ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৪ ১৪৩০

ইয়াবার চেয়েও ভয়ানক মাদক ‘খাত’: ডা. অরূপ রতন চৌধুরী

তানভীরুল ইসলাম

প্রকাশিত : ০৩:৪০ পিএম, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮ রবিবার | আপডেট: ০৫:০৫ পিএম, ১৪ নভেম্বর ২০২০ শনিবার

সর্বগ্রাসী মাদক শেষ করে ফেলছে এদেশের তরুণ প্রজন্মকে। স্কুল-কলেজ, শহর-নগর, গ্রাম-গঞ্জ, সর্বত্রই এখন মাদকের ছড়াছড়ি। এ অবস্থায় দেশকে মাদক মুক্ত করতে শুরু হয়েছিল মাদক বিরোধী অভিযান। এখনো দেশের বিভিন্ন এলাকায় চলছে এ অভিযান। এর মাঝেই দেশে ‘খাত’ নামে নতুন এক মাদকের আবির্ভাব ঘটে। যা নিয়ে শঙ্কিত এদেশের মানুষ। এ বিষয়ে একুশে টেলিভিশন অনলাইনের সঙ্গে কথা বলেছেন ডা. অরূপ রতন চৌধুরী। যিনি দীর্ঘ ত্রিশ বছর ধরে ধুমপান ও মাদক নিয়ন্ত্রণে কাজ করছেন, নিজের পেশার বাহিরে এসে সমাজকে বদলে দেওয়ার চিন্তায়, এ দেশের যুব সমাজকে রক্ষায় নিরলসভাবে এখনো কাজ করে যাচ্ছেন।

ইটিভি অনলাইন: দেশে মাদক বিরোধী অভিযান চলছে এর মাঝেই ‘খাত’ নামে নতুন একটি মাদকের নাম ওঠে এসেছে। এই মাদকটি সম্পর্কে জানতে চাই?
ডা. অরূপ রতন চৌধুরী: বাংলাদেশে মাদকের যে সমস্যা তা ইতোমধ্যে সরকার নির্ধারণ করেছে। মাদক বিরোধী যেসব সংগঠন কাজ করে তারাও এই সমস্যা চিহ্নিত করেছে। ফলে সরকার এখন জিরো টলারেন্সে আছে এবং মাদক বিরোধী অভিযান চলছে। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে যে নতুন মাদকটি ধরা পড়েছে যেটিকে আমরা `খাত` বলছি, সেটা সম্পূর্ণ নতুন ধরনের মাদক। কয়েকদিন আগে যে চালানটি ধরা পড়ল তাতে আমরা জানতে পারলাম এমন একটি মাদক দেশে এসেছে।

ইটিভি অনলাইন: এ মাদকের উৎপত্তি কোথায়?
ডা. অরূপ রতন চৌধুরী: মাদকটি ইথিওপিয়া, সোমালিয়া এসব আফ্রিকান দেশে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ওই সব দেশের আশি-নব্বই ভাগ লোক মাদকটি সেবন করে থাকে। মাদকটি সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের দেশে এসেছে এমনটি বললে ভুল হবে। গবেষণায় দেখা গেছে, গত কয়েক বছর যাবৎ মাদকটি এদেশে আসছে। আমাদের অনুসন্ধান টিম বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কিন্তু এখনো পর্যন্ত এটা আবিষ্কার করতে পারেনি। মাত্র গত সপ্তাহে আবিষ্কার হল যে মাদকটি আসছে।

ইটিভি অনলাইন: ‘খাত’ মাদকে কী ধরনের ক্ষতি হতে পারে?
ডা. অরূপ রতন চৌধুরী: নতুন এই মাদকটি দেখতে চায়ের মতো। এর নাম দেওয়া হয়েছিল ‘টি’ সেহেতু এটাকে মাদক হিসেবে চিহ্নিত করা যায়নি। মাদক সাধারণত পাউডার জাতীয় হয়। ইয়াবা যে একটা ট্যাবলেট, সেটা চিহ্নিত করা গেছে। কিন্তু নতুন এই মাদকটি চিহ্নিত করা যায়নি। এটিকে ‘নিউ সাইকোট্রফিক সাবস্ট্যানসেস’, সংক্ষপে এনপিএস বলা হয়। মাদকাসক্তদের কাছে এর নাম হচ্ছে ‘খাত’ বা ‘খাট’।  

