ঢাকা, বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ১১ ১৪৩১

‘ঠুঁটো জগন্নাথ’ হচ্ছে সংস্থাটি-মত বিশেষজ্ঞদের

স্বায়ত্তশাসন হারিয়ে ইউজিসি হচ্ছে উচ্চশিক্ষা কমিশন

তবিবুর রহমান

প্রকাশিত : ১১:২৪ এএম, ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮ সোমবার | আপডেট: ০৬:৪৩ পিএম, ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮ সোমবার

উচ্চ শিক্ষার গুনগত মানোন্নয়ন ও বিশ্ববিদ্যালয়ে  শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ  নিশ্চিতে  দীর্ঘ ৮ বছর অপেক্ষার পর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) পুনর্গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে সংস্থাটির কাঠামো ও নাম বদলিয়ে করা হচ্ছে উচ্চ শিক্ষা কমিশন। তবে দেওয়া হচ্ছে না ‘স্বশাসন’। বাড়ানো হচ্ছে না ক্ষমতা। বর্তমান আইনে চেয়ারম্যান পদে শিক্ষাবিদের নিয়োগ বাধ্যতামূলত থাকলেও নতুন আইনে সেটি বাদ দিয়ে সংস্থাটির সর্বোচ্চ পদে আমলাদের নিয়োগের সুযোগ রাখা হচ্ছে। সেই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার যে এখতিয়ার প্রতিষ্ঠানটির হাতে ছিল, সেটি আর থাকছে না।   

বিশ্লেষজ্ঞরা বলছেন, প্রস্তাবিত আইনটি বাস্তাবায়ন হলে সংস্থাটি হবে ‘ঠুটো জগন্নাথ’। তারা মনে করছেন যে মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে আইন হতে যাচ্ছে শুধু নাম পরিবর্তন ছাড়া আর কিছু হচ্ছে না। বর্তমানে ইউজিসি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত হলেও স্বায়ত্তশাসনের মর্যাদা ভোগ করছে। কিন্তু নতুন আইনে এটা থাকছে না।

প্রণীত খসড়া আইনে যে প্রস্তাব করা হয়েছে, তাতে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানটি অনেকটাই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি অধিদফতরে পরিণত হবে বলে আশংকা করছেন তারা।

তাদের মতে, আগে যেসব বিষয়ে ইউজিসি সিদ্ধান্ত দিত- আইনের খসড়া অনুযায়ী, সেগুলোর ক্ষেত্রে এখন প্রাক-অনুমোদন দেবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সংস্থাটির প্রধানের পদেও অশিক্ষক বা সরকারি আমলা পদায়নের রাস্তা খুলে রাখা হয়েছে।

সচিব পদ নিয়ে যাওয়া হয়েছে কমিশনের বাইরে। এছাড়া বেশ কয়েকটি বিধানে অস্পষ্ট ও স্ববিরোধী নির্দেশনা আছে। তবে উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে এতে কয়েকটি কঠোর বিধান রাখা হয়েছে।

