ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৫ ১৪৩০

সাড়ে ৮ হাজার কর্মীকে বিনামূল্যে খাওয়ায় স্নোটেক্স

শাওন সোলায়মান

প্রকাশিত : ০৬:০২ পিএম, ৭ নভেম্বর ২০১৮ বুধবার | আপডেট: ১০:০৬ পিএম, ৭ নভেম্বর ২০১৮ বুধবার

প্রতিষ্ঠান নিয়ে সাধারণত কর্মীদের মাঝে কম বেশি অসন্তোষ থাকেই। তবে স্নোটেক্স গ্রুপের কর্মীদের মাঝে প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগের বদলে আছে সন্তুষ্টি। এর কারণও আছে। সাড়ে ৮ হাজার কর্মীর মানসম্মত স্বাস্থ্যকর খাবারের ব্যবস্থা করা হয় প্রতিষ্ঠানটির নিজস্ব অর্থায়নে। পাশাপাশি কর্মীদের খাবার খরচ বাবদ সরকার নির্ধারিত মাসিক ৬৫০ টাকা ভাতাও দেওয়া হয়। কর্মীদের কাজের প্রতি উৎসাহ বাড়াতে দেওয়া হয় সপ্তাহিক উৎপাদন বোনাস এবং কর্মস্থলে উপস্থিতির হাড় বাড়াতে দেওয়া হয় উপস্থিতি বোনাস। নিরাপদ কর্ম পরিবেশ নিশ্চিত করার পাশাপাশি বছর শেষে কর্মীদের ভাগ দেওয়া হয় লভ্যাংশে।

স্নোটেক্স গ্রুপের যাত্রা ২০০০সালে। স্নোটেক্স গ্রুপে এমন অনেক কর্মী এখনও আছেন যারা শুরু থেকেই ছিলেন উদ্যোগটির সঙ্গে। ১৮ বছরের পথচলায় কর্মীবান্ধব পরিবেশের জন্য দেশের তৈরি পোশাক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বেশ নাম কুড়িয়েছে স্নোটেক্স।

স্নোটেক্স গ্রুপের চারটি উৎপাদন কারখানায় কর্মরত আছেন প্রায় ১১ হাজার কর্মী। এর একটি আউটারওয়্যার অবস্থিত ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পাশেই ধামরাইয়ে। সাত তলা বিশিষ্ট চার লাখ বর্গফুট আয়তনের এই কারখানাটিতেই কাজ করেন প্রায় সাড়ে আট হাজার কর্মী।

আর বিশাল এই লোকবলের দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করা হয় প্রতিষ্ঠানটির নিজস্ব অর্থায়নে। আর এক্ষেত্রে কর্মকর্তা কর্মচারীদের পদবী অনুযায়ী কোনো ভেদাভেদ করা হয় না। একই রান্না করা খাবার খান সবাই। খাবার হিসেবে থাকে ভাত, ভর্তা, সবজি, ডাল, ডিম, মাছ বা মাংসের তরকারি।

এক দুপুরে স্নোটেক্স আউটারওয়্যারে গিয়ে দেখা যায়, সপ্তম তলার ক্যান্টিনে মধ্যাহ্নভোজ সেরে নিচ্ছেন কর্মীরা। এক সঙ্গে প্রায় এক হাজার ৪০০ জন কর্মীর খাওয়ার ব্যবস্থা আছে এখানে। এভাবে পালা করে রোজ দুপুরের খাবার খান প্রায় সাড়ে আট হাজার কর্মী।

প্রতিষ্ঠানটির এক নারী কর্মী আমেনা খাতুন বলেন, এখানে (স্নোটেক্সে) আমি দুই বছর ধরে কাজ করছি। আগে যত জায়গায় কাজ করেছি সেখানে এমন খাবার পেতাম না। এখানে যা পাচ্ছি।

