ঢাকা, শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ১২ ১৪৩১

বন্দরের সক্ষমতা বাড়াতে প্রয়োজন বন্দরমন্ত্রণালয়

মোহাম্মদ ইউসুফ

প্রকাশিত : ০৯:৪০ পিএম, ১৫ জানুয়ারি ২০১৯ মঙ্গলবার

সড়ক ও সেতু এবং রেলের জন্যে যদি পৃথক মন্ত্রণালয় থাকতে পারে তাহলে জাতীয় অর্থনীতিতে সিংহভাগ অর্থযোগানদাতা দেশের বৃহত্তম চট্টগ্রাম বন্দরের জন্যে কেন থাকবে না আলাদা মন্ত্রণালয়- এমন প্রশ্ন চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারকারী অনেকেরই। বন্দরমন্ত্রণালয়ের সচিবালয় থাকবে বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামে। অন্যান্য বন্দরগুলোও এখান থেকে পরিচালিত হবে। দেশের ৯২ ভাগ আমদানি-রপ্তানি হয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। প্রাকৃতিকভাবে এ বন্দরের অবস্থান চট্টগ্রাম হলেও সারা দেশের মানুষ এর সুফল ভোগ করছে। চট্টগ্রাম বন্দরের উন্নয়ন হলে দেশের উন্নয়ন হবে। চট্টগ্রাম বন্দর জাতীয় অর্থনীতির প্রাণস্পন্দন। সরকার আসে সরকার যায় কিন্তু শতবছর পরও এ বন্দরের কাঙ্খিত উন্নয়ন হয় না। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটলেও সেই তুলনায় বাড়ছে না বন্দরের কাঙ্খিত সক্ষমতা। বিগত সময়ে যারা বন্দরের দায়িত্বে ছিলেন, তারা এর দায় এড়াতে পারেন না।

ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বর্ণধার চট্টগ্রাম বন্দর অবহেলা আর বঞ্চনার শিকার।সিদ্ধান্তগ্রহণের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সুস্পষ্ট রাজনৈতিক অমনোয়যাগ ছিল। বিগত সময়ে দেশের বেশির ভাগ বিনিয়োগ সড়ক, বিদ্যুৎ, রেল, ব্রিজসহ কয়েকটি খাতে করা হলেও সেই তুলনায় বন্দরের উন্নয়নে বিনিয়োগ করা হয়নি। তুলনামূলকভাবে বন্দরের সরকারের নজর কম ছিল। বন্দর সমস্যা সমস্যা সমাধানে বন্দর কর্তৃপক্ষ কিছু কিছু উদ্যোগ নিলেও তা যথেষ্ট নয়। ছিলেন। বর্হিনোঙ্গরে কনটেনারবাহী জাহাজের অলস পড়ে থাকা, পণ্যখালাসে মাত্রাতিরিক্ত সময়ক্ষেপণ, কনটেনারজট, পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতির অভাবসহ নানান সঙ্কটের কারণে চট্টগ্রাম বন্দর মাথা তোলে দাঁড়াতে পারছে না।

বন্দর ব্যবহারকারীদের সাথে কথা বলে বন্দরসংক্রান্ত যেসব তথ্য-উপাত্ত মেলেছে- তা মোটেই সুখকর নয়।অতীতে বন্দর নিয়ে ষড়যন্ত্রও কম হয়নি। বন্দর থেকে সকলেই ফায়দা লুটেছে কিন্তু বন্দরউন্নয়নে আন্তরিকভাবে কেউ কাজ করেনি। ১৩০ বছর পরও বন্দরে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও জেটি নেই। গ্যান্ট্রি ক্রেন প্রয়োজন ২৬টি আছে ৬টি ; ৬০টি জেটির জায়গায় ৭টি দিয়ে চলছে বন্দরের মাল ওঠানামাসহ সকল কার্যক্রম। পণ্য আমদানি-রপ্তানিসহ বন্দর ব্যবস্থাপনা অটোমেশনের পরিপূর্ণভাবে অটোমেশনের আওতায় আসেনি। যে দেশের সরকার নিজটাকায় পদ্মাসেতুর মতো ম্যাগাপ্রজেক্ট বাস্তবায়নের সক্ষমতা রাখে সেই দেশের নৌমন্ত্রক বন্দরের জন্যে প্রয়োজনীয়সংখ্যক গ্যানট্রি ক্রেনসহ যন্ত্রপাতি কিনতে পারে না-তা কী কখনো বিশ্বাসযোগ্য!

