ঢাকা, মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ২ ১৪৩১

প্রতীক সমাচার

‘ধানের শীষে’ কামাল হাসে

ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ

প্রকাশিত : ১২:০০ পিএম, ২৯ নভেম্বর ২০১৮ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ০৬:৩৪ পিএম, ৩০ নভেম্বর ২০১৮ শুক্রবার

বাংলাদেশের নির্বাচনে ‘নির্বাচনী প্রতীক’ বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। প্রার্থীর চেয়ে প্রতীক হয়ে দাঁড়ায় জয়-পরাজয়ের বাটখারা। আর হবেই বা না কেন, ফলাফল ঘোষণার পর যে ‘নির্বাচনী প্রতীক’-এর সংখ্যা যত বেশি তার কদর তত বেশি। দিনের শেষে ‘নির্বাচনী প্রতীক’এর সংখ্যাইতো নির্ধারণ করবে কে বা কাহারা সরকার গঠন করবে, তাই না?

আমাদের রাজনৈতিক জীবনে ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট’-এর মশাল জ্বালিয়ে গণতন্ত্রের পথে নতুন দিশারী হয়ে আবির্ভুত হয়েছেন সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. কামাল হোসেন। আমরা তাকে দেশ ও জাতির ক্রান্তিলগ্নে ‘উধাও’ হতে দেখি বরাবর। ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হল। কেউ দেশে মুক্তিযুদ্ধে গেল, কেউ সীমানা অতিক্রম করে ভারতে ট্রেইনিং-এ। আবার কেউ বা মুজিব সরকারের পক্ষে প্রচারণায়। কিন্তু ‘উধাও কামাল’ পাকিস্তানি সামরিক জান্তার কোলে স্বেচ্ছায় ‘উধাও’ হল। এ কারণে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ থেকে এম আর আখতার মুকুল ‘চরম পত্রে’র ভাষায় ‘পাকিস্তানি জামাই কামাইল্লা’কে নিয়ে তিনটি চরমপত্র পাঠ করেছিলেন।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে প্রথম নির্বাচনেই ড. কামাল হোসেন ‘নৌকা’ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেছেন। কোনবারই ‘নৌকা’ প্রতীক তার জন্য সরাসরি বরমাল্য নিয়ে আসেনি। ১৯৭৩ সালে জাতির জনক নিজে সরে বসে ড. কামাল হোসেনকে ‘নৌকা’তে ঠাই দিয়েছিলেন বৈকি! ড. কামাল হোসেনও তখন ‘বিনা প্রতিদন্দ্বিতায়’ বাকুম বাকুম করে ‘নৌকা’য় চেপে বসেছিলেন। ‘বিনা প্রতিদন্দ্বিতা’-র নির্বাচন ব্যাপারটি তখন তার একটুও অগণতান্ত্রিক মনে হয়নি। 

কিন্তু সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ঠিক আগে আগেই বঙ্গবন্ধু সরকারের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ‘উধাও কামাল’ ব্যাক্তিগত সফরে বিদেশে ‘উধাও’ হলেন। এতটাই ‘উধাও’ হলেন যে একটি প্রেস কনফারেন্স করে বিশ্ব মিডিয়াকে তখনকার প্রকৃত অবস্থা জানানোর প্রয়োজন মনে করলেন না। আফসোস!

পঁচাত্তরের পট পরিবর্তনের পর সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসেন। ক্ষমতায় থেকে তিনি বিএনপি নামক রাজনৈতিক দলটি গঠন করেন। আর দলের নির্বাচনী প্রতীক হিসেবে বেছে নেন ধানের ছড়াকে। কিন্তু ধানের ছড়াকে তিনি কি যেন মনে করে ‘ধানের শীষ’ নাম দিয়ে দিলেন। আর সেই থেকে ধানের ছড়া হয়ে গেল ‘ধানের শীষ’। আমরা জানি যে, ধানের মুকুল থেকে যখন সবে সবুজ ধান বের হয় তখন তাকে ধানের শীষ বলে। এই অবস্থায় ধানের কাণ্ডের মাথায় মুকুল থেকে পাতা পরিবেষ্ঠিত ধানের শীষটি সবেমাত্র বের হয়। অপরদিকে ধানের শীষ যখন কিছুদিনের মাথায় পুষ্ট ধানের আকার ধারণ করে ও পাকে তখন তাকে ধানের ছড়া বলে। ধানের ছড়াকে ধানের ছড়া বলাই উচিত।

বিএনপি তার নির্বাচনী প্রতীকে ধানের ছড়ার ছবি ব্যাবহার করে কেন সেটিকে ‘ধানের শীষ’ বলছে এটা আমার মাথায় আসে না। হয়তো ব্যাপারটি হাতির দাঁতের মত। হাতির এক জোড়া দাঁত থাকে দুনিয়াকে দেখানোর জন্য। হাতি কিন্তু সেই দাঁত দিয়ে খাবার খায় না। আবার হাতির লুকানো অন্য দাঁত রয়েছে, যা দুনিয়ার কেউ দেখতে পায় না। হাতি এই লুকানো দাঁত খাবার খাওয়ার জন্য ব্যবহার করে। হয়তো বিএনপি নামক রাজনৈতিক দলটি এই হাতির দাঁতের মাজেজা-কেই তাদের রাজনৈতিক মূলমন্ত্র হিসেবে গ্রহণ করেছে। দেখাব এক, করবো আরেক!

