ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৫ ১৪৩০

ডায়াবেটিস চিকিৎসা সেবার পুরোধা

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

প্রকাশিত : ০৫:০৫ পিএম, ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮ বৃহস্পতিবার

ছবি : ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিম

ছবি : ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিম

Sir Frederick Grant Banting ( ১৮৯১-১৯৪১) এবং Charles Herbert Best  (১৮৯৯-১৯৭৮) ইনসুলিন আবিস্কারের (১৯২২) ১২ বছর পর চিলিতে এবং ইংল্যান্ডে ১৯৩৪ সালে প্রথম ডায়াবেটিক সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়। ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশন অব ইংল্যান্ড রোগীদের প্রশিক্ষণ ও চিকিৎসার জন্য বই এবং যে জার্নাল বের করে, সেখানে ডায়াবেটিসের ওপর একটি আর্টিকেল দেখতে পান ডা. ইব্রাহিম।

তা থেকে তিনি জানতে পারেন, বিলেতে ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য ডায়াবেটিস অ্যাসোসিয়েশন রয়েছে এবং বিশেষ ব্যবস্থায় এসব সমিতি ডায়াবেটিস রোগের চিকিৎসা করে। তাতে তিনি তার দেশেও ডায়াবেটিক সমিতি প্রতিষ্ঠায় উদ্বুদ্ধ হন। প্রথমে তিনি নিজের চেম্বারে বিশেষভাবে ডায়াবেটিক রোগী দেখা শুরু করেন। এসব রোগীর মধ্যে অনেকেই ছিলেন উচ্চশ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা, ব্যবসায়ীর সমাজের প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিবর্গ। তাদেরকে ডা. ইব্রাহিম ডায়াবেটিক সমিতি প্রতিষ্ঠা এবং ডায়াবেটিক রোগীদের পুনর্বাসনের জন্য কিছু করার কথা বলা শুরু করেন। তাদের মধ্যে অনেকেই তার এরূপ ধারণার প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করতেন।

১৯৫৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি নিজ বাসভবনে তিনি কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তিদের ডায়াবেটিস চিকিৎসা সম্পর্কে মতবিনিময় সভায় আমন্ত্রণ জানান। ডা. ইব্রাহিম নিমন্ত্রিতদের জানালেন, যেদিন কারও ডায়াবেটিস হবে, সেদিনই বুঝতে হবে যে, ওই লোকটা অন্ধ হয়ে যাবে, কিংবা প্যারালাইসিস হয়ে যেতে পারে বা তার হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। কিন্তু যদি যথারীতি চিকিৎসা ও পরিচর্যার ভেতর একে রাখা যায়, তাহলে আজীবন তিনি সুস্থ থাকবেন।

রোগীর হয়তো ৩০-৪০ বছর বয়স; কিন্তু দশ বছরের মধ্যে তার সবকিছু অকেজো হয়ে যাবে; যথারীতি চিকিৎসা ও পরিচর্যা করলে এবং নিয়ম মেনে চললে, তিনি ৬০ বছর কেন তার চেয়ে বেশি অর্থাৎ দীর্ঘ সময় পর্যন্ত সুস্থ থাকবেন এবং প্রায় স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারবেন। উপস্থিত সমাজ দরদিদের সেদিন ডা. ইব্রাহিম তার নিজস্ব আবেগের সঙ্গে আরও জানিয়েছিলেন, যদি একটি ডায়াবেটিস সমিতি গঠন করা যায়, তাহলে এই সমিতির মাধ্যমে যত রোগীর চিকিৎসা হবে, তা তিনি নিজেই করবেন একেবারে বিনা পয়সায়। তাছাড়া এই চিকিৎসার জন্য যেসব যন্ত্রপাতির প্রয়োজন তার কিছু কিছু, যা ডা. ইব্রাহিমের নিজস্ব রয়েছে, তা-ও তিনি এই প্রকল্পের কাছে দিয়ে দেবেন।

ডা. ইব্রাহিম তাদেরকে আরও জানান, ডায়াবেটিস এমনি একটি রোগ, যা দ্বারা একবার আক্রান্ত হলে অন্য বহু জাতীয় রোগ খুব সহজেই এসে যেতে পারে। এ যেন সদর দরজা উন্মুক্ত করে দেওয়ার মতো; যেন প্রবেশকারীদের সম্মুখে আর কোনো বাধাই নেই। আর এ কারণে ডায়াবেটিস রোগের চিকিৎসা, এর নিয়ন্ত্রণ এমনকি প্রতিরোধকল্পে কিশোরদের পুষ্টি বিধান, পরিবার পরিকল্পনা, জন্মনিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি দিকে দৃষ্টি দেওয়া দরকার। একটি বিশেষ দিকের প্রতি তিনি দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, এ দেশের বৃদ্ধ সমাজ বার্ধক্যজনিত সমস্যার বিভিন্ন পারিপার্শ্বিক কারণে তাদের অবস্থা ক্রমেই করুণ হয়ে থাকে।