এ বিষয় জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সাবেক চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ চৌধুরী একুশে টিভি অনলাইনকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার মান নিরূপণ, পরিকল্পনা প্রণয়নসহ বিভিন্ন নীতিমালা প্রস্তুত সরকার করবে এটা স্বভাবিক। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর রক্ষণাবেক্ষণ, উন্নয়ন, উচ্চ শিক্ষা ও গবেষণার মানোন্নয়ন এবং সম্প্রসারণের লক্ষ্যে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতেই পারে। তবে প্রস্তাবিত আইনে সংস্থাটির শুধুমাত্র নাম পরিবর্তন ছাড়া কোনো কিছু হচ্ছে না। আমার মত হচ্ছে, প্রস্তাবিত আইনটি পাশ করার আগে অবশ্যই সরকারের ভেবে দেখা উচিত।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত ২৬ আগস্ট প্রশাসনিক উন্নয়ন সংক্রান্ত সচিব কমিটির সভায় ‘উচ্চশিক্ষা কমিশন আইন, ২০১৮’ অনুমোদন দেওয়া হয়। অত্যন্ত গোপনীয়তার মধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ আইনের খসড়া তৈরি করে। প্রক্রিয়া অনুযায়ী এটি এখন মন্ত্রিসভার বৈঠকে উপস্থাপন করা হবে। এরপর পাসের জন্য যাবে সংসদে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রস্তাবিত উচ্চশিক্ষা কমিশন আইনে ‘নামকাওয়াস্তে’ স্বায়ত্তশাসন প্রস্তাব করা হয়েছে। বিদ্যমান আইনে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকের পদ সৃষ্টি, বিষয়/বিভাগ/ইন্সটিটিউট খোলা, অর্থ বরাদ্দসহ বিভিন্ন কাজ ইউজিসি করে।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস অনুমোদন, বিভাগ-বিষয় খোলা বা স্থগিত/বাতিল ইত্যাদি করে ইউজিসি। কিন্তু প্রস্তাবিত আইন অনুযায়ী, এসব ক্ষেত্রে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পূর্বানুমোদন লাগবে। ইউজিসি নিজস্ব পদ সৃষ্টি, যোগ্যতা নির্ধারণ ও নিয়োগের বিষয়েও পূর্বানুমোদন নিতে হবে।

বর্তমানে এসব বিষয়ে ইউজিসিই সিদ্ধান্ত নেয়। উচ্চশিক্ষা সংক্রান্ত কার্যক্রম কমিশন সরাসরি নয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সম্পন্ন করবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিবই চ্যান্সেলরের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।

আবার প্রস্তাবিত কমিশন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিরুদ্ধে তদন্ত করতে পারবে, কিন্তু ব্যবস্থা নিতে পারবে না। এটা নেবে মন্ত্রণালয়। শুধু তাই নয়, মন্ত্রণালয় কমিশনের সুপারিশ মানতে বাধ্য নয়। পরিদর্শন ও তদন্ত বিষয়ে সরকার যেমন মনে করবে, তেমন ব্যবস্থা নিতে পারবে। অথচ আইনে কমিশনকে সংবিধিবদ্ধ সংস্থা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

শুধু ইউজিসিই নয়, প্রস্তাবিত আইনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বায়ত্তশাসন খর্ব করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থী ভর্তির ক্ষেত্রে ন্যূনতম প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতা ও শর্তাবলি কমিশন নির্ধারণ করবে। অথচ বর্তমানে প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয় এটা নির্ধারণ করে।

বিদ্যমান বিধান বহাল রেখে প্রস্তাবিত আইনেও সংস্থার চেয়ারম্যান এবং ৫ জন পূর্ণকালীন সদস্য রাখা হয়েছে। এতে প্রথমবারের মতো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৩ জন খণ্ডকালীন সদস্য রাখার কথা বলা হয়েছে। সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে তিনজন সচিব খণ্ডকালীন সদস্য থাকবেন। এছাড়া সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৩ জন ভিসি এবং ৩ জন ডিন সদস্য নিয়োগ পাবেন। চেয়ারম্যান ও সদস্য নিয়োগ দেবেন রাষ্ট্রপতি।

বর্তমানে শুধু শিক্ষাবিদরাই কমিশনের চেয়ারম্যান হতে পারেন। প্রস্তাবিত আইনে আমলা নিয়োগের পথ খোলা রেখে বলা হয়েছে, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের শিক্ষক, গবেষক বা প্রশাসক হিসেবে শিক্ষা ক্ষেত্রে খ্যাতিমান ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিত্বরা চেয়ারম্যান হতে পারবেন।

