্রায় ৫০ কোটি টাকার ইভিএম কেনায় আমি ভিন্নমত পোষণ করেছিলাম। সম্প্রতি ৩৮২১ কোটি টাকার প্রকল্প তৈরি করা হয়েছে। কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের বিরোধিতার মুখে জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার যেখানে অনিশ্চিত, সেখানে এ বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে ইভিএম কেনা কতটা যৌক্তিক, সে প্রশ্ন মনে জাগে।
মাহবুব তালুকদার বলছেন, পরিকল্পনা কমিশন এখন পর্যন্ত প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা যাচাই করেনি। যে ইভিএম বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি থেকে বিনা টেন্ডারে কেনা হচ্ছে, তার কারিগরি বিষয় বুয়েট বা অনুরূপ কোনো সংস্থা থেকে যাচাই করা হয়নি। কারিগরি দিক থেকে এ যন্ত্র সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত কিনা তা পরীক্ষা করা হয়নি।
গতবছর ফেব্রুয়ারিতে কে এম নূরুল হুদা নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর এ পর্যন্ত অন্তত তিনটি বিষয়ে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিলেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার।
কমিশন সভা বর্জনের বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে মাহবুব তালুকদার গণমাধ্যমকে বলেন, আমি এখন আমার অফিসে আছি। আপাতত এ নিয়ে আর কিছু বলতে চাই না।
তার একান্ত সচিব মুহাম্মদ এনাম উদ্দীন গণমাধ্যমকে বলেন, স্যার বিকাল ৩টায় এ বিষয়ে কথা বলবেন।
আগামী জাতীয় নির্বাচনে এক-তৃতীয়াংশ আসনে ইভিএমের ব্যবহার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনা-সমালোচনা তুঙ্গে থাকার মধ্যেই এই ঘটনা ঘটল। গত রোববার কমিশনের ৩৫তম সভায় আরপিও সংশোধন নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত হয়। কিন্তু সেদিন কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই সভা মুলতবি করে আজকের জন্য দিন রাখা হয়।
প্রসঙ্গত, গত দুদিন আগে নির্বাচন কমিশন সচিব এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে জাতীয় নির্বাচন হবে। অক্টোবরে তফসিল ঘোষণা করবে ইসি। এই নির্বাচনে এক তৃতীয়াংশ আসনে ইভিএম ব্যবহার করার বিষয়ে ইসি চিন্তা ভাবনা করছে বলেও জানান তিনি। তার এই বক্তব্যের পর বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে ইভিএম ব্যবহার নিয়ে আপত্তি উঠে।
/ এআর /