ঢাকা, সোমবার   ০৭ জুলাই ২০২৫,   আষাঢ় ২৩ ১৪৩২

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের জীবন বদলে দেওয়ার গল্প

প্রকাশিত : ০৩:৫৬ পিএম, ১ জানুয়ারি ২০১৯ মঙ্গলবার | আপডেট: ০৩:৫৮ পিএম, ১ জানুয়ারি ২০১৯ মঙ্গলবার

আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগর আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। প্রতিনিয়ত স্বপ্ন দেখান মানুষকে। মানুষ যখন তীব্র হতাশা ও স্থবিরতা মধ্যে বিরাজ করে। সেই মুহূর্তে তিনি শোনান আশা ও সম্ভাবনার কথা। তিনি একজন অসাধারণ বক্তা। ১৯৭০দশকে তিনি টিভি উপস্থাপক হিসাবে বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। তার নিজের ইউটিউবে চ্যানেলে জীবন বদলে দেওয়ার গল্প নামক একটি ভিডিও আপলোড করছে। তা ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। ভিডিওটি লিখনির মাধ্যমে একুশে টিভি অনলাইন পাঠকদের কাছে তুলে ধরা হলো।

ভিডিওতে তিনি বলছেন, আমি ঢাকা কলেজের শিক্ষক ছিলাম, তখন ঢাকা কলেজের অনেক সুমান ছিলো। ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ নম্বর পেয়েও এই কলেজের ভর্তি হতে পারতো না।  আমি বলতাম মানুষকে আমাদের এখানে এক সেকশনে যে মাধাবি শিক্ষার্থী আছে । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এমন শিক্ষার্থী নয়। ঢাকা কলেজে কিন্তু মেয়েরা পড়ে না। যা আমাদের ছাত্রদের জন্য মর্মবেদনার কারণ ছিলো। দুপুরে হলেই মধ্যন্নভোজ না মধ্যন্নভ্রমণের জন্য বের হতো নিউ মাকের্ট। কারণ ওখানে সুন্দরী মেয়েরা বাজার করতে আসতো।

একদিন ক্লাসে আমি জানতে চাইলাম। তোমাদের মধ্যে কে কে শিক্ষক হতে চাও। তার আগে আমি শিক্ষকদের গুরুত্ব ছাত্রদের কাছে তুলে ধরলাম। বললাম আমরা যা শিক্ষক তারা কেউকে স্যার বলি না। কিন্তু ক্লাসে কোন শিক্ষার্থী শিক্ষক হতে চাইলো না। পরে যখন আমি বললাম, তোমরা কে কে প্রকৌশলী হতে চাও। তখন ক্লাসের সকল শিক্ষার্থী হাত তুললো। আমি তখন জানতে চাইলাম কে তোমরা শিক্ষক হতে চাও না। বেতনতো সময়।

তখন একজন শিক্ষার্থী বলে উঠলো বেতন তো সময় কিন্তু আয়তো সময় না। আমি তাদের বললাম শিক্ষকতা একটি মহানপেশা।

সুতরাং শিক্ষকতা পেশায় শিক্ষার্থীদের আনতে হলে অন্যান্য পেশার থেকে আয়ের সুষ্ঠু ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের দেশে কেউ শিক্ষক হতে চাই না। তবে জাতির জন্য শিক্ষক কত বড় মাপের মানুষ  একটি উদাহরণ দিলে ‍বুঝতে পারবে। আমার ছোট বেলা থেকে ইচ্ছা ছিলো, আমি সাহিত্য নিয়ে পড়াশুনা করবো। আমি আমার জীবনে অনেক বড় মাপে শিক্ষক পেয়েছি। একজন অধ্যাপক পেয়েছিলাম অসাধারণ। তিনি ক্লাস নেওয়ার সময় সমন্ত পৃথীবিকে চোখের সামনে দাঁড় করিয়ে দিতেন।

মনে হতো সেই পৃথীবিতে শিক্ষক পাগলের মতো ছুটতে থাকতো। আমরাও তার সঙ্গে ছুটতে থাকতাম। হাঠাৎ দেখতাম ঘন্টা বেজে উঠতো। আমাদের মনে হতো ক্লাসের টাইম শেষ না হতেই ঘন্টা পড়ে গেছে। এই অধ্যাপকের ক্লাসের কারণ আমার মাথা থেকে সাহিত্যের ভূত পালিয়ে গিয়েছিলো ।

মনে চিন্তা বাসা বাধেছিলো, যদি পড়াশুনা করতে হবে। তাহলে অর্থনীতিতেই পড়বো। তবে ৬ মাস পার না হতেই সেই শিক্ষক কলকাতায় চলে গেলো। আমাদের এখানে নতুন শিক্ষক আসলো। সেই শিক্ষক এতোটায় খারাপ ছিলো।

