ঢাকা, বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ১১ ১৪৩১

আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতির নতুন সমীকরণ

মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মদ আলী শিকদার (অব.)

প্রকাশিত : ১১:২৩ এএম, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮ সোমবার | আপডেট: ০২:২৪ পিএম, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮ সোমবার

গত ৬ জুলাই দিল্লিতে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেমস ম্যাটিস ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী নির্মলা সীতারামনের সঙ্গে যে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকটি করলেন তার মধ্য দিয়ে ভারত-আমেরিকার সম্পর্ক সব জল্পনা-কল্পনাকে পেছনে ফেলে নতুন এক উচ্চতায় পৌছে গেলো।

কূটনৈতিক জগতে এটি পরিচিতি লাভ করেছে ২+২ ডায়ালগ বা সংলাপ হিসেবে। চলমান বৈশ্বিক রাজনীতি, ক্ষমতাবলয়ের নতুন মেরুকরণ এবং এরই মধ্যে সূচিত নতুন বিশ্বব্যবস্থার যে চিত্র তার বাস্তবতায় আলোচ্য ২+২ সংলাপের গুরুত্ব অনেক।

নারীর ক্ষমতায়ন ও নারী স্বাধীনতার প্রবক্তা পশ্চিমা বিশ্বের দুই পুরুষ মন্ত্রী যখন এশিয়ার রক্ষণশীল দেশ ভারতের দুই নারী মন্ত্রীর সঙ্গে মুখোমুখি হয়ে স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি নিয়ে দরকষাকষির টেবিলে ঘাম ঝরান, তখন প্রতীকী হলেও যে সত্যটি উন্মোচিত হয় সেটি হলো আর পশ্চিম নয়, ভবিষ্যতে এশিয়াই হবে বিশ্বের সব কর্মকাণ্ডের সেন্টার অব গ্র্যাভিটি বা ভরকেন্দ্র।

দিল্লিতে অনুষ্ঠিত এই ২+২ বৈঠকটি অনেক আগেই ওয়াশিংটনে হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ইরান ও রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের চলমান সম্পর্ক এবং লেনদেন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আপত্তির কারণে সেটি হতে পারেনি। কিন্তু সব আপত্তিকে  পেছনে ঠেলে এবং উহ্য রেখে আমেরিকার দুই টপ নীতিনির্ধারক দিল্লি ছুটে এসেছেন এবং উভয় দেশের জন্যই অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি চুক্তি বহু দেন-দরবারের পর স্বাক্ষর করেছেন।

চুক্তিটির শিরোনাম—কমিউনিকেশন কম্প্যাটিবিলিটি অ্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাগ্রিমেন্ট, সংক্ষেপে কমকাসা (Communication Compatibility and Security Agreement-COMCASA)। এই চুক্তির বাইরে উভয় দেশ ২০১৯ সালে ভারত মহাসাগরে বড় আকারের যৌথ সামরিক মহড়ার ব্যাপারে একমত হয়েছে। এই চুক্তির ফলে এখন থেকে উভয় দেশ পারস্পরিক অত্যন্ত সংবেদনশীল গোপনীয় সামরিক যোগাযোগ সম্পর্কে অবহিত থাকবে। তাতে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে অন্য সব দেশের চলাচল ও তৎপরতার তথ্য দুই দেশের জন্যই নিজস্ব সোর্সের বাইরে অন্য আরেকটি সোর্স থেকে পাওয়ার অতিরিক্ত একটি সুযোগ সৃষ্টি হলো।

ভারত এর বাইরে আরো বড় দুটি সুবিধা পাবে। পাকিস্তানের ওপর আমেরিকার যে সার্ভেইল্যান্স বা পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা রয়েছে তার মাধ্যমে যেসব জঙ্গি সন্ত্রাসীদের ভারত ও আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে পাকিস্তান ব্যবহার করবে সেটির আগাম তথ্য যুক্তরাষ্ট্র পেলে ভারতের কাছেও চলে আসবে।

এই যোগাযোগব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য ভারত এতদসংক্রান্ত প্রয়োজনীয় সব সরঞ্জাম যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ক্রয় করবে এবং তার মাধ্যমে এই অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির প্রযুক্তিও ভারতের হাতে চলে আসবে। ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক এখন কোন পর্যায়ে এসে উঠেছে তা বোঝার জন্য আরো কয়েকটি বিষয়ের ওপর নজর দেওয়া প্রয়োজন। যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে সম্প্রতি স্ট্র্যাটেজিক ট্রেড অথরাইজেশন-১ (এসটিএ-১) মর্যাদা দিয়েছে।