এরপর ১৯৮১ সালে ড. কামাল হোসেন ‘নৌকা’ প্রতীক নিয়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করেছিলেন। কিন্তু সেবার তিনি নৌকার কাণ্ডারী হতে পারেননি। পরাজয় বরণ করে নিয়েছিলেন বিচারপতি আব্দুস সাত্তারের কাছে। ১৯৮১ সালের নির্বাচন বিচারপতি আব্দুস সাত্তারের নির্বাচনী প্রতীক ছিল ‘ধানের শীষ’।

স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের সময় এরশাদের পতন না হওয়া পর্যন্ত ‘উধাও কামাল’ ঘরে ফিরবেন না বলে তিন দিব্যি দিলেন। ১৯৮৪ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মিছিলে সেনাবাহিনীর হামলায় জাফর, জয়নাল, কাঞ্চন, দীপালী সাহাসহ অনেক শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার ঠিক তিন দিনের মাথায় ‘উধাও কামাল’ লন্ডনে ‘উধাও’ হলেন। ৯০’র এরশাদ বিরোধী আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন ২৭ নভেম্বর তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ‘উধাও’ হলেন। ওই দিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় এরশাদের পেটোয়া বাহিনীর হাতে নিহত হন ডা শামসুল আলম মিলন। আন্দোলন তুঙ্গে উঠে। ৪ ডিসেম্বর পদত্যাগের সিদ্ধান্ত জানান এরশাদ। আর ঠিক তার পরদিনই অর্থাৎ ৫ ডিসেম্বর ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’ ঘটল।

ড. কামাল হোসেন ১৯৯১ সালে আবারও ‘নৌকা’ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেছিলেন। কিন্তু এবারো সেই একই ঘটনা। ‘ধানের শীষ’ প্রতীকের প্রার্থীর নিকট হেরে যান। অতএব, ঘটনা পর্যবেক্ষণে বোঝা গেল ‘নৌকা’ প্রতীক নিয়ে ড. কামাল হোসেনের সরাসরি বিজয় লাভের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। এটা তিনি বুঝে গেছেন।

১৯৯১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ হেরে গেলে ‘উধাও কামাল’ একেবারে আওয়ামী লীগ থেকেই ‘উধাও’ হয়ে গেলেন। ১৯৯২ সালে ড. কামাল হোসেন তৈরি করলেন নতুন রাজনৈতিক দল- ‘গণফোরাম’। নির্বাচন কমিশন কর্তৃক নিবন্ধিত গণফোরামের নির্বাচনী প্রতীক হচ্ছে ‘উদীয়মান সুর্য’ আর নিবন্ধন নং হোল ২৪।

১৯৯৬ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ‘চির উদীয়মান সুর্য’ ‘গণফোরাম’ মোট ১০৪টি আসনে প্রার্থী দেয় যাদের সবার জামানত বিপুলভাবে বাজেয়াপ্ত হয়। দলটি ঢাকা বিভাগে ২২ হাজার ৬২৩টি, বরিশাল বিভাগে ১ হাজার ৮২৯টি, খুলনা বিভাগে ১ হাজার ৫৬৫টি, চট্টগ্রাম বিভাগে ৮ হাজার ৬৪০টি, রাজশাহী বিভাগে ১২ হাজার ১৭ টি এবং সিলেট বিভাগে ৭ হাজার ৫৭৬টি অর্থাৎ মোট ভোট পেয়েছিলো ৫৪ হাজার ২৫০টি। যা ছিল ওই নির্বাচনে মোট প্রদত্ত ভোটের (৫ কোটি ৬৭ লাখ ১৬ হাজার ৯৩৫) শূন্য দশমিক শূন্য ৯৫ ভাগ।  

তো এবার ‘উধাও কামাল’ ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট’-এর মশাল হাতে আলাপ-বিলাপ-প্রলাপ-সংলাপ সব কিছুই করলেন। জনগণ ভাবলো ‘উদীয়মান সুর্য’ বাংলাদেশের রাজনীতির মধ্য গগনে নব কুমারের (‘উধাও কামাল’) নব উদ্যমে জ্বলজ্বল করে জ্বলবে। কিন্তু গত ১৫ নভেম্বর আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ‘গণফোরাম’ দলটি ‘ধানের শীষ’ প্রতীকে নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত জানিয়ে নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দিয়েছে। এ কী কথা শুনি আজ মন্থরার মুখে!

১৯৮১ সালে ড. কামাল হোসেন যখন রাষ্ট্রপতি প্রার্থী হয়েছিলেন এবং বিচারপতি আব্দুস সাত্তারের কাছে বিপুল ভোটে পরাজিত হয়েছিলেন, তখন তিনি ঢাকার হোটেল পূর্বাণীতে এক বিশালসংবাদ সম্মেলন করেছিলেন। সেখানে ড. কামাল হোসেন দৃপ্ত কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘ধানের শীষ’ প্রতীক বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাকে কলঙ্কিত করেছে। ‘ধানের শীষ’ প্রতীক হলো প্রতারণা-প্রবঞ্ছনার প্রতীক। ‘ধানের শীষ’ প্রতীক হলো জনগণের ভোটাধিকার হরণের প্রতীক। ‘ধানের শীষ’ প্রতীকের মাধ্যমে বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাসে কলঙ্ক রচনা করা হয়েছে। তাহলে, আজ ড. কামাল হোসেন ‘ধানের শীষ’ প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করে দেশ ও জাতিকে কি উপহার দিতে চাইছেন - কলঙ্কিত নির্বাচনী ব্যাবস্থা, প্রতারণা-প্রবঞ্ছনা, জনগনের ভোটাধিকারের প্রহসন?  

আর তাই, বঙ্কিমচন্দ্রের কপাল কুন্তলার মত ‘উদীয়মান সুর্য’-এর ‘নব কুমারের’ কাছে জাতির এখন একটাই প্রশ্ন – ‘পথিক, তুমি কি (প্রতীক নিয়া) পথ হারাইয়াছ?’

লেখক: আইনজীবী ও আইনের শিক্ষক।

আআ//