ঢাকা, শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

অ্যাপভিত্তিক বিনোদন: ভালো নাকি মন্দ?

শাওন সোলায়মান

প্রকাশিত : ০৭:০৩ পিএম, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৮ রবিবার | আপডেট: ০৫:৩৬ পিএম, ৭ অক্টোবর ২০১৮ রবিবার

টেলিভিশন বা প্রেক্ষাগৃহের বাইরে ভার্চুয়াল জগতে বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে মানুষের প্রথম পছন্দ ইউটিউব। এর পাশাপাশি বর্তমান সময়ে দর্শক বাড়ছে আইফ্লিক্স, বায়োস্কোপ, বঙ্গ বা থার্ডবেলের মতো ইন্টারনেট ও মোবাইল অ্যাপভিত্তিক বিনোদন প্ল্যাটফর্মে। দিন দিন দর্শকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় শুধু এসব প্ল্যাটফর্মের জন্য বর্তমানে নির্মিত হচ্ছে বিশেষ নাটক, টেলিফিল্ম কিংবা চলচ্চিত্র। কিন্তু বিনোদনের নতুন এই মাধ্যম কতটা ইতিবাচক আর কতটাই বা নেতিবাচক তা নিয়ে আছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।

ইন্টারনেটভিত্তিক বিনোদন মাধ্যমের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে বিশ্বে পরিচিত নাম নেটফ্লিক্স। আর বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নেটফ্লিক্সের পাশাপাশি দিন দিন জনপ্রিয়তা পাচ্ছে বায়োস্কোপ, আইফ্লিক্স, বাংলাফ্লিক্স, বঙ্গ এবং থার্ড বেল। মোটামুটিভাবে ২০১৫ থেকে ২০১৬ সালের দিকে বাংলাদেশে যাত্রা শুরু করে এসব প্ল্যাটফর্ম।

ইন্টারনেট ব্রাউজার অথবা মোবাইল অ্যাপস দিয়ে গান, চলচ্চিত্র, নাটক, প্রামাণ্যচিত্র থেকে শুরু করে দেশের বেশকিছু টিভি চ্যানেলও লাইভ দেখা যায় এসব প্ল্যাটফর্মে। কোনো কোনো আবার দেখা যায় ব্রাউজার ও অ্যাপ দুই মাধ্যমেই।

নেটফ্লিক্সের মতো প্ল্যাটফর্মের জন্য নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্র যেগুলোর বেশিরভাগই বিশ্বজুড়ে ব্যাপক আলোচিত হয়। বাংলাদেশের দর্শকদের জন্য কনটেন্ট পরিবেশন করা প্ল্যাটফর্মগুলোর জন্য অবশ্য এখন পর্যন্ত তৈরি হয়নি কোনো চলচ্চিত্র। পুরোনো বাংলা ছায়াছবির বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র প্রকাশ পেয়েছে এসব প্ল্যাটফর্মে। যেমন থার্ডবেলে পিঁপড়াবিদ্যা, আইফ্লিক্সে স্বপ্নজাল ইত্যাদি।

তবে এসব প্ল্যাটফর্মের জন্য বিশেষভাবে নির্মিত হয়েছে নাটক এবং মিউজিক ভিডিও। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে টেলিভিশনগুলোতে সম্প্রচারিত নাটকের বেশিরভাগই এখন পাওয়া যায় আইফ্লিক্স, বায়োস্কোপ, বাংলাফ্লিক্স, বঙ্গ এবং থার্ডবেলের মতো ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোতে।

দর্শক সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এসব প্ল্যাটফর্মের বিভিন্ন দিক আসতে শুরু করেছে আলোচনায়। অনেকেই এমন উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন। আবার অনেকেই উদ্বিগ্ন এসব প্ল্যাটফর্মের কনটেন্টের মান নিয়ে। অনেকেই আবার দেখছেন সুদূরপ্রসারী লাভ ও ক্ষতি।

এসব প্ল্যাটফর্মে নিয়মিত নাটক দেখেন রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নূরে আলম। তিনি জানান, এসব প্ল্যাটফর্মে নাটক বা চলচ্চিত্র দেখতে গেলে কোনো বিজ্ঞাপন দেখতে হয় না। তাই এগুলোতেই নিয়মিত নাটক দেখেন তিনি। নূরে আলম বলেন, টিভিতে নাটকের বিরতিতে বিজ্ঞাপন দেখায় নাকি বিজ্ঞাপনের ফাঁকে ফাঁকে নাটক দেখায় সেটাই বুঝি না। তাই বায়োস্কোপেই বেশিরভাগ সময় নাটক দেখি। এখানে বিজ্ঞাপনজনিত ঝামেলা নেই।

