ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৪ ১৪৩০

শিক্ষায় বাণিজ্য বন্ধে দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে: অধ্যাপক আমিনুল হক

প্রকাশিত : ০৬:৪৭ পিএম, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮ শনিবার

ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট বা জনসংখ্যার বোনাসকাল পার করছে দেশ। স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারেও প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ, বিশাল এ অর্জন ও সম্ভাবনার পেছনে চ্যালেঞ্জ ও তা টপকানোর উপায় কি হতে পারে। অন্যদিকে একাডেমিক শিক্ষার সর্বোচ্চ সনদ নিয়েও বছরের পর বছর পার করে দিচ্ছে শিক্ষার্থী, চাকরি মিলছে না।

স্নাতকোত্তর পাশের পর ৩ থেকে ৪ বছর আবার চাকরির জন্য আলাদাভাবে প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে। করতে হচ্ছে কোচিংও। তাহলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার গলদটা আসলে কোথায়?

এসবের সুলক সন্ধানে একুশে টেলিভিশন অনলাইন মুখোমুখি হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক ড. আমিনুল হকের। একুশে টেলিভিশন (ইটিভি) অনলাইনকে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, শিক্ষা খাতে বাণিজ্য বন্ধে সরকারের এককভাবে চাপ দিয়ে কিছু হবে না। প্রকৃত অর্থে এটা বন্ধ করতে হলে দরকার সঠিক অ্যাসেসমেন্ট। দরকার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় উদ্যোক্তাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। উদ্যোক্তারা যদি চায় দেশের পরবর্তী প্রজন্মকে তারা সেবা দিবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিরিক্ত মুনাফা করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের গড়ে ওঠার অন্তরায় সৃষ্টি করবেন না। তাদের এমন সিদ্ধান্তে এক দিনেই শিক্ষা বাণিজ্যে পরিণত না হয়ে সেবায় পরিণত হবে। এ ব্যাপারে সবার আগে উদ্যোক্তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে।

সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন একুশে টেলিভিশন অনলাইন প্রতিবেদক রিজাউল করিম। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের শেষ পর্ব আজ প্রকাশিত হলো-

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিরুদ্ধে বাণিজ্যের ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে।এ থেকে বেরিয়ে এসে শিক্ষাকে নিরেট সেবায় পরিণত করার মূলমন্ত্র কি হতে পারে?  

আমিনুল হক: একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ব্যবসা করবে এটাই স্বাভাবিক। এখানে দোষের কিছু নেই। কিন্তু কেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান একচ্ছত্রভাবে কাজ করছে। কেন তারা  খেয়ালখুশি মতো ফি নির্ধারণ করছে। এর কারণ হচ্ছে যে সমাজে শিক্ষা অর্জনের যে ইতিবাচক ধারা আমরা তৈরি করতে পেরেছি। সেখান থেকেই মানুষ উদ্বুদ্ধ হয়েছে যে না ছেলে-মেয়েদের পড়াতে হবে। তাই শিক্ষার এতো প্রসার ঘটেছে। শিক্ষা এ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত আসা কিন্তু একটা আন্দোলনের ফসল। এখন সব বাবা-মা চাচ্ছেন যে, তাদের সন্তানরা লেখা-পড়া করুক। তাদের পিছনে খরচ করি।

কিন্তু সেখানে ফি কত হবে? কি পরিমান খরচ হবে? এই অ্যাসেসমেন্ট করতে হবে। অ্যাসেসমেন্টটা দুই জায়গা থেকে হতে পারে। একটি হলো-সরকার এখানে রেগুলেট করবেন। আর একটা জায়গা হলো-শিক্ষা খাতে যারা উদ্যোক্তা হিসেবে আসেন তাদের মানবিক হওয়া। উদ্যোক্তাদের ভাবতে হবে যে আমি সেবা দিব?  নাকি শুধুই ব্যবসা করবো?