মাদকটি কিন্তু ইয়াবার চেয়ে ভয়ংকর। বৈজ্ঞানিকভাবে দেখা যায় ইয়াবার যেসব গুণাগুণ রয়েছে যেমন যৌন উত্তেজনা সৃষ্টি, তিন চারদিন ঘুম না হওয়া, খিদে না লাগা বা শুকিয়ে যাওয়া- এসব উপসর্গ কিন্তু নতুন `খাত` মাদকটিতে রয়েছে। দেখা যাচ্ছে মাদকটি ইয়াবার সমসাময়িক। `খাত` মাদকটিও জনপ্রিয় হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। আন্তর্জাতিক মাদক পাচারকারীদের যে চক্র, ড্রাগস ডিলার্স রয়েছে তারা কিন্তু বুঝতে পারছে বাংলাদেশ সরকারের মাদক নির্মূলের পরিকল্পনা রয়েছে। ইতোমধ্যে মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের যৌথ কমিটি হয়েছে। দীর্ঘদিন যাবৎ বৈঠক চলছে। এমন সিদ্ধান্ত হচ্ছে যেন দুই দেশে এমন মাদক আর না আসে। এটা বুঝতে পেরেই কিন্তু মাদক চক্র এখানে মাদক প্রবেশ করাচ্ছে।  

ইটিভি অনলাইন: কিভাবে আমরা এই মাদক থেকে বের হয়ে আসতে পারি।
ডা. অরূপ রতন চৌধুরী: নতুন যে মাদকটি আসছে সেটি স্থল বা নৌ পথে আসছে না। এটি আসছে বিমান পথে। তাই এখনই যদি বিমান বন্দরগুলোতে অনুসন্ধানী তৎপরতা আরও জোরদার করা যায় তাহলে সহজে এই মাদকের ছোবল থেকে বের হয়ে আসা যাবে। এই মাদক চায়ের ব্যাগে, মাস্কের ভেতর, নানা ধরনের বাক্সে, যে কোনো ধরনের ঢাকনা দেওয়া বস্তুর মধ্যে নিয়ে আসা সম্ভব। এখন আমাদের এখানে কিছু গলদ রয়েছে যার ফলে এটা শনাক্ত করা খুব সমস্যা।

মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অর্থাৎ যারা মাদক নির্মূলে কাজ করছেন তাদের আরও বেশী সক্রিয় হতে হবে। তাদেরকে এ সংক্রান্ত বিষয়ে ট্রেনিং দেওয়া যেতে পারে যাতে প্রাথমিক অবস্থায় মাদকটি বন্ধ করা যায়। অন্যথায় এটার ফলাফল ইয়াবার চেয়েও ভয়াবহ হবে।

ইটিভি অনলাইন: সরকার মাদক বিরোধী অভিযান যেভাবে শুরু করেছিল এখন সেভাবে আর হচ্ছে না বা বন্ধ হয়ে গেছে। এক্ষেত্রে মাদক নিয়ন্ত্রণ কিভাবে হবে বলে করেন?
ডা. অরূপ রতন চৌধুরী: সরকার মাদক বিরোধী যে উদ্যোগটা নিয়েছিল সেটা কিন্তু এখনো বন্ধ হয়নি। ছোট খাট অভিযান কিন্তু চলছে। খবরের কাগজে নিয়মিত আসছে বিভিন্ন জেলায় মাদক ব্যবসায়ীরা গ্রেফতার হচ্ছে, প্রত্যেক জেলায় মাদকের চোরাচালান আটক হচ্ছে। তবে এর মাধ্যমে প্রমাণ হয় এখনো মাদক আসা বন্ধ হয়নি। মাদককারবারীদের আইনের আওতায় যেমন আনা হচ্ছে আবার অনেকে বন্দুক যুদ্ধে নিহত হচ্ছে। সুতরাং মাদক বিরোধী অভিযান বন্ধ হয়নি বা কমে যায়নি। যে খবরগুলো আমরা টপ নিউজ হিসেবে দেখতাম বা প্রচার হতো সেগুলো এখন আমরা দেখতে পাচ্ছিনা।

ইটিভি অনলাইন: মাদক আসাতো বন্ধ হচ্ছে না। তাহলে আমাদের করণীয় কী?
ডা. অরূপ রতন চৌধুরী: আমি মনে করি সরকার জিরো টলারেন্স হিসেবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে মাদক নির্মূলের যে নির্দেশ দিয়েছে তা যেন অব্যাহত রাখে। পাশাপাশি মিডিয়ারও উচিত এ ধরনের নিউজগুলোকে হাইলাইটসে নিয়ে আসা। এই যে নতুন মাদক `খাত` আসলো, এটা আমরা ছোট ছোট নিউজ হিসেবে দেখছি। এক্ষেত্রে আরও বেশি প্রচার দরকার। এটা কিন্তু ভয়ংকর একটা মাদক, যুব সমাজের জন্য হুমকী। এই বিষয়ে আমাদের আরও সতর্ক হতে হবে।

ইটিভি অনলাইন: তরুণ প্রজন্ম এই মাদক থেকে কিভাবে বের হয়ে আসতে পারে?
ডা. অরূপ রতন চৌধুরী: মাদক থেকে বের হয়ে আসার জন্য আমাদেরকেই ভুমিকা রাখতে হবে। আমরা যদি আমাদের সন্তানদের ঘর থেকে বের হওয়ার সময় সতর্ক করতে না পারি তাহলে তাদের বিপদের সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ দেশের বৃহৎ অংশ তরুণ। এই তরুণরাই কিন্তু মাদকাসক্ত হয়। তাদের এখন মাদকাসক্ত হওয়ার বয়স। এই সময় যদি তাদেরকে সতর্ক করা না যায় তাহলে শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর হলেও কোনো লাভ হবে না। আমাদের ঘর থেকেই সেই আন্দোলন শুরু করতে হবে।