অন্যান্য পাশ্চাত্য উন্নত দেশে তাদের দেখা করার জন্য শুধু যে সরকারি ব্যবস্থা রয়েছে তাই নয়, বরং সরকারি সাহায্য সংস্থার পাশাপাশি রয়েছে আরও অনেক বেসরকারি বিভিন্ন সংগঠন, রয়েছে বিস্তৃত জীবন বীমার ব্যবস্থা, বেসরকারি ধর্মীয় ও সামাজিক অঙ্গ সংগঠন, যার প্রায় কোনোটিই এই দুর্ভাগা দেশে নেই। কোনো একটি বিশেষ বয়সে এসে বৃদ্ধদের যত্ন নেওয়া অপরিহার্য হয়ে দেখা দেয় এবং তা শুধু পারিবারিক নয়, সামাজিক দায়িত্বের পর্যায়ে পড়ে, যার নিশ্চিত অভাব রয়েছে এ দেশে।

ডা. ইব্রাহিম ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য বিনা পয়সায় উন্নত চিকিৎসার যুক্তি নিয়েও এগিয়ে আসেন। বলা বাহুল্য, এই অভিনব পন্থাটিকেই ডায়াবেটিস চিকিৎসার কৌশল হিসেবে অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে প্রয়োগ করে চূড়ান্ত সাফল্য অর্জন করেন তিনি। যে দেশে যেখানে গাঁটের পয়সা খরচ করে উন্নত চিকিৎসা পাওয়া যায় না, সেখানে বিনা পয়সায় চিকিৎসা দেওয়ার ব্যাপারে তার প্রথম যুক্তি ছিল- ধনী, গরিব সামাজিক শ্রেণি নির্বিশেষে সবাইকে বিনা পয়সায় চিকিৎসা দেওয়ার কারণ, পয়সা দিয়ে যদি চিকিৎসা করি তাহলে যাদের পয়সা আছে তারা শুধু ডায়াবেটিক সমিতির ক্লিনিকে আসবে কেন?

পয়সা দিয়ে তো তারা অন্য কোনো ক্লিনিকেও চিকিৎসা করাতে পারেন। কিন্তু আজীবনের রোগ ডায়াবেটিস চিকিৎসায় রোগী পয়সা দিয়ে অন্যত্র চিকিৎসা করতে গেলেই একসময় তার নিজেরও সমস্যা হবে। আর এই অতি দরিদ্রের দেশে গরিবরা আদৌ কোনো চিকিৎসা না পেয়ে পরিবার ও সমাজের বোঝা হয়ে নিঃশেষ হয়ে যাবে। এ ব্যাপারে তাই ডা. ইব্রাহিমের প্রধান আদর্শ হিসেবে ঘোষিত হলো :`ধনী, গরিব, উঁচু, নীচু কোনো ডায়াবেটিক রোগীকেই বিনা চিকিৎসায় এবং কাজবিহীন অবস্থায় মরতে দেওয়া হবে না।`

দ্বিতীয় যুক্তি : তার জীবনের ব্রত ছিল রোগীর মুখে হাসি ফুটানো। রোগী ও চিকিৎসকের মাঝখানে অর্থকে দাঁড় করাননি তিনি কখনও। ডাক্তারি পড়া অবস্থায় তিনি ভাবতেন, কীভাবে সমাজের সেবা করা যায়? সমাজসেবার কোনো নির্দিষ্ট গণ্ডি নেই, এ এক বৃহৎ বিশাল পরিমণ্ডল।

শুধু রোগী আর ডাক্তারের মধ্যে সমাজসেবার এ বিশাল পরিমণ্ডলকে তিনি সংকীর্ণ করে রাখার কখনোই পক্ষপাতী ছিলেন না। মেডিকেল ছাত্র থাকাকালীন তিনি যখনই সময় পেতেন, দেশে এসে সাধারণ মানুষের সেবা করতেন। প্রয়োজনে নিজের পকেটের পয়সা দিয়ে ওষুধ কিনে দিতেন। জটিল রোগীকে বহন করে কলকাতার বড় ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতেন।

তার তৃতীয় যুক্তি :রোগীদের মধ্যে সমতা সৃষ্টি করা। যার মাধ্যমে সমাজের সব স্তরের সব শ্রেণির রোগীরা সমতার ভিত্তিতে সেবা পেতে পারেন। যদি সমতার ভিত্তিতে রোগীদের সেবা প্রদান করা না হয়, তা হলে ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠা করতে হলে রোগীদের মধ্যে সমতা বিধান করতে হবে।

