নারীর ক্ষমতায়নে ইশতেহারে সেবামূলক কাজ নিয়ে অঙ্গীকার দরকার
প্রকাশিত : ১২:১৪ এএম, ৬ নভেম্বর ২০১৮ মঙ্গলবার

বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহারে গৃহস্থালির সেবামূলক কাজের স্বীকৃতিবিষয়ক কোন অঙ্গীকার নেই। একইসঙ্গে দেশের আইন, নীতি, বাজেট কিংবা দেশের অর্থনীতির মাপকাঠি জিডিপিতেও এই কাজের মূল্যায়ন ও স্বীকৃতির বিষয়টি অনুপস্থিত। যে কারণে বাংলাদেশের নারীর ক্ষমতায়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
সোমাবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গৃহস্থালি সেবামূলক কাজ নিয়ে প্রকাশিত একটি নীতি পর্যালোচনাপত্রে এমন ফলাফল উঠে এসেছে। একশনএইড বাংলাদেশ-এর তত্ত্বাবধায়নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক মফিজুর রহমান এই নীতি পর্যালোচনা পত্রটি ‘একশনএইড-ডিইউডিএস ন্যাশনাল ডিবেট ক্যাম্পেইন ২০১৮’ এর চূড়ান্ত পর্বের অনুষ্ঠানে তুলে ধরেন।
অনুষ্ঠানে সরকারের মন্ত্রী, গবেষক, রাজনৈতিক দলের নেতারা বলেছেন রাজনৈতিক অঙ্গীকারনামায় গৃহস্থালি সেবামূলক কাজ যুক্ত করা উচিত। তবেই অমূল্যায়িত সেবামূলক কাজের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক মূল্যায়ন হবে।
অনুষ্ঠানের শুরুতে ‘অমূল্যায়িত সেবামূলক কাজের মূল্যায়ন, স্বীকৃতি ও পুনর্বন্টন: নীতি ও রাজনৈতিক ইশতেহারের পর্যালোচনা’ শীর্ষক একটি গবেষণাপত্র তুলে ধরেন অধ্যাপক মফিজুর রহমান। যেখানে বলা হয়, বাংলাদেশে একজন নারী তার জীবনের প্রায় ১২ বছর রান্নাঘরে কাটিয়ে দেন। ২০১৭ সালে গাইবান্ধা ও লালমনিরহাটে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায় এ কাজে নারীরা দৈনিক সময় দেন ৭.৭৭ ঘন্টা এবং পুরুষরা ১.৩২ ঘন্টা। পুরুষের তুলনায় বেশি সময় কাজ করার কারণে নারীরা অর্থনেতিক কাজে যুক্ত হতে পারেন না। মানসিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়েন, বাধাগ্রস্থ হয় নারীর ক্ষমতায়ন।
অনুষ্ঠানের সঞ্চালক একশনএইড বাংলাদেশ-এর কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির বলেন, কোন নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠী বিশেষ করে নারীদের পিছিয়ে রেখে দেশের উন্নয়ন সম্ভব না। তাই গৃহস্থালি সেবামূলক কাজের স্বীকৃতি, মূল্যায়ন ও পুনর্বন্টনের জন্য নীতিগত পর্যায় থেকে শুরু করে প্রতিটি পর্যায়ে পরিবর্তন আনতে হবে। বাস্তবতা হলো আমাদের দেশের কোন আইন নীতি কিংবা রাজনৈতিক দলিলে এই বিষয়ে করণীয় বা অঙ্গীকার নেই। যা সমস্যাটিকে জিইয়ে রাখছে”।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভলপমেন্ট স্টাডিজ-এর সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন সবার আগে জরুরি, প্রয়োজন গৃহস্থালি সেবামূলক কাজে নারী-পুরুষের সমান অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ।
উপস্থাপিত গবেষনায় দেখা যায়, ঘরের সেবামূলক কাজ অমূল্যায়িত, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত নয়; কোন জাতীয় অর্থনৈতিক পরিসংখ্যানে এর উল্লেখ নেই, তাই এ কাজের পুনর্বন্টন ও হ্রাসকরণের জন্য কোন বিনিয়োগ ও উদ্যোগ নেই। তাই এই বিষয়টি যে কোন পরিকল্পনায় সম্পূর্ণ অনুপস্থিত এবং তা নারীর জন্য বোঝা হয়েই থেকে যাচ্ছে। যেটির একটি বড় কারণ রাজনৈতিক অঙ্গীকার অর্থাৎ ইশতেহারে প্রতিফলন নেই। দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলের বিগত রাজনৈতিক ইশতেহার বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল যেমন- আওয়ামী লীগ ও বিএনপি, এদের নির্বাচনী ইশতেহারে অনুপস্থিত। বর্তমানে বাংলাদেশের বিদ্যমান কোন নীতি ও আইনে গৃহস্থালির সেবামূলক কাজ নিয়ে এমন কিছু বলা নেই যা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি)-৫ অর্জনে ভূমিকা রাখবে।