চেয়ারম্যানের পদমর্যাদা রাষ্ট্রপতি নির্ধারণ করবেন। তবে ইউজিসি থেকে পাঠানো সব খসড়ায় চেয়ারম্যান একজন পূর্ণ মন্ত্রীর মর্যাদা পাবেন বলে প্রস্তাব করা হয়েছিল। এ ছাড়া স্থায়ী ৫ সদস্য প্রতিমন্ত্রীর এবং কমিশনের সচিব সরকারের সচিবের মর্যাদা পাবেন বলে প্রস্তাব ছিল।

সচিব কমিটির বৈঠকে ওইসব প্রস্তাব কাটছাঁট করা হয় বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে। তবে চেয়ারম্যান অপসারণে সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি অপসারণের পদ্ধতি ও কারণ অনুসৃত হবে। আর পূর্ণকালীন সদস্যরা রাষ্ট্রপতির সন্তোষ অনুযায়ী স্বপদে বহাল থাকবেন।

বর্তমানে ইউজিসির পরিচালকদের মধ্য থেকে একজনকে ইউজিসির সচিব করা হয়। এটাও আমলাদের দখলে নেওয়ার প্রস্তাব করে বলা হয়েছে, কমিশনের সচিব সরকার কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন।

আইনে কয়েকটি অস্পষ্টতা আছে। খণ্ডকালীন সদস্য নিয়োগে কোনো ধরনের বিশ্ববিদ্যালয় বিবেচিত হবে, তা সুনির্দিষ্ট করা হয়নি। ফলে আইন না মানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিয়োগ পাবে কিনা, সেটা স্পষ্ট নয়। খসড়ার ১৪ নম্বর ধারায় পরামর্শক/উপদেষ্টা নিয়োগের বিধান আছে। কিন্তু কোথায় এরা নিয়োগ পাবেন, তা পরিষ্কার নয়।

 এ বিষয় জানতে চাইলে ইউজিসি বর্তমান চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান একুশে টিভি অনলাইনকে বলেন, প্রথম ১৯৭৩ সালে ৬টি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে ইউজিসির যাত্রা শুরু করে এখন বর্তমানে ৪৮টি সরকারি এবং ১০৮টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে এর অধীনে। এসব বিশ্ববিদ্যালগুলো পরিচালনার জন্য যেসব ক্ষমতা ও লোকজন থাকা দরকার সেগুলো আমাদের নেই। নতুন আইনেও এসব বিষয় উপেক্ষিত।

তিনি বলেন, ইউজিসি দায়িত্ব পালনে যেসব অসুবিধার মুখোমুখি হচ্ছে সেগুলো থেকে উত্তরণে নতুন আইনের মাধ্যমে এটি উচ্চশিক্ষা কমিশন (হেক) গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আইনের খসড়া যেসব বিষয় আছে তা বাস্তবায়ন হলে প্রতিষ্ঠানটির স্বায়ত্বশাসন থাকছে না।

তিনি আরও বলেন. বঙ্গবন্ধু চিন্তা করেছিলেন স্বায়ত্তশাসন না থাকলে উচ্চশিক্ষা থাকে না। তাই তিনি ১৯৭৩ সালেই ইউজিসিকে স্বায়ত্তশাসন দেন ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানরূপে এটিকে গঠন করেন। এই আইনটি বাস্তবায়ন হলে বঙ্গবন্ধু যে স্বপ্ন দেখে গিয়েছিলো সেটাও ভঙ্গ হবে।

ইউজিসি চেয়ারম্যান আরও বলেন, ওই সময়ে যে কটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন তৈরি হয়েছে, সব কটিকে তিনি (বঙ্গবন্ধু) স্বায়ত্তশাসন দিয়েছেন। কিন্তু আমি বিস্মিত যে বঙ্গবন্ধুর হাতে তৈরি প্রতিষ্ঠানের স্বায়ত্তশাসন খর্ব করার প্রস্তাবের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের হাত একটুও কাঁপল না। তবে আমার বিশ্বাস- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে বঙ্গবন্ধুর চিন্তাচেতনা পরিপন্থী কিছু হবে না।

টিআর/ এআর