ঢাকা, শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ৬ ১৪৩১

র‌্যাব পরিচয়ে লাশ নিয়ে প্রতারণা  

আউয়াল চৌধুরী ও আলী আদনান   

প্রকাশিত : ১১:৪১ পিএম, ২৬ জানুয়ারি ২০১৯ শনিবার | আপডেট: ০৩:২২ পিএম, ২৭ জানুয়ারি ২০১৯ রবিবার

ফাইল ছবি

ফাইল ছবি

মানুষ নানাভাবেই প্রতারণা করছে। আর এই প্রতারণার জালে সরল মনেই কিছু মানুষ প্রতারিত হচ্ছে। আমাদের সমাজের চারপাশে এখন প্রতারণার জাল। নতুন নতুন কৌশলে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার নানা উপায় বের করছে কেউ কেউ। এমনই একটি চক্র যারা মায়ের লাশের কথা বলে র‌্যাব অফিসারের পরিচয় দিয়ে মানুষের কাছ থেকে বিকাশের মাধ্যমে টাকা আদায়ের অভিনব পদ্ধতি বেছে নিয়েছে।    

শনিবার, বিকাল ৩টা। একুশে টেলিভিশনের একজন সিনিয়র সাংবাদিক এর কাছে ০১৯১১ ৭৬৫১৯২ নাম্বার থেকে একটি ফোন আসে। ফোনে মাসুদ রানা নামে একজন নিজেকে র‌্যাব কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে তার সঙ্গে কথা বলেন। তিনি নাম্বারটি চট্টগ্রামের একজন সিনিয়র সাংবাদিকের নাম বলে তার কাছ থেকে পেয়েছেন বলে জানান।

মাসুদ রানা এ সময় ফোনে বলেন, ঢাকা মেডিকেলে আমার গ্রামের এক গরীব মহিলা মারা গেছেন। টাকার অভাবে তার প্রতিবন্ধী ছেলে মো. আল আমীন গ্রামে লাশ নিতে পারছে না। তাদের গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালিতে। প্রতিবন্ধী ছেলেটির বাবা রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় মারা যান। ফলে সে ক্যান্সারে আক্রান্ত মাকে নিয়ে প্রায় তিন মাস ঢাকা মেডিকেলে পড়ে আছে। এখন তার মা নেই। টাকা পয়সাও নেই। যদি তার পাশে একটু দাঁড়াতেন। অ্যাম্বুলেন্স খরচ আর কফিনের খরচটা পেলে তারা বাড়ি যেতে পারবে। সাড়ে ৭ হাজার টাকা পেলে তারা বাড়ি গিয়ে লাশ কবরস্থ করতে পারবে।      

একুশে টেলিভিশনের সিনিয়র সাংবাদিক তার বর্তমান অবস্থান এবং কর্মস্থলের বিবরণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, বর্তমানে তিনি সিলেটের হালিশহরে র‌্যাবের এস আই পদে কর্মরত আছেন। তিনিও এই অসহায় পরিবারকে কিছুটা সহযোগিতা করেছেন। আর চট্টগ্রামের সাংবাদিক তার খুব পরিচিত।

পরে মাসুদ মৃত মহিলার প্রতিবন্ধী ছেলে আল আমীনের ফোন নাম্বারটি (০১৮২৬৬৬৫৮৬০) তাকে ম্যাসেজ করেন। পাশাপাশি একটি বিকাশ নাম্বারও (০১৭৯৪৫৫২৪০৬) দেন।

একজন মায়ের লাশ টাকার অভাবে গ্রামে নিতে পারছেনা বিষয়টিকে এমন মানবিক দৃষ্টিতে দেখে টাকা পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। পরবর্তীতে ওই নাম্বারে আল আমীনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে ফোনটি রিসিভ করে খোরশেদ নামে বিদায় অ্যাম্বুলেন্স এর পরিচয়দানকারী চালক। একুশে টেলিভিশনের একজন প্রতিবেদক টাকা নিয়ে মেডিকেলে যাওয়ার কথা বললে ওই সময় খোরশেদ বলেন, ভাই আমরাতো বেশিক্ষণ থাকতে পারবো না। লাশ কফিন করে বসে আছি। এখন টাকাটা যদি বিকাশে পাঠান তাহলে খুব উপকার হয়। তাড়াতাড়ি গ্রামে যেতে পারবো।