যেকোনো সময় যেকোনো স্থান থেকেই মনের মতো কনটেন্ট দেখা যায় বলে আইফ্লিক্সে নাটক দেখেন সামাজিক কর্মী জেবিন ইসলাম। তিনি বলেন, নির্দিষ্ট সময়ে টিভি সেটের সামনে বসে নাটক দেখা আর সম্ভব হয়ে ওঠে না এখনকার দিনে। তাই ইউটিউব বা নেটফ্লিক্সেই বেশি নাটক দেখি। তবে ইউটিউবে অনেক সময় পাইরেসিজনিত সমস্যা থাকে। তাই অন্যের কনটেন্ট যারা নিজেদের বলে চালিয়ে দেয় তারা যেন নিরুৎসাহিত না হয় সেজন্য ইউটিউবে অনেক কিছু দেখি না। এছাড়াও অ্যাপগুলোতে এখন বেশ কয়েকটি টিভি চ্যানেল লাইভ দেখা যায়। তাই টিভি সেটের সামনে না থাকলেও টিভি দেখার সুযোগ থাকে এখানে।

এ ধরণের ডিজিটাল বিনোদন প্ল্যাটফর্মে কাজের বেশ সুযোগ রয়েছে বলে মনে করছেন দেশের মিডিয়া সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। বিশেষ করে তরুণ নির্মাতা ও অভিনেতা-অভিনেত্রীরা বেশ ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতেই দেখছেন এসব প্ল্যাটফর্মের বিস্তারকে। তরুণ অভিনেতা আমির পারভেজ বলেন, "নেটফ্লিস্ক, আইফ্লিক্স বা বায়োস্কোপের মতো ওয়েব প্ল্যাটফর্মগুলোর সুবাদে বিনোদন এখন মানুষের হাতের মুঠোয়। একটা সময় মানুষের ইচ্ছে থাকলেও বিনোদনের একটি নির্দিষ্ট গন্ডির বাইরে যেতে পারতেন না। আর বর্তমানে ভিডিও নির্ভর সাইটগুলোর কল্যাণে তা সম্ভব হচ্ছে। শুধু তাই নয় যারা এক সময় শুধু মাত্র টেলিভিশন প্রোডাকশনগুলোর উপর নির্ভরশীল ছিলেন তাদেরও কাজের পরিধি বাড়ছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি একটা শ্লোগানে বিশ্বাসী যে, মিডিয়ার পেছনে না ছুটে নিজেই নিজের মিডিয়া তৈরি করো। তাই আমরা যারা মিডিয়ার পেছনে না ঘুরে নিজেই মিডিয়া তৈরি করতে চাই তাদের জন্য এইসব সাইটগুলো সহায়ক হবে"।

তবে এসব প্ল্যাটফর্মের কনটেন্টের মান নিয়েও আছে বেশকিছু অভিযোগ। এছাড়া চলচ্চিত্রের মতো সেন্সরশিপ বা টিভি নাটকের মতো সম্প্রচার নীতিমালার মতো সুনির্দিষ্ট আইন বা নীতিমালা না থাকার কারণে এসব প্ল্যাটফর্মে অনেক সময়ই আপত্তিকর কনটেন্ট চলে আসছে বলে অভিযোগ অনেকের।

অনেকেই আবার এসব প্ল্যাটফর্মকে বাংলাদেশের প্রেক্ষাগৃহ এবং এই ব্যবসায় জড়িতদের কর্মসংস্থানের জন্য হুমকি হিসেবে দেখছেন। একই সঙ্গে দেশীয় টেলিভিশন খাত হারাতে পারে দর্শক এমন অশনি সংকেতও দিচ্ছেন কেউ কেউ।  

বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সাবেক সভাপতি এবং রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী মধুমিতা সিনেমা হলের কর্ণধার ইফতেখার নওশাদ বলেন, যুগের প্রয়োজনে এসব প্ল্যাটফর্মে এখন আমরা নাটক সিনেমা দেখছি। এটা ভালো; অন্তত এখন শুরুতে। কিন্তু ভবিষ্যতে এটি বেশ নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে; বিশেষ করে দেশের প্রেক্ষাগৃহ ব্যবসায়। প্রেক্ষাগৃহের সঙ্গে অনেক মানুষের কর্মসংস্থান জড়িত। কিন্তু এসব ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের কারণে একসময় আবেদন কমে আসবে হলগুলোর। তখন এই মানুষগুলো কর্মসংস্থান হারাবে।

এর থেকে ভিন্ন মত পোষণ করেন জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং পরিচালক গিয়াস উদ্দিন সেলিম। ভালো ছবি কম নির্মিত হওয়া এবং হলগুলোর সার্বিক অবস্থা ভালো না হওয়াতেই দর্শক মূলত এসব প্ল্যাটফর্মের দিকে ঝুঁকছেন বলে মনে করেন তিনি।

গিয়াস উদ্দিন সেলিম একুশে টিভি অনলাইনকে বলেন, মানুষ নেটফ্লিক্স বা বায়োস্কোপে যতই ছবি দেখুক না কেন হলের আবেদন কমবে না। এগুলোতে হয়তো একজন বসে সিনেমা দেখলো কিন্তু যারা দলবেধে অথবা হৈ হুল্লোড় করে যারা সিনেমা দেখতে চায় তাদের জন্য সিনেমা হলের বিকল্প নেই। যেমন নেটফ্লিক্সের কারণে হলিউডের থিয়েটারগুলোতে তো দর্শক কমেনি। এমনকি প্রতিবেশি দেশ ভারতেও এ ধরণের কোনো প্রভাব পরেনি। এগুলো হলগুলোর জন্য সাংঘর্ষিক হবে না বরং বিকল্প হবে। আর দর্শক যেন হল বিমুখ না হয় সেজন্য ভালো ছবি দরকার। ঢেলে সাজাতে হবে হলগুলোকেও।