উদ্যোক্তাদের এ মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি না আসলে সরকার চাপিয়ে দিলেও কাজের কাজ কিছু হবে না। কারণ সরকার চাপ দিরে যা হবে সেটা হলো সরকারের সঙ্গে তাদের দূরত্ব বাড়বে। যারা আজ উদ্যোক্তা বা প্রতিষ্ঠা তারা যদি চিন্তা করেন যে, যারা আমার ভবিষ্যৎ উত্তরসূরি তাদের আমি সেবা দিতে চাই। তাহলে কিন্তু চিত্র একদিনে পরিবর্তন হয়ে যাবে। তারা যদি সিদ্ধান্ত নেন যে , তাদের যে পরিমাণ খরচ হচ্ছে তার থেকে ৫ শতাংশ লাভ করবেন। দেশের স্বার্থে এর বেশি আর লাভ করব না তাহলে শিক্ষা ক্ষেত্রে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এভাবে আর বাণিজ্যের উৎস থাকবে না। শিক্ষা সেবায় পরিণত হবে।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো দেশে গড়ে ওঠা কোচিংগুলোর বিরুদ্ধে বেপরোয়া বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের অনেকেই আবার স্কুলের পাঠ  নেওয়ার চেয়ে কোচিংয়ের শিক্ষাকে গরুত্ব দিচ্ছেন। বিষয়টি আপনি কিভাবে দেখছেন?  

আমিনুল হক: এখন ৩৫ থেকে ৪০ জন শিক্ষার্থীর অনুপাতে একজন শিক্ষক আছেন। এসব শিশুদের অভিভাবকরা কোচিংয়ে টাকা দিচ্ছেন। তাদেকরে যদি বলা হয় আপনারা কোচিংয়ে টাকা দিয়েন না। আমি স্কুলে ২০ জন ছেলে-মেয়ের অনুপাতে একজন শিক্ষক নিচ্ছি। অভিভাবকরা কিন্তু স্কুলে টাকা দেবে না। অভিভাবকরা কোচিংয়ে টাকা দিয়ে শ্রম নষ্ট করে, সময় নষ্ট করলেও স্কুলে কখনও টাকা দিবে না। অভিভাবকদের এ কোচিংমুখী হওয়ার কারণে বাচ্চাদের খেলার সুযোগ নাই। সারাদিন কোচিংয়ে দৌঁড়ে সময় পার করছি।

এখন কোচিংয়ে যে ছেলে বা মেয়ারা পড়াচ্ছে তাদের যদি রাষ্ট্র কর্মসংস্থান দেয় এবং অভিভাবকদের যদি কোচিংয়ের পরিবর্তে স্কুলমুখী করতে পারি তবে তো কোচিং থাকবে না। উচ্চ শিক্ষিত ছেলে-মেয়েদের কর্মসংস্থান ও স্কুলগুলোতে শিক্ষার মান বাড়িয়ে অভিভাবকদের স্কুলের প্রতি আস্থা তৈরি করতে পারলে কোচিংয়ের রমরমা কমানো যাবে। তাছাড়া বারবার ঘোষণা দিয়ে কোচিং প্রকৃত অর্থে কমানো দূরহ ব্যাপার।  

আমাদের স্কুলে ছেলে-মেয়েরা কতটুকু পড়বে কি কি বিষয় পড়বে তার  সুস্পষ্ট উল্লেখ থাকতে হবে। বিশ্বের অনেক দেশেই ২০ ছাত্রের জায়গায় একজন শিক্ষক আছে। তারা স্কুলে সেসব শিক্ষকদের কাছ থেকে পাঠ নিয়ে সুন্দরভাবে লেখা-পড়া শেষ করছে।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: শিক্ষা ব্যবস্থা হয়ে পড়েছে অনেকটাই সনদনির্ভর। দেশপ্রেম, নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধের প্রচুর ঘাটতি রয়েছে শিক্ষার্থীদের মাঝে। এগুলোর চর্চার অভাবে একজন মেধাবী শিক্ষার্থী দেশের সম্পদ হওয়ার পরিবর্তে অভিশাপে পরিণত হচ্ছে। এ পরিস্থিতি থেকে কীভাবে উত্তরণ ঘটানো যায়?