কিছুক্ষণ পর একুশে টিভি অনলাইন এর প্রতিবেদক আবার ফোন দিলে তখন আল আমীন ফোনটি রিসিভ করে এবং কেঁদে কেঁদে বলে, টাকার জন্য মাকে গ্রামে নিতে পারছে না। তারা এখন কোথায় আছেন জানতে চাইলে- আল আমীন বলেন, আমরা এখন বাবু বাজার ব্রিজ সংলগ্ন পেট্টল পাম্পে।

এদিকে তাদের কথায় কিছুটা অসংলগ্নতা মনে হওয়ায় র‌্যাব পরিচয় দানকারী মাসুদের কাছে আবার ফোন দেওয়া হয়। তার কাছে জানতে চাওয়া হয় তিনি এখন কোথায় আছেন। তখন তিনি বলেন, চট্টগ্রাম হালিশহরে ডিউটিতে আছেন (ওয়াকিটকির শব্দ শোনান)।

এরপর চট্টগ্রামের সেই পরিচিত সেই সিনিয়র সাংবাদিককে ফোন করা হলে তিনি জানান, এ নামে কাউকে তিনি চেনেন না।

এরপর কথিত র‌্যাব কর্মকর্তা মাসুদ রানার সঙ্গে বার বার কথা বললে তার কথায় বিভিন্ন অসংলগ্নতা উঠে আসে। র‌্যাবের কোন ইউনিটে দায়িত্বে আছেন জানতে চাইলে তিনি একেক সময় একেক ধরনের তথ্য দিচ্ছিলেন। তিনি সিলেট হালিশহরের কথা বলেছেন বারবার কিন্তু অনুসন্ধানে দেখা যায় সিলেটে এ নামে কোনো শহরই নেই। এ বিষয়ে তিনি আর কথা না বলে লাইনটি কেটে দেন।

অন্যদিকে কথিত লাশের পুত্র আল আমীন ও বিদায় অ্যাম্বুলেন্সের ড্রাইভার পরিচয় দেওয়া খোরশেদ আলম বারবার টাকার জন্য ফোন করলে তাদেরকে বলা হয় আপনারা কোথায় আছেন জানান। আমরা টাকা নিয়ে আসছি। একপর্যায়ে তাদের দু`জনের কথায় বৈপরীত্য লক্ষ করা যায়। আল আমীন বলেন, লাশ মেডিকেলে আছে। অন্যদিকে খোরশেদ আলম জানান, তিনি লাশ নিয়ে বাবু বাজার সংলগ্ন একটি পেট্রোল পাম্পে আছেন। তারা লাশ নিয়ে পটুয়াখালীর দিকে রওয়ানা হয়েছেন। টাকাটা বিকাশে পাঠাতে বললেন।

তারা যে একটি সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্র ইতিমধ্যে সেটি পরিস্কার হয়ে যায়। তাই একুশে টেলিভিশনের প্রতিবেদক তাদেরকে বাবু বাজার ব্রিজ এর ওখানে থাকতে বলে এবং তিনি টাকা নিয়ে আসছেন বলে জানায়। এর কিছুক্ষণ পর আবার ফোন দিলে কথিত লাশের পুত্র আল আমীন ও বিদায় অ্যাম্বুলেন্সের চালক পরিচয়দানকারী খোরশেদ আলম তাদের ফোন বন্ধ করে দেন। বারবার ফোন দেওয়ার পরও তাদের ফোন আর খোলা পাওয়া যায়নি।

ঘটনাটি বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এভাবে ঘটতে থাকে। সন্ধ্যার পর একুশে টেলিভিশনের সিনিয়র সাংবাদিকের কাছে কথিত র‌্যাব পরিচয়দানকারী কর্মকর্তা মাসুদ রানা ফোন করে বলেন, ভাই টাকা আর লাগবে না। তিনি টাকা কেন লাগবে না জানতে চাইলে, সঙ্গে সঙ্গে লাইনটি কেটে ফোন বন্ধ করে দেন। পরবর্তীতে তার ফোন আর খোলা পাওয়া যায়নি।

এ বিষয়ে র‌্যাব গণমাধ্যম শাখার সহকারী পরিচালক মো. মিজানুর রহমান সঙ্গে কথা হয়। বিষয়টি তাকে জানালে তিনি বলেন, এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। একটি সংঘবদ্ধ চক্র এমন প্রতারণার সঙ্গে জড়িত। আমরা বিষয়টি অনুসন্ধান করে দেখছি। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আআ/এসি