বন্দরের জমিজমা পৈতৃকসম্পদের মতো ভোগ করছে সংশিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা। বন্দরের জমিতে টিনশেড ঘর তৈরি করে ভাড়া দিয়ে অবাধে আর্থিক সুবিধা ভোগ করলেও তা দমনের কেউ নেই। কর্ণফুলীর দু’পাড়ের যেসব স্থানে বালু উত্তোলন হয় সেখান থেকেও অবৈধ আয়-উপার্জন অব্যাহত আছে। এছাড়া এখানের অধিকাংশ লোকাল ঘাট অবৈধ ইজারার মাধ্যমে আদায়কৃত কোটি কোটি টাকা লোপাট করা হচ্ছে, বন্দর বঞ্চিত হচ্ছে মোটাঅঙ্কের রাজস্ব থেকে। বছরের পর বছর এ অবস্থা চলছে।

বন্দর কর্তৃপক্ষের ওপর বন্দর ব্যবহারকারীরা মোটেই সন্তুষ্ট নন। বন্দরপ্রশাসন কর্তৃত্ববাদী ও আমলাতান্ত্রিক। বন্দরপ্রশাসন আর নৌমন্ত্রক মিলে চট্টগ্রাম বন্দরের সার্বিক উন্নয়নে যে কর্মদক্ষতা দেখিয়েছে- তাতে বন্দরের উন্নয়নের চেয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের ভাগ্যেন্নয়ন হয়েছে বেশি। এখানে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা তেমনএকটা নেই। বন্দর পরিচলনার ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতের কোনো প্রতিনিধি নেই। নিয়মিত বন্দর ব্যবহারকারী বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিদের সাথে বসে বিরাজমান বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের সুযোগ থাকলেও বন্দর কর্তৃপক্ষ তা কাজে লাগানোর প্রয়োজনবোধ করে না। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিদের সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা থাকলে চট্টগ্রাম বন্দরের বিদ্যমান সমস্যা সমাধান করা কঠিন কোনো বিষয় নয়। অথচ সাবেক নৌপরিবহন মন্ত্রী চট্টগ্রাম বন্দরকে এড়িয়ে দেশের অন্যত্র কম সুবিধাজনক এলাকায় বন্দর গড়ে তোলার প্রয়াসে তৎপর ছিলেন।

চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বাড়াতে বন্দর ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে যেসব সুপারিশ পাওয়া গেছে তা হলো-