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য ও মাসিক উত্তরণের সম্পাদক এবং প্রকাশক নূহ উল আলম লেনিন বলেন, “নারীর ক্ষমতায়নে যেমন অনেক উন্নতি সাধন হয়েছে তেমনি নতুন নতুন সমস্যা তৈরি হয়েছে। এসকল সমস্যা সমাধানে নির্বাচনী ইশতেহারে এবং জাতীয় নারী নীতিতে গৃহস্থালির সেবামূলক কাজের স্বীকৃতি বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। আর সেটি হলে নারীর ক্ষমতায়ন আরো তরান্বিত হবে।”
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি বাংলাদেশ সরকারের অর্থপ্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান এ বিষয়ে বলেন, “গৃহস্থালির সেবামূলক কাজের স্বীকৃতি ও মূল্যায়ন নিয়ে কাজ করা জরুরি। নারীর ক্ষমতায়ন অর্জন করতে পারলে স্বীকৃতি ও মূল্যায়ন অর্জনের কাজটিও সহজ হয়ে আসবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
সংলাপে সুপারিশ করা হয়, রাজনৈতিক ইশতেহারে গৃহস্থালির সেবামূলক কাজ বিষয়টি নিয়ে আসতে হবে যাতে নারীর অবদান তার স্বীকৃতি পায়। জাতীয় নীতিতে এটি অন্তর্ভুক্ত করা হলে জাতীয় প্রবৃদ্ধি ৭৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে, সে জন্য প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা এবং কাঠামোগত পরিকল্পনা। প্রয়োজন জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১- এর বাস্তবায়ন পরিকল্পনাতে গৃহস্থালির সেবামূলক কাজের মূল্যায়ন অন্তর্ভুক্তিকরণ ও স্থানীয় ও জাতীয় নীতিমালা প্রণয়নে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ।
এ পর্বে আরও বক্তব্য রাখেন ডিইউডিএস-এর প্রেসিডেন্ট এস এম রাকিব সিরাজী, সাধারণ সম্পাদক আব্দুল্লাহ আসাদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন এবং গাইবান্ধার কাঞ্চনীপাড়া ইউনিয়ন ফেডারেশনের সভাপতি বিথী বেগম।
একশনএইড বাংলাদেশ বিশ্বাস করে দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরিত করতে এবং নারীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে গৃহস্থালি কাজের স্বীকৃতি, মূল্যায়ন ও পুনর্বন্টন দরকার।
এর পরিপ্রেক্ষিতে একশনএইড বাংলাদেশ বিতর্কের মাধ্যমে বাংলাদেশের তরুণদের এই বিষয়ে যুক্ত করতে এই দেশব্যাপী বিতর্ক উৎসবের আয়োজন করে। সমগ্র দেশে ৫টি বিভাগীয় পর্যায় শেষে সকল বিভাগীয় চ্যাম্পিয়ন ও রানারআপদের অংশগ্রহণে আয়োজিত হয় চূড়ান্ত পর্ব। এই পর্বে উত্তীর্ণ হয় চট্টগ্রাম ইউনিভার্সিটি ডিবেটিং সোসাইটি এবং বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব টেক্সটাইল ডিবেটিং ক্লাব। কঠিন যুক্তি-তর্কের পর জুরি বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুসারে একশনএইড-ডিইউডিএস ন্যাশনাল ডিবেইট ক্যাম্পেইন ২০১৮-এর জয়ী হয় বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব টেক্সটাইল এবং রানার-আপ হয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
এর আগে সকালে অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মো: আখতারুজ্জামান। তিনি বলেন, গৃহস্থালি সেবামূলক কাজকে অর্থনৈতিকভাবে স্বীকৃতি দিলে বাংলাদেশের জন্য এসডিজি অর্জন করা আরো সহজ হবে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর টিএসসি চত্ত্বর থেকে একটি র্যালি বের করা হয়। এছাড়া দিনব্যাপী বিতর্ক প্রতিযোগিতার পাশাপাশি গৃহস্থালি সেবমূলক কাজবিষয়ক কর্মশালা ও বিষয়ভিত্তিক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়।
এস এইচ/