ডায়াবেটিক সমিতি প্রতিষ্ঠার পেছনে তার আরও একটি বিশেষ যুক্তিও ছিল। যেহেতু ডায়াবেটিস রোগটা প্রায় সারা জীবনের রোগ, এটা কোনো ডাক্তারের পক্ষে নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে ভালো করে দেওয়া সম্ভব নয়। আর এ রোগের বিরুদ্ধে রোগীকে সবচেয়ে বেশি তৎপর হতে হয়। রোগীর সচেতনতা এবং তৎপরতার ওপর তার ভালো-মন্দ নির্ভর করে। এ ক্ষেত্রে ডাক্তারের ভূমিকা পরামর্শদাতা এবং ট্রেনিং দানকারী হিসেবে সীমাবদ্ধ। তিনি মনে করতেন, এরূপ একটি সারা জীবনের রোগকে সামনে রেখে রোগীর কাছ থেকে ভিজিট নেওয়াটা লজ্জাজনক। আবার ডায়াবেটিস কোনো নির্দিষ্ট বয়সের রোগ নয়, শিশুদের হয়, যুবক-যুবতীদের হয়, শ্রমিকদের হয়।

আবার অতিরিক্ত খাদ্য খেয়ে পরিশ্রম না করলে অতিরিক্ত মোটা হলেও হয়। পিতামাতা থেকে উত্তরাধিকার সূত্রেও হতে পারে। গর্ভধারণ করলেও হয়। জন্মগতভাবেও ডায়াবেটিস হতে পারে। শুনতে একটি সাধারণ রোগ মনে হলেও এর ভয়াবহতা বিরাট। ডায়াবেটিস হলে শরীরে প্রয়োজনীয় ইনসুলিনের মাত্রা কমে যায়, শরীর ইনসুলিন তৈরি করতে পারে না, প্রস্রাবের সঙ্গে শর্করা বের হয়ে যায়। এতে রোগী দুর্বল হয়, ধীরে ধীরে শরীরে অন্যান্য অঙ্গেও ছড়িয়ে যায়। এত ভয়াবহতার মধ্যেও এ রোগের একটা বৈশিষ্ট্য হলো- সময়মতো, নিয়মিত চিকিৎসা করে এবং রোগী জীবনযাত্রার নিয়মকানুন মেনে চললে এ রোগকে নিয়ন্ত্রণ করে সারা জীবন কর্মক্ষম জীবনযাপন করা সম্ভব।

আবার নিয়ন্ত্রণ না করলে রোগী পরিবার এবং সমাজের বোঝা হয়ে ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুবরণ করে। এমন ভয়াবহ রোগটি সম্বন্ধে তখনকার দিনে আমাদের দেশে সচেতনতা ছিল একেবারে শূন্যের কোঠায়। এই অবস্থায় একদিকে এর ভয়াবহতা প্রতিরোধ; অন্যদিকে ডায়াবেটিক রোগীদের ভবিষ্যৎ অস্বাভাবিক হবে না এবং সমাজ ও পরিবারের বোঝা হয়েও থাকবে না, যদি নিয়মিত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যায়। অধিকন্তু এ রোগীও স্বাভাবিক মানুষের মতো কর্মক্ষম জীবনযাপন করে পরিবার, সমাজ ও দেশকে কিছু দিতে পারবে। মূলত এটাই ছিল ডায়াবেটিক সমিতির প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য।

অনেক চিন্তা এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে তিনি স্থির করেছিলেন ডায়াবেটিক রোগীর সেবা করার জন্য। তিনি বিশ্বাস করতেন, একজন রোগীর সেবা তখনই পূর্ণাঙ্গ হবে, যখন তার অর্থনৈতিক অবস্থা দুর্বল হলেও অভাবজনিত কারণে তাকে চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। তিনি সুনির্দিষ্ট বিধান করে গিয়েছেন বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির প্রতিষ্ঠানে, যারা নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন তাদেরকে এসব বিশেষ আদর্শ, লক্ষ্য এবং সেবাদানের বিশেষ পদ্ধতির সঙ্গে একাত্ম হতে হবে।

এসব মানসিকতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ প্রদান করা হয়। নিয়োগ প্রদান করার পর তাদেরকে সেভাবে অনুপ্রাণিত করার জন্য বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। বিশেষ করে ডাক্তার এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের এক মাসের ওরিয়েন্টেশন, ট্রেনিং বা প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ডাক্তারদের জন্য রয়েছে আরও বিশেষ ব্যবস্থা। ডায়াবেটিক সমিতির প্রতিষ্ঠানে রোগীদের চিকিৎসাসেবা প্রদানের সঙ্গে সমাজকল্যাণমূলক সেবা প্রদানের যে ব্যবস্থা বা সুযোগ রয়েছে, তা অন্য প্রতিষ্ঠানে বা বিভাগ বা অন্য কোনো চিকিৎসালয়ে অথবা হাসাপাতালে নেই।

লেখক : সাবেক সচিব এবং এনবিআরের চেয়ারম্যান; বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সাবেক চিফ কোঅর্ডিনেটর