  • প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল পোর্ট কাউন্সিল গঠন করা দরকার।
  • পুরোনো তিনটি জেটি ভেঙ্গে একটি টার্মিনালনির্মাণ ও কনটেনার পরিবহনের জন্যে রেলের সক্ষমতা বাড়ানো জরুরি।
  • বর্হিনোঙ্গরে বড়জাহাজ থেকে পণ্য খালাসের জন্যে লাইটার জাহাজের সংখ্যা বাড়ানো ও পণ্য খালাসের যন্ত্রপাতি ও ঘাটের আধুনিকায়ন করা। যারা বেশি পণ্য আমদানি করেন পণ্যখালাসের জেটি বা ঘাটনির্মাণের জন্যে তাদের অনুমোদন দেয়া যেতে পারে।
  • বন্দরের দক্ষিণ আবাসিক এলাকা ভেঙ্গে নতুন কনটেনার ইয়ার্ড নির্মাণ করা।
  • বন্দর চত্বর থেকে কনটেনার পণ্য দ্রুত খালাসের জন্যে কাস্টমস হাউসে স্ক্যানারের সংখ্যা বাড়ানো।
  • বন্দরের উন্নয়নের জন্যে ডেল্টা প্ল্যান গ্রহণ করা এবং তা বাস্তবায়নের কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া।
  • আমদানিকৃত কনটেনারবিহীন খোলাপণ্যের ৭০% বর্হিনোঙ্গরে খালাস করতে হয়। লাইটার জাহাজের মাধ্যমে এসব পণ্য নামানোর আধুনিক ব্যবস্থার প্রবর্তন করা।
  • বন্দরপ্রশাসনকে ঢেলে সাজাতে হবে।বন্দর পরিচালনায় বন্দর ব্যবহারকারীদের প্রতিনিধি রাখতে হবে। ২০২১ সালের মধ্যে ৫০ মিষলয়ন ডলার রপ্তানির লক্ষমাত্রা পূরণ করতে হলে এর কোনো বিকল্প নেই।
  • এলসিএল কনটেনার (এক কনটেনারে একাধিক আমদানিকারকের পণ্য)ব্যবস্থাপনা বন্দরের জন্যে বড় সমস্যা। এধরনের কনটেনার জাহাজ থেকে নামানোর পর কনটেনার খোলে বন্দরের শেডে রাখা হয়। এসব পণ্য নেওয়ার জন্যে প্রদিদিন বন্দর সহস্রাধিক ট্রাক আসা-যাওয়া করে। বন্দরের মূল চত্বর থেকে এসব কনটেনার সরিয়ে বাইরের আশপাশে চত্বর তৈরি করে রাখা যেতো তাহলে বন্দরে গাড়িজট হতো না।
  • রপ্তানিমুখি পোশাকশিল্পের প্রায় ৯৫শতাংশ সরঞ্জাম চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে রপ্তানি হয়। সময়মতো আমদানিকৃত কাঁচামাল হাতে না পেয়ে সরঞ্জাম প্রস্তুত করা যায় না। ফলে যথাসময়ে পণ্য সরবরাহ করতে না পারায় রপ্তানি আদেশ হাতছাড়া হওয়ার ঘটনাও ঘটছে।
  • চট্টগ্রাম বন্দরে যন্ত্রপাতির সঙ্কট ও বন্দর চত্বরে জটসহ নানান সমস্যার কারণে অনেকসময় ৫০/৬০ ঘণ্টারও বেশি সময়ধরে আমদানি পণ্যবাহী কনটেনার নামাতে হয়। ফলে অনেকসময় জাহাজে রপ্তানি কনটেনার বোঝাই করা যাচ্ছে না। রপ্তানিপণ্য না নিয়েই অনেকসময় জাহাজকে বন্দর ছেড়ে যেতে হয়। এ সমস্যা সমস্যা সমাধানের জন্যে বন্দরে আলাদা চত্বর তেরি করা প্রয়োজন। এতে আমদানিকারকদের বাড়তি খরচ গুণতে হয়- যা খেসারত দিতে হয় ভোক্তাসাধারণকে।
  • রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকে বের হয়ে পেশাদার দৃষ্টিভঙ্গিতে বন্দর পরিচালনা করা গেলে বন্দরের প্রত্যাশিত উন্নয়ন অসম্ভব কিছু নয়।
  • দ্রুত সময়ের মধ্যে বন্দরে কনটেনার পরিবহনের জন্যে আধুনিক যন্ত্রপাতি যেমন দরকার ঠিক তেমনি সামগ্রিকভাবে বন্দরের আধুনিকায়নের। যথাযথ অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলে উন্নত সমৃদ্ধ দেশবিনির্মাণে চট্টগ্রাম বন্দরই যথেষ্ট।

বর্তমান শেখ হাসিনার সরকার দুর্নীতির ব্যাপারে জিরোটলারেন্স নীতি অবলম্বন করেছে। ফলে নতুন নৌ-পরিবহনমন্ত্রী চট্টগ্রাম বন্দরের বিরাজমান সমস্যা সমাধানে অগ্রাধিকারভিত্তিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন- এটাই স্বাভাবিক। বিশেষ করে দুর্নীতির ব্যাপারে কার্যকর ভূমিকা রাখার পাশাপাশি চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বাড়াতে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবেন।