সুতরাং আমাদের সন্তানদের সতর্ক করতে হবে। নতুন মাদক সম্পর্কে মানুষকে অবহিত করতে হবে। স্কুল, কলেজেসহ সব জায়গায় মাদক বিরোধী অভিযান যেন অব্যাহত থাকে তা খেয়াল রাখতে হবে। সরকার যেমন মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে তেমনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো যেন সতর্ক থাকে সেই প্রচেষ্টা চালাতে হবে। স্কুলের আশপাশের এলাকাগুলো এখন মাদকের আখড়া। শিক্ষকরা যেন ছাত্রছাত্রীদের দিকে খেয়াল রাখে সেই ব্যাপারে শিক্ষকদের সচেতন করতে হবে। বিশেষ করে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল কর্তৃপক্ষকে বেশী সতর্ক থাকতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আশ-পাশে মাদক বিক্রীর দোকান, ঘাঁটি, দালাল- যারা আছে তাদের সমূলে উৎপাটন করতে হবে।

ইটিভি অনলাইন: আপনি দীর্ঘদিন থেকে ধূমপান ও মাদকবিরোধী আন্দোলন করছেন। পেশার বাহিরের এসব কাজে নিজেকে কতটুকু সফল মনে করছেন?     

ডা. অরূপ রতন চৌধুরী: দেখুন আমি দীর্ঘ উনত্রিশ বছর ধরে এসব আন্দোলন সংগ্রামে জড়িত। আমি একজন দন্ত চিকিৎসক হলেও ১৯৮৯ সালে মাদক ও ধূমপানবিরোধী সংগঠন ‘মানস’ প্রতিষ্ঠা করি এবং এ সংগঠনের মাধ্যমে দেশের যুব সম্প্রদায়কে ধূমপান ও মাদকদ্রব্যের কুফল সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করছি।

প্রথমে আমার আন্দোলন শুরু হয়েছিল ধূমপান দিয়ে। আজকে দেখেন একটা সফলতা এসেছে। বাংলাদেশ সরকার তামাক নিয়ে আইন জারি করেছে। এখন পাবলিক প্লেসে কেউ ধূমপান করতে পারবে না। করলে তার জরিমানা হবে। পাবলিক প্লেস বলতে আমরা বুঝি স্কুল- কলেজ, বাজার, স্টেশন, লঞ্চ, ঘাট ইত্যাদি। সব জায়গায় এখন ধূমপান নিষিদ্ধ। এখন টেলিভিশনে কোন ধরনের বিজ্ঞাপন প্রচার হয় না। কোন ধরনের স্পন্সর হয়না সিগারেটের। এখন কোন বিলবোর্ডে সিগারেটের বিজ্ঞাপন দেখা যায়না। এটাই আমাদের আন্দোলনের স্বার্থকতা।

একই ভাবে মাদকটাও সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে গেছে। এ নিয়েও আমরা কাজ করছি। দেশের অলি গলি, আনাচে কানাচে এখন ইয়াবা পাওয়া যায়। সুতরাং মাদকের বিরুদ্ধে সচেতন করার সময় এসেছে। আমি নিজেও এখন মাদক নিয়ন্ত্রণ বোর্ড ও মাদক নিয়ন্ত্রণ টাস্কফোর্সের সদস্য। একটা সংগঠনের সাথে কাজ করতে গেলে সরকারের সহায়তা লাগে। সরকারের সহায়তা নিয়ে বিভিন্ন কাজের পাশাপাশি আমরা মিডিয়াতে বিভিন্ন তথ্যচিত্র নির্মাণ করে দিচ্ছি। সাম্প্রতিক কালে ‘স্বর্গ থেকে নরক’ নামে একটা পূর্ণ দৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছি। যেটা তথ্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে সব জেলায় প্রদর্শন করা হচ্ছে। সচেতন করাটাই আমাদের উদ্দেশ্য। তেমনি ভাবে প্রতি বছর বই মেলায় আমরা স্টল দিই। একমাস ব্যাপী সচেতনতামূলক প্রচার কাজ চালাই। তরুণদের সচেতন করার জন্য লিফলেট, পোষ্টার তাদের হাতে তুলে দিই। তাছাড়া আমরা প্রতিটি স্কুল, কলেজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছেলেদের হাতে লিফলেট, পোষ্টার তুলে দিচ্ছি। সুতরাং নিজের পেশার পাশাপাশি সামাজিক কাজগুলো করে যাচ্ছি। এর মাঝে নিজের একটা তৃপ্তি রয়েছে। শ্রুতিলিখন: আলি আদনান   

এসি