প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিপুল সংখ্যক এই কর্মীদের দুপুরের খাওয়া বাবদ স্নোটেক্স গ্রুপের খরচ হয় রোজ প্রায় আড়াই লাখ টাকা। আর মাসের হিসেবে তা ৬৫ লাখ টাকারও বেশি। এর পাশাপাশি কর্মীদের খাবার খরচ বাবদ সরকার নির্ধারিত মাসিক ৬৫০ টাকা ভাতাও দেওয়া হয়।

কর্মীদের খাবারের গুণগত মান নিশ্চিত করতে বিভিন্ন ধরণের সবজি এবং আমিষ জাতীয় খাদ্য ব্র্যাক, কাজী ফার্মস এবং আফতাব এর মতো স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান থেকে ক্রয় করা হয়। আর সবশেষে খাবার রান্না হওয়ার পর তাঁর স্বাস্থ্য ও পুষ্টিগুণ ঠিক আছে কী না তা যাচাই করে নেওয়া হয় নিজস্ব ল্যাবরেটরিতে।

কর্মীদের খাওয়া বাবদ এই খরচকে ইতিবাচক হিসেবে দেখা হয় স্নোটেক্সের পক্ষ থেকে। প্রতিষ্ঠানটির সহকারি পরিচালক (অপারেশন) জয়দুল হোসেন বলেন, একজন কর্মীর খাবার যদি আমরা ব্যবস্থা করি তাহলে সে রোজ ১ঘন্টা সময় পায় নিজের জন্য। এই সময়ে সে বিশ্রাম নিতে পারে অথবা ঘুমাতে পারে। এমনকি কর্মী যদি বাসা থেকে খাবার নিয়ে আসে তাহলে দুপুরে সেই খাবার খেতে খেতে সতেজ থাকে না। আর আমরা এখানে কর্মীদের সতেজ খাবার সরবরাহ করি। এতে সে সুস্থ থাকে। এর ফলে প্রতিষ্ঠানের কাজে আরও অবদান রাখতে পারে কর্মীরা।

মধ্যাহ্ন বিরতিসহ প্রতিদিনের কর্মঘন্টা থেকে ১ ঘন্টার বিরতি পান কর্মীরা। এসময় কর্মীদের বিশ্রাম ও বিনোদনের জন্য বিভিন্ন সুবিধা রাখা হয়েছে স্নোটেক্সের পক্ষ থেকে। শিল্প কারখানার পাশাপাশি মিশেল ঘটানো হয়েছে প্রকৃতির ছোঁয়ার।

সবজি ও ফুল বাগান, সবুজ মাঠ, খেলাধুলার জন্য প্লে-গ্রাউন্ডসহ আছে পুকুরপাড়। এছাড়া নারী কর্মচারীদের শিশুদের জন্য আছে শিশু পরিচর্যাকেন্দ্র। আছে লিফট ব্যবহারের সুবিধা।

২০১৪ সালে কারখানাটির উৎপাদন শুরুর পর থেকে শতভাগ কমপ্লায়েন্স অর্জন করে স্নোটেক্স আউটারওয়্যার। বর্তমান সময়ে কারখানাটিতে বিদ্যুৎ সাশ্রয় হয় ৮৩ শতাংশ, মেশিনের শক্তি সঞ্চয় হয় ৫৫ শতাংশ, বৃষ্টির পানি ব্যবহারযোগ্য করা হয় প্রায় ৫০ শতাংশ এবং পানির ব্যবহার কমানো হয়েছে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত। একইসঙ্গে শতভাগ পারদ এবং সিএফসিমুক্ত পরিবেশে পরিচালিত হয় কারখানাটি।

কর্মীদের প্রতি প্রতিষ্ঠানটির কৃতজ্ঞতার আরেক বহিঃপ্রকাশ ঘটে এর লভ্যাংশ দেওয়ার মাধ্যমে। গত অর্থ বছরে স্নোটেক্স গ্রুপের মুনাফার ১২ শতাংশ পরিমাণ লভ্যাংশ বোনাস আকারে দেওয়া হয় কর্মীদের। চলতি অর্থ বছরে দেওয়া হবে ১৫ শতাংশ। আর আগামী অর্থ বছরে এই পরিমাণ বাড়িয়ে মুনাফার ২০ শতাংশই কর্মীদের বাঝে বিতরণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে।

