ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৫ ১৪৩০

মায়ের মৃত্যু নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কাঁদলেন-কাঁদালেন পাপন

প্রকাশিত : ০৬:৫৯ পিএম, ২৭ ডিসেম্বর ২০১৮ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ০৭:০১ পিএম, ২৭ ডিসেম্বর ২০১৮ বৃহস্পতিবার

(ফাইল ফটো)

(ফাইল ফটো)

একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা ইতিহাসে এক ভয়াবহ কলঙ্ক বহন করে চলেছে। ২০০৪ সালে ওই দিনে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী এবং সে সময়ের প্রধান বিরোধী দলের নেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে গ্রেনেড ছোড়া হয়েছিল। কিন্তু শেখ হাসিনা বেচে গেলেও প্রাণ হারান প্রয়াত রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমানের স্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাবেক মহিলাবিষয়ক সম্পাদক আইভি রহমানসহ আরও অনেকে।

সম্প্রতি এক নির্বাচনি জনসভায় ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পর কিভাবে বিনা চিকিৎসায় মেরে ফেলা হয়েছিল আইভি রহমানকে তার বর্ণনা দেন পুত্র নাজমুল হাসান পাপন। সেদিনের সে ঘটনার স্মৃতিকাতর বর্ণনা দিতে গিয়ে বারবার চোখের পানি ফেলেছেন তিনি। কাঁদিয়েছিলেন জনসভায় উপস্থিত হাজারও মানুষকে।

সেদিনের জনসভায় যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন আইভি রহমান পুত্র নাজমুল হাসান পাপন তা হুবুহু তোলে ধরা হলো-

আমার সামনে তখন লাশের স্তুপ, আম্মার কাছে যেতে হলে সেই লাশ ডিঙিয়ে যেতে হবে, উপায় নাই যাওয়ার কোন। আমি তখন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বললাম, “আম্মা তুমি চিন্তা কইরো না, আমি চলে আসছি।” জানি না কেন যেন আম্মা মাথাটা নাড়লেন তখন, বুঝলাম যে উনি বেঁচে আছেন। ওখানে যারা ছিল, তাদেরকে জিজ্ঞেস করলাম যে এখন কি করতে হবে৷ ওরা বললো ওষুধ লাগবে৷ একটা লিস্ট দিয়ে বললেন, এক্ষুণি এই এই ওষুধগুলা লাগবে৷ আমি বললাম, ঠিক আছে, আপনাদের এখানেই তো ফার্মেসি আছে, ওরা বললো না, হাসপাতালের ফার্মেসি বন্ধ। এটা আজকে আর খুলবে না৷ আশেপাশে অনেক ওষুধের দোকান, শত শত। সব বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, কোন ওষুধ পাবে না কেউ!

এর মধ্যে অবস্থার আরও অবনতি হচ্ছে, কারণ রক্তক্ষরণ থামানো যাচ্ছে না৷ একজন এসে বললো, এই মূহুর্তে অপারেশন করতে হবে৷ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ডাক্তারের অভাব নাই। আমি বললাম, তাড়াতাড়ি ডাকেন তাহলে। ওরা বললো, কাকে ডাকবো? কোন ডাক্তার নাই। আম্মাকে যে একটু দেখবে, সার্জারি করবে, সেরকম একটা ডাক্তারও তখন নাই, সবাইকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। দেখতে দেখতে প্রায় তিন ঘণ্টা চলে গেলো।

আমরা ঠিক করলাম, আম্মাকে এখান থেকে নিয়ে যেতে হবে৷ এমন একটা জায়গায় নিয়ে যেতে হবে, যেখানে আম্মা একটু চিকিৎসা পেতে পারে। অলরেডি এত রক্তক্ষরণ হয়েছে… কোন রকমে আম্মাকে ধরে তুললাম, একটা অ্যাম্বুলেন্স জোগাড় করে সেটাতে ওঠালাম। পিজি হাসপাতালে নিয়ে যাবো। গেট দিয়ে বের হবো, এমন সময় চারদিক থেকে পুলিশের বাধা, কোথায় নাকি যাওয়া যাবে না। আহত কাউকে কোথাও নিয়ে যাওয়া যাবে না! আমি বললাম, তাহলে চিকিৎসাত ব্যবস্থা করেন আপনারা। ডাক্তার আনেন, ওষুধ আনেন৷ ওরা বললো, ওপরের নির্দেশ, আমরা কোথাও যেতে দিতে পারব না!

যাই হোক, তখন আমিও ফোনটোন করা শুরু করলাম। একটা পর্যায়ে তারা বললো, আম্মাকে শুধু সিএমএইচে আমরা নিয়ে যেতে পারব, আর কোথাও না। ভেবে দেখলাম, এখানে তো কোন চিকিৎসাই হচ্ছে না, পানির মতো রক্ত বেরিয়ে যাচ্ছে শরীর থেকে। সিএমএইচ তো ভালো, ওখানে গেলে নিশ্চয়ই চিকিৎসা হবে।

এই কাহিনীগুলা বলার মতো না আসলে। ক্যান্টনমেন্টের গেটে বসিয়ে রাখলো একঘণ্টা, ঢুকতে দিবে না! সিএমএইচে যাওয়ার পর বলে, আর্মি অফিসারের রেকমেন্ডেশন লাগবে! আমার আম্মা ওখানে পড়ে আছে রক্তাক্ত অবস্থায়, মানুষটা মারা যাচ্ছে, এরকম অবস্থায় টানা আট-নয় ঘণ্টা আমার আম্মাকে কোন চিকিৎসা দেওয়া হয় নাই।

একুশ তারিখে গ্রেনেড হামলাটা হয়, তেইশ তারিখ রাত বারোটায় আমি সিএমএইচ থেকে বাসায় আসি। পরদিন থেকে আটচল্লিশ বা বাহাত্তর ঘণ্টার হরতাল, আওয়ামী লীগ ডেকেছিল। ঠিক রাত দুটোর সময় আমাকে ফোন করা হলো, বললো, খবর পেয়েছেন তো? আমি বললাম কি খবর? বললো, আপনার আম্মা তো মারা গেছেন৷ একটু আগে দেখে গেলাম মানুষটা বেঁচে আছেন, এর মধ্যেই মরে গেলেন! আমি বললাম, ঠিক আছে, আমি আসছি।

ফোনের ওপাশ থেকে বললো, এসে কোন লাভ নাই, আমরা দাফন করে দিচ্ছি। আমি বললাম, দাফন করবেন মানে? আমাদের আত্মীয় স্বজন আছে, আমার আব্বা আছেন, সবাইকে জানাতে হবে, জানাজা পড়াইতে হবে, কবর দেয়া- এগুলো আমরা করব। ওরা বললো না, ওপরের নির্দেশ, সব এখানেই করতে হবে! লাশ বাইরে নেওয়া যাবে না! কিসের মধ্যে দিয়ে যে গেছি আমি, আজ পর্যন্ত এগুলো কাউকে বলি নাই৷

কি বলব বলেন? এত কিছু করার পরেও, মানুষের মধ্যে তো মনুষ্যত্ববোধ বলে একটা জিনিস থাকে। এরা কি রাজনীতি করে? বোমা মারলো, হামলা করলো, শত শত মানুষ আহত-নিহত, তাদের চিকিৎসাটাও করতে দিলো না! লাশও নাকি দিবে না! এটা কিসের রাজনীতি রে ভাই?