এর ফলে ভারতের কাছে উচ্চ প্রযুক্তি, যার মধ্যে প্রতিরক্ষা ও পারমাণবিক প্রযুক্তিও অন্তর্ভুক্ত, বিক্রির অনুমোদন দেওয়া মার্কিন প্রশাসনের জন্য সহজ হবে। সারা বিশ্বের মাত্র ৩৭টি দেশকে আমেরিকা এই সুবিধা দিয়ে থাকে। পুরো এশিয়ায় এই সুবিধাপ্রাপ্তদের মধ্যে ভারত হলো তৃতীয় দেশ। এর আগে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া এই সুবিধা পেয়েছে। এই তালিকাভুক্তির জন্য পূর্বশর্ত হিসেবে একটি দেশকে আগেই অন্য চারটি সংস্থার সদস্য হতে হয়।

বাকি তিনটিতে হলেও এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিউক্লিয়ার সাপ্লায়ার গ্রুপের (এনএসজি) সদস্য ভারত এখনো হতে পারেনি চীনের বিরোধিতার কারণে। কিন্তু এটি একেবারে ব্যতিক্রম ঘটনা যে এনএসজির সদস্য হওয়ার আগেই আমেরিকা ভারতকে এসটিএ-১ এর মর্যাদা দিল। এর আগে চারটিতে অন্তর্ভুক্তির আগে কোনো দেশকেই এই সুবিধা আমেরিকা দেয়নি।

আমেরিকার পক্ষ থেকে এতখানি ছাড় দেওয়া হয়েছে বলেই ৬ সেপ্টেম্বর দিল্লিতে কমকাসা স্বাক্ষর সম্ভব হয়েছে। তবে বিগত সময়ের সুনির্দিষ্ট কয়েকটি ঘটনার জন্য ভারতের নীতিনির্ধারক ও  থিংকট্যাংকের একাংশ আমেরিকাকে এখনো পুরোপুরি আস্থায় নিতে পারছে না। যেমন—১৯৮২ সালে পাকিস্তানের কাছে আমেরিকা গোপন বার্তা পাঠায় এই মর্মে যে ভারত-ইসরায়েল একসঙ্গে পাকিস্তানের পারমাণবিক স্থাপনার ওপর আক্রমণ চালাতে পারে।

দ্বিতীয়ত, ১৯৯৮ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ি এক গোপন বার্তায় প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনকে বলেছিলেন, চীনের হুমকি মোকাবেলা করার জন্যই ভারতকে পারমাণবিক বোমার পরীক্ষা চালাতে হয়েছে। এই গোপন বার্তাটির বিষয়ে আমেরিকা চীনকে জানিয়ে দেয়।

তৃতীয়ত, পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থার পৃষ্ঠপোষকতায় ২০০৮ সালের নভেম্বরে ভারতের মুম্বাইয়ে ভয়াবহ সন্ত্রাসী আক্রমণ হয়। তাতে ভারতের অনেকেই সন্দেহ করে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা কর্তৃক সন্ত্রাসীদের প্রস্তুতিকরণের খবর আমেরিকা ভারতকে জানাতে ব্যর্থ হয়েছে। আর নয়তো জানার পরও তা গোপন করেছে। তবে গত কয়েক বছরে আমেরিকার অবস্থান ও কার্যক্রম দেখে বোঝা যায় ভবিষ্যতে এতদঞ্চল-সংক্রান্ত যেকোনো ইস্যুতে ভারতের চাওয়া-পাওয়াটা আমেরিকার কাছে অগ্রাধিকারের শীর্ষে থাকবে।

পক্ষান্তরে পাকিস্তানকে ভবিষ্যতে আমেরিকার দুয়োরানি হয়েই থাকতে হবে। গত ৩ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের বহুল প্রচারিত ডন পত্রিকার এক সম্পাদকীয়তে বলা হয়, ৩০০ মিলিয়ন ডলারের সাহায্য বাতিল হওয়ার পরপরই আবার আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও কি জন্য পাকিস্তানে আসছেন। তিনি কি পাকিস্তানি নেতাদের বকাবকি করবেন, কূটনৈতিক শিষ্টাচার শেখাবেন, নাকি ভারতে যাওয়ার আগমুহূর্তে দুয়োরানির দরজায় একবার কড়া নেড়ে যাওয়া।