এছাড়া কর্মীদের কাজের প্রতি উৎসাহ বাড়াতে দেওয়া হয় সপ্তাহিক উৎপাদন বোনাস এবং কর্মস্থলে উপস্থিতির হাড় বাড়াতে দেওয়া হয় উপস্থিতি বোনাস। আর মূল বেতনের সঙ্গে এসব বোনাস কর্মীরা পেয়ে যান মাসের শেষ কর্মদিবসেই। এছাড়াও চাকরি বা প্রভিডেন্ট ফান্ডের মেয়াদ দুই বছর অতিক্রম করলেই শ্রমিক নিজের ও মালিক পক্ষের উভয় অংশই পেয়ে যান।

নিজেদের প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে স্নোটেক্সের প্রধান উদ্যোক্তা এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম খালেদ জানান, শুরুতে খুবই ছোট একটা অ্যাক্সেসরিজ সাপ্লাই প্রতিষ্ঠান হিসেবে আমরা যাত্রা করি। প্রথম ৬ মাস খুবই কঠিন ছিলো। তবে প্রায় ৫ বছর পর আমরা যখন উৎপাদনমুখী ব্যবসা শুরু করি তখন পাঁচ হাজার পিসের অর্ডার দিয়ে শুরু করি।

আমাদের প্রথম সাফল্যটা আসে এই অর্ডার ডেলিভারি করার সময়। ডেলিভারির সময়ই আমরা একই গ্রাহক থেকে আরও ৪০ হাজার পিসের অর্ডার পাই। এর পরের তিন বছরে আমাদের অর্ডারের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৪ লক্ষ পিসের। এরপর গ্রাহকদেরকে সঙ্গে নিয়ে আমরা যৌথ উদ্যোগে মিরপুরে প্রথম কারখানা শুরু করি।

স্নোটেক্স গ্রুপের শুরু থেকে বর্তমান অবধি এই সাফল্যের জন্য কর্মীদের অবদানই মুখ্য বলে মনে করেন এস এম খালেদ। তিনি বলেন, শুরু থেকেই আমরা স্নোটেক্সকে ‘প্রফিট আর্নিং’ হিসেবে না নিয়ে আমাদের যে কাজ করা দরকার সেটি করার চেষ্টা করেছি। আমাদের যখন যেটা করার ছিলো সেটিই করেছি। সততা এবং প্রতিশ্রুতিকে আমরা সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিই। আর এখন পর্যন্ত এটা সম্ভব হয়েছে আমাদের কর্মীদের জন্য।

তিনি বলেন, আমাদের প্রতিষ্ঠানের প্রতি তাদের আন্তরিকতা ভালোবাসা এতটা বেশি যে, শুরুতে আমরা যে দু’জন বা দশজন ছিলাম তাদের অনেকেই এখনও আছেন। আর এই বিশাল জনবলের জন্য আমাদের পক্ষ থেকে আছে নানান সুবিধা। গার্মেন্ট ব্যবসা খুবই কঠিন। এরমধ্যেই আমাদের সাধ্যমত সবটুকু করার চেষ্টা করি আমরা। দেশিয় শ্রম আইনের বাইরে গিয়ে কর্মীদের জন্য এসব সুবিধা আমরা নিশ্চিত করছি”।

এক প্রশ্নের জবাবে এস এম খালেদ বলেন, ব্যবসায়িক যাত্রায় আমি তেমন কোনো প্রতিবন্ধকতা পাইনি। আমার সঙ্গের কর্মীরাই সব কাজ করেছেন আর আমার জন্য সবকিছু সহজ করেছেন। আমার কাজ হচ্ছে যে, তাদের কোন সমস্যা আছে কী না সেটা দেখে তার সমাধান করা। তারা যদি ভালো থাকে তাহলে এই প্রতিষ্ঠানও ভালো করবে।

/ এআর /