আমিনুল হক: এখন বাচ্চাদের বড় হওয়া বা গড়ে ওঠার ধরণ পাল্টেছে। আগে আমরা অনেক সময় পরিবারে বাবা বা বড় ভাইয়ের সঙ্গে ভয়ে কথা বলতে পারতাম না। কিন্তু এখন ছেলে-মেয়েরা বাবার সঙ্গে কথা বলছে। বাবার সঙ্গে খেলছে। তাদের আবদার জানাতে পারছে নির্ভয়ে।

পরিবারের সেই যে বেড়ে ওঠাটা আগের তুলনায় ভিন্ন। সেই ভিন্নতা স্কুল পর্যায়েও। আগে আমরা স্কুলের শিক্ষক দেখলে সামনে যেতে ভয় পেতাম। দূর  থেকেই মাথা নুয়ায়ে ফেলতাম। এসবের মধ্যে ভয়ও যেমন ছিল। সম্মানও তেমন ছিল।

আগে একজন শিক্ষকের পরিচয় পেলেই সবাই একটা শ্রদ্ধা দেখাতো। এখন  সেই  শ্রদ্ধাবোধটা এমন পর্যায়ে এসেছে যে  একজন ছাত্র শুধু তার ডিপার্টমেন্টের শিক্ষককেই সালাম দিচ্ছে। আর অন্য ডিপার্টমেন্টের হলে সালাম দেওয়াটা ততটা প্রয়োজন মনে করছে না। তবে এ সালাম না দিয়ে যে সুস্পষ্টভাবে শিক্ষকের সম্মান দেওয়াকে ইগনোর করছে তা কিন্তু না। আসলে বর্তমান প্রজন্মে কাছে সেই চলটায় কমে গেছে যে একজন বয়স্ক মানুষ তাকে সম্মান করতে হবে।

এটা সামাজিক রীতি-নীতি, মূল্যবোধ ও বন্ধন থেকে বেরিয়ে নগরায়ন প্রবণতার কারণে হয়েছে। যার কারণে দেখা যায় একটি ছেলে যখন ঢাকায় থাকছে তখন তিনি কোন বয়স্ককে সম্মান করছে না। পাশে বয়স্ক লোক দাঁড়িয়ে আছে। তাকে সালাম তো দিচ্ছেই না, উল্টো তার সামনে সিগারেট টানছে। কারণ যুবক তাকে চিনে না। সেই একই যুবক যখন গ্রামের বাড়ীতে যাচ্ছে-তখন কিন্তু  সে গ্রামের ছোট দোকান থেকেও একটি বিড়ি কিনে খেতে ইতস্তত করছে। ভাবছে কে কোথা থেকে দেখে ফেলবে। সেখানে তার সামাজি  শাসনের ভয় আছে। সেখানে বয়স্ক কেউ সিগারেট খেতে দেখলে খারাপ ভাববে, তার পরিবার বা বংশের সম্মান নষ্ট হবে। সে ধারণায় যুবককে সিগারেট টানা থেকে বিরত থাকতে হচ্ছে। আবার   বয়স্ককে সালামও দিতে হচ্ছে। অবশ্য যে গ্রামে যত বেশি নগরায়ণের প্রভাব পড়েছে সে গ্রামে তত বেশি এ  সম্মান দেয়ার প্রচলন কমেছে।

অধিক নগরায়ণের ফলে আজ শিক্ষার্থীদের মাঝে শিক্ষক ও বয়স্কদের সম্মান দেয়া যেমন কমেছে। তেমন বেড়েছে অনৈতিক কার্যকলাপ। বলার কেউ না থাকায় বা সামাজিক শাসন না থাকায় তারা সহজেই অপকর্মে লিপ্ত হতে পারছে। ফলে মাদক, জুয়া ও বড় ধরণের অপরাধের জন্ম হচ্ছে।

/ এআর /