দু’দেশের সম্পর্ক এখন সর্বনিম্ন পর্যায়ে থাকলেও আফগানিস্তান ও পারমাণবিক অস্ত্রের অপব্যবহারের আশঙ্কায় পাকিস্তানকে এই মুহূর্তে আমেরিকা একেবারে ত্যাগ করতে পারছে না। পাকিস্তানের পক্ষেও এই মুহূর্তে আমেরিকাকে ত্যাগ করা সম্ভব নয়। কারণ এখনো পাকিস্তানের সমরাস্ত্রের প্রায় ৮০ শতাংশ আমেরিকান অরিজিন। আফগানিস্তান ইস্যুতে আমেরিকা চায় পাকিস্তান যেন আমেরিকার নির্দেশিত পথে থাকে।

কিন্তু আফগানিস্তানে পাকিস্তানের নিজস্ব এজেন্ডা রয়েছে। পাকিস্তানের মাটিতে উৎপত্তি হওয়া আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে পাকিস্তান যথেষ্ট করছে বলে আমেরিকা মনে করে না। পাকিস্তানও হয়তো বুঝতে পেরেছে তেলে-জলে মিশবে না। তাই হয়তো আমেরিকার শত্রু ও প্রতিপক্ষ ইরান ও রাশিয়ার দিকে পাকিস্তান ঝুঁকে যাচ্ছে, আর চীনের সঙ্গে তো পাকিস্তান সর্বতোভাবে জড়িয়ে আছে।

সুতরাং উপমহাদেশের ভূ-রাজনীতিকে কেন্দ্র করে বৈশ্বিক শক্তিবলয়ের অবস্থান পরিবর্তনের একটা ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, যদিও সেটির পূর্ণাঙ্গ রূপ দেখার জন্য আরো কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে।

কমকাসা চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য আমেরিকা ভারতকে বিশাল ছাড় দিলেও ভারত কিন্তু এখনো চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে একটা ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে, যদিও এই অঞ্চলকে ঘিরে চীনের সঙ্গে ভারতের দ্বন্দ্ব ও প্রতিযোগিতা নতুন কিছু নয়।

গত মে মাসে চীনের পর্যটননগরী উহানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিংয়ের মধ্যে অনুষ্ঠিত অত্যন্ত সফল অনানুষ্ঠানিক বৈঠকটি প্রমাণ করে চীন-ভারত উভয় দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব এখন অনেক পরিপক্ব এবং নানা ইস্যুতে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব থাকলেও তাঁরা জানেন কোথায় থামতে হবে। ইরান ও রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান।

কিন্তু তার পরও ভারতের প্রতি আমেরিকার প্রবল আগ্রহের অনেক কারণ আছে। ভবিষ্যতে বিশ্বের ভরকেন্দ্র এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের প্রভাব কাটিয়ে নিজেদের স্ট্র্যাটেজিক স্বার্থ রক্ষা করতে চাইলে ভারতকে পাশে পাওয়া আমেরিকার জন্য একান্ত অপরিহার্য। অন্যদিকে আমেরিকাকে ভারতের প্রয়োজন, যাতে চীনকে চেক অ্যান্ড ব্যালান্সের মধ্যে রাখা যায়।

ভূ-রাজনীতির খেলায় কেউই কাউকে শতভাগ বিশ্বাস করে না, ইতিহাসও সাক্ষ্য দেয় করা যায় না। সব ইস্যুতে ভারত-আমেরিকা এক অবস্থানে আছে তা মোটেও নয়, যা এরই মধ্যে ওপরের আলোচনায় এসেছে। ওপরের আলোচনায় এটিও মোটামুটি পরিষ্কার যে এ অঞ্চলের রাজনীতি ও নিরাপত্তার ইস্যুতে দুই দেশের মধ্যে মতপার্থক্য হলেও শেষ কথা বলার সুযোগ থাকবে ভারতের হাতে।

আর সংগত কারণেই ভারত তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর নিরাপত্তা ও ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষা করার জন্য যা প্রয়োজন সেটাই করবে, কাউকে কোনো ছাড় দেবে না।

লেখক : কলামিস্ট ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক

sikder52@gmail.com