যে আমি আবার সিদ্ধান্ত নিলাম যদি বিষয় পড়তে না হয়। সেটা হলো অর্থনীতি। তাহলে দেখেন একজন শিক্ষক কি মূল্যবান দেখেন। সেই শিক্ষক যদি থাকতো তাহলে আজ আমি অর্থনীতিবিদ হতাম। একজন শিক্ষক যদি বড় হোক সমন্ত জাতি যুগ যুগান্তর বড় হয়ে যায়। এহলো শিক্ষকতার মহত। একবার শিক্ষক হলে আজীবন শিক্ষক থাকা যায়। একবার ছাত্র হলে চিরদিনের জন্য ছাত্র হয়ে থাকে। শিক্ষকতা কোন পেশা না। এটা হলো মহতপেশা। একটি  ছোট গল্প বলে আর পরিস্কার হবে এটা যে মহনপেশা। এরশাদের আমলে সাময়িক শাসন জারি হয়েছে। তার সাথে আবার ট্রাফিক সপ্তাহ শুরু চলছিলো। সেই সময় ধানমন্ডি থেকে আমি গাড়ি নিয়ে আসবো বাংলামোটর।

তবে আমার গাড়ী ইসুরেন্সের মেয়াদ শেষ হয়েছে এক সপ্তাহ আগে। তো গাড়ী ধরলে তো অপমানের শেষ নাই। মনে মনে চিন্তা হচ্ছিল যদি ধরে ফেলে। চিন্তা পড়ে গেলাম। ভাবলাম সংসদ ভবনের সামনে দিয়ে ফ্রামগেটের ভিতর দিয়ে ডুকবো। তবে ফার্মগেটের দিকে গিয়ে চোখে পড়ো পুলিশ। শুধু তাই না সার্জেন্টও দাড়িঁয়ে আছে।

আমার গাড়ীটি ফার্মগেট পৌচ্ছানো মাত্রাই ট্রাফিকের লাল আলোটি জ্বলে উঠলো। মনে মনে ভাবছি আমি শেষ। আন্তে আস্তে সার্জেন্ট আমার দিকে আসতে থাকে। আমি তার দিকে না তাকিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে আছি। গাড়ী থেকে মুখ বাহির করে প্রাকৃতিক দৃষ্টি দেখছি। আর  বুকের মধ্যে কাপাঁ শুরু হয়েছে। মনে হচ্ছে সার্জেন্ট আমাকে ধরে ফেলবে। যখন সার্জেন্ট আমার কাছে আসলে মূহুতের মধ্যে এক বিপ্লব ঘটে গেলো।

যখনই আমার চোখে তার চোখ পড়লো। তখন সে উচ্চ স্বরে বলে উঠলো আসসামুয়ালাইকুম স্যার। বলেই একদম জড়ষড় হয়ে পড়লো। তার সব ডাট, পাট, ভাব একবারে কাদামাটিতে পড়ে গেলো। কারণ সে যেদিন তার গ্রাম থেকে আসছিলো আমরা তার কাছে অনেক বড় নায়ক ছিলাম। আর আমরা ছাত্র দেখলে চিনতে পারি তার কথা বলা দাঁড়ানো দেখলেই চিনতে পারি। তো শিক্ষক ছাত্রের ব্যাপারটা এমনই। শিক্ষকের বেতন কম হলেও তাদের সর্ম্পকে জায়গাটা অনেক প্রসার।

 আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ (জন্মঃ ২৫ জুলাই, ১৯৩৯) বাংলাদেশের বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী প্রাতস্মরণীয় সমাজ সংস্কারক। তিনি মূলত শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক ছিলেন। তিনি ষাট দশকের একজন প্রতিশ্রুতিময় কবি হিসেবে পরিচিত। সে সময় সমালোচক এবং সাহিত্য-সম্পাদক হিসাবেও তিনি অনবদ্য অবদান রেখেছিলেন। কিন্তু ধীরে ধীরে তাঁর সাহিত্য প্রতিভার স্ফূরণ স্তিমিত হয়ে আসে। তবে আত্মজীবনীসহ নানাবিধ লেখালেখির মধ্য দিয়ে আজো তিনি স্বীয় লেখক পরিচিতি বহাল রেখেছেন। তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র যা চল্লিশ বছর ধরে বাংলাদেশে ‘আলোকিত মানুষ তৈরির কাজে নিয়োজিত রয়েছে। ২০০৪ এ তিনি রোমেন ম্যাগসেসে পুরস্কার লাভ করেন। বাংলাদেশে অপ্রাতিষ্ঠিনিক শিক্ষা বিস্তারে অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে ২০০৫ সালে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত করে। প্রবন্ধে অবদানের জন্য তিনি ২০১২ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। তাঁকে ‘মানুষ গড়ার কারিগর’বলে অভিহিত করা হয়।

 

 টিআর/