তবে এসব প্ল্যাটফর্মগুলো যেন একটি নির্দিষ্ট নীতিমালায় এসে কার্যক্রম পরিচালনা করেন সেদিকে জোর দেন এই দুই চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব। ইফতেখার নওশাদ এসব প্ল্যাটফর্মকে একেবারে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ছেড়ে না দিয়ে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ও আইনের আওতায় এনে পরিচালনার জন্য সরকারের প্রতি অনুরোধ জানান। একই সঙ্গে প্ল্যাটফর্মগুলোর কনটেন্ট নিয়ে যেন প্রশ্ন না ওঠে সেজন্য বয়সভিত্তিক গ্রেডিং করে কনটেন্ট প্রকাশের পরামর্শ দেন গিয়াস উদ্দিন সেলিম।

অন্যদিকে বাংলাদেশের বিনোদন খাতে ইতিবাচক প্রভাব রাখছে বলে মনে করছেন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্তা ব্যক্তিরা। ২০১৬ সালে বাংলাদেশের যাত্রা করার পর এখন পর্যন্ত প্রায় তিন কোটি দর্শক আছে বায়োস্কোপের।

প্ল্যাটফর্মটির মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান মোবাইল ফোন অপারেটর গ্রামীণফোনের হেড অব কমিউনিকেশন সৈয়দ তালাত কামাল বলেন, "ইন্টারনেট এর সুবাদে সারা পৃথিবীই  এখন ডিজিটাল মিডিয়ার প্রতি আগ্রহী।বাংলাদেশীদের বিনোদনের মাধ্যম খুবই সীমিত থাকা সত্ত্বেও একটি জনগোষ্ঠী আছে যারা বেছে বেছে ভালো দেশীয় সিনেমা দেখে . তাদের জন্য বাংলা এন্টারটেইনমেন্টকে আমরা আরও সহজলভ্য এবং প্রেক্ষাগৃহের সম্পূরক একটি মাধ্যম হিসেবেতাদের হাতের নাগালে এনে দিতে চাই, যেন ক্রমবৃদ্ধিহারে পজিটিভ একটি গ্রাহকবেজ আমরা পাই"।

তালাত কামাল আরও বলেন, "২০২০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের প্রায় ৮০-৯০ শতাংশ ডিজিটাল কাভারেজের আওতায় পরবে। তাই বায়োস্কোপএর মতন এন্টারটেইনমেন্ট প্লাটফর্মের কোনো বিকল্প নেই"।

দেশের বাজারে আরেক জনপ্রিয় ডিজিটাল কনটেন্ট প্ল্যাটফর্ম মালয়েশিয়া ভিত্তিক আইফ্লিক্স। বাংলাদেশে মোবাইল ফোন অপারেটর রবি’র সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমান সময়ের কনটেন্টগুলো ডিজিটাল হওয়াতে দেশে এধরণের প্ল্যাটফর্ম শুধু বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে নয় বরং গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়িক ক্ষেত্র তৈরি করবে বলে মনে করে বাংলাদেশে প্ল্যাটফর্মটির কান্ট্রি ম্যানেজার ইমরুল করিম এমিল। এছাড়া কন্টেন্টের মান এবং প্ল্যাটফর্মটির কার্যক্রমের ধরণ হল ব্যবসার সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয় বলেও মন্তব্য করেন এমিল। তিনি বলেন, আমরা যদি ভাল কনটেন্ট বানানোর অভ্যাস দাঁড় করাতে পারি, আমরা বিশ্বাস করি বড় পর্দার জন্য ভাল বাজেটও আসবে, পরিচালকেরাও ভাল কনটেন্ট বানাবেন। আমরা এটাও বিশ্বাস করি যে ডিজিটাল এবং বড়পর্দা মিলেও একটা নতুন ব্যাবসায়িক মডেল দাঁড় করানো সম্ভব দর্শকদের ভাল কিছু দেওয়ার জন্য। 

আইফ্লিক্সের কন্টেন্ট সম্পর্কে ইমরুল করিম এমিল আরও বলেন, আইফ্লিক্সে আমাদের মুল লক্ষ্য হচ্ছে সবার জন্য ভাল কনটেন্ট প্রদান করা।যেই কারণে আমরা যখনি কোনো কনটেন্ট তৈরি করি, সবার আগে আমরা নিশ্চিত করি যে,কনটেন্টটি যেন সবারজন্য বিনোদন মূলক হয় এবং আমাদের সংস্কৃতি বা মনোভাবে যেন কোন আঘাত না হানে।যার জন্য আমাদের প্ল্যাটফর্মে আইফ্লিক্স কিডস নামে একটি আলাদা সেকশন রয়েছে শিশুদের জন্য।    

/ এআর /