বন্দর সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ১৮৯২ সালে আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানি গঠিত হয়। পরে চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে চা ও পাট রপ্তানি দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পায়। ১৯০৪ সালে ৩৯.২৩ মিলিয়ন রূপীর বাণিজ্য সম্পন্ন হয় যা ১৯২৮ সালে ১৮৩.২৫ মিলিয়ন রূপীতে উন্নীত হয়। জানা যায়, ১৯২৮ সালের ১ এপ্রিল ব্রিটিশ-ভারতীয় সরকার চট্টগ্রাম বন্দরকে মেজর পোর্ট হিসেবে ঘোষণা করে এবং এর পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ প্রাদেশিক সরকারের স্থলে গভর্নর জেনারেল ইন কাউন্সিলের হাতে ন্যস্ত করা হয়। ১৮৯৯ হতে ১৯১০ সালের মধ্যে সর্বপ্রথম ৪টি জেটি নির্মিত হয় বন্দরে। সেসব জটি নির্মাণের পূর্বে মাঝনদীতে জাহাজ মুরিং-এ নোঙ্গর করে মালামাল উঠানামার কাজ সম্পন্ন করা হতো। ২৭ মার্চ ১৯০৩ সালে চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিসমূহের মালিকানা ও পরিচালনার দায়িত্ব আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানির উপর ন্যস্ত হয়। ফলে, বন্দর কার্যক্রম পোর্ট কমিশনার্স ও পোর্ট রেলওয়ের যৌথ ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হতে থাকে। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর চট্টগ্রাম বন্দর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র বন্দর হিসেবে কার্যক্রম শুরু করে এবং পঞ্চাশের দশকে সাতটি নতুন জেটি, প্লান্টুন বার্থ ও মুরিং নির্মাণ করা হয়। বন্দর পরিচালনায় পোর্ট কমিশনার্স ও পোর্ট রেলওয়ের দ্বৈত প্রশাসনের জটিলতা পরিহারের জন্য ১৯৬০ সালের জুলাই মাসে দুইটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান যা চট্টগ্রাম পোর্ট ট্রাস্ট ও পূর্ব পাকিস্তান রেলওয়ে। তৃতীয় বিশ্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ১৯৭৬ সালে সরকার এক অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে পোর্ট ট্রাস্ট বিলুপ্ত করে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ গঠন করে। বন্দর প্রশাসনের কার্যক্রম যুগোপযোগী করার জন্য ১৯৯৫ সালে ‘পোর্ট অর্ডিন্যান্স ১৯৭৬ সালে কিছুটা সংশোধনী আনা হয়।

ন্দর কর্তৃপক্ষ জানান, এর ফলে চট্টগ্রাম বন্দরের ক্যাপাসিটি বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে। চট্টগ্রাম বন্দরের স্টেডিয়াম সংলগ্ন শেড এলাকায় কন্টেইনার হ্যান্ডলিং সুবিধাদি নির্মাণের লক্ষ্যে উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে। এছাড়া, একটি বহুতল বিশিষ্ট ভেহিক্যাল পার্কিং শেড নির্মাণের বিষয়টিও প্রক্রিয়াধীন আছে। চট্টগ্রাম বন্দর হতে রেলপথে কন্টেইনার পরিবহন করা হয় শুধুমাত্র ঢাকাস্থ কমলাপুর আইসিডিতে, যার বার্ষিক হ্যান্ডলিং ক্ষমতা ৯০,০০০ টিইইউএস। উক্ত আইসিডি’র বর্তমান হ্যান্ডলিং ক্ষমতা প্রায় সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায় গাজীপুর জেলার ধীরাশ্রম রেলস্টেশনের সন্নিকটে ৫০,০০০ টিইইউএস ট্রানজিট সহ ৩,৫০,০০০ টিইইউএস হ্যান্ডলিং ক্ষমতাসম্পন্ন আরো একটি রেলভিত্তিক আইসিডি নির্মাণের জন্য বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা সম্পন্ন করা হয়েছে। সম্ভাব্যতা সমীক্ষার ভিত্তিতে বর্তমানে বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃক বিনিয়োগ প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হলে তা এ খাতে যুগান্তকারী পরিবর্তন হিসেবে বিবেচিত হবে।

লেখক- প্রধান-সম্পাদক, সাপ্তাহিক চাটগাঁর বাণী