ঢাকা, শুক্রবার   ০৩ মে ২০২৪,   বৈশাখ ২০ ১৪৩১

চট্টগ্রামে তিন তারকা নেতার তিন উত্তরাধিকারী

আলী আদনান

প্রকাশিত : ০৩:৩৪ পিএম, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ মঙ্গলবার | আপডেট: ০৪:০৩ পিএম, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ মঙ্গলবার

মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে চট্টগ্রামের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করতে চট্টগ্রামে যারা ভূমিকা রেখেছিলেন তারা হলেন আতাউর রহমান খান কায়ছার, আক্তারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ও মহিউদ্দিন চৌধুরী। সময়ের ব্যবধানে তিনজনই প্রয়াত হয়েছেন। চট্টগ্রামের রাজনীতিতে এ তিনজন ছিলেন তারকা নেতা। আজ তারা নেই। তাদের স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন তাদের সন্তানেরা। এমন রাজনৈতিক স্থলাভিষিক্ততায় একদিকে যেমন অনেকে খুশী তেমনি প্রত্যাশাও বেড়েছে সাধারণ মানুষের। পিতাদের শ্রম, মেধা ও কর্মের মতো তাদের সন্তানরাও ভূমিকা রাখবে সেটাই এখন অনেকের প্রত্যাশা।

বর্তমান সরকারের ভূমিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ। চট্টগ্রামের আনোয়ারা আসন থেকে নির্বাচিত এ সংসদ সদস্য আওয়ামীলীগের প্রয়াত প্রেসিডিয়াম সদস্য আক্তারুজ্জামান চৌধুরী বাবু’র সন্তান। আক্তারুজ্জামান চৌধুরী বাবু নবম সংসদের নির্বাচিত সদস্য থাকা অবস্থায় ২০১২ সালের ৪ নভেম্বর মারা যান। মৃত্যুকালে তিনি পাট ও বস্ত্র মন্ত্রনালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ছিলেন। জীবদ্দশায় তিনি মোট চার বার ( ১৯৭০, ১৯৮৬, ১৯৯৬, ২০০৮) সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। প্রায় কিংবদন্তীতুল্য এ রাজনীতিবিদ ১৯৭৭ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

বাবারা দাপুটে রাজনীতিবিদ হলেও সন্তানরা অনেক সময় সেই ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়। তবে সেই ব্যর্থতার পথে হাঁটেননি আক্তারুজ্জামান চৌধুরী বাবু’র পুত্র সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ। বাবার মৃত্যুর পর পরই সেই আসনে (চট্টগ্রাম- ১২) উপনির্বাচন হলে তাতে তিনি আওয়ামীলীগের প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। দশম সংসদে নির্বাচিত হয়ে তিনি সরকারের ভূমি প্রতিমন্ত্রী ও একাদশ সংসদে তিনি একই মন্ত্রনালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

আক্তারুজ্জামান চৌধুরী বাবু’র রাজনৈতিক বন্ধু মহিউদ্দিন চৌধুরী। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে পরপর তিনবার নির্বাচিত মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী কখনও সরকারের এমপি- মন্ত্রী ছিলেন না। দল বারবার চাইলেও তিনি কখনও কেন্দ্রীয় নেতা হননি। তবু দেশের আনাচে কানাচে তিনি এক নামে পরিচিত ছিলেন। রাজনৈতিক পরিচয়ে নয়, বরং গণমানুষের অধিকারের রাজনীতিতেও চট্টগ্রাম বাসীর একমাত্র মুখপাত্র ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক এ রাজনীতিবিদ মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময় থেকে দীর্ঘদিন চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক ও পরবর্তীতে সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আমৃত্য তিনি নগর আওয়ামীলীগের সভাপতি ছিলেন। ১৯৯৩ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত (মোট তিন বার) চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন- এর মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মহিউদ্দিন চৌধুরী’র মৃত্যুর পর কে হবেন তার স্থলাভিষিক্ত তা নিয়ে জল্পনা কল্পনার কমতি ছিল না। আদৌ তার শূন্যস্থান কেউ পূরণ করতে পারবে কি না তা নিয়ে তার রাজনৈতিক সহযোগীদের মধ্যেও ছিল হতাশা।

তবে বাস্তব চিত্র বলছে সেই হতাশা ইতোমধ্যেই কেটে গেছে। বাবার শূন্য পথে বেশ ভালোভাবেই হাঁটছেন ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। ছাত্র রাজনীতির কোনও অভিজ্ঞতা না থাকলেও  মহিউদ্দিন চৌধুরীর জীবিতাবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর নজরে আসেন নওফেল। ২০১৬ সালে আওয়ামীলীগের সর্বশেষ সম্মেলনে ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলকে কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে মনোনীত করেন দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা। এমন একটি নতুন মুখকে এমন শীর্ষ পদে দেখে অনেকে যেমন বিস্মিত হয়েছিলেন তেমনি আলোচনা - সমালোচনাও কম হয়নি। কিন্তু ফলে যেমন বৃক্ষের পরিচয় পাওয়া যায় তেমনি রাজনৈতিক নেতার পরিচয় পাওয়া যায় তার কর্মে। রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম নেওয়ার কারণেই হোক বা প্রধানমন্ত্রীর আনুকূল্যের কারণেই হোক, ব্যারিস্টার নওফেল রাজনৈতিক যোগ্যতার প্রমাণ রাখতে পারছেন তা কিন্তু বুঝাই যাচ্ছে। দলের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পাওয়ার মাত্র দু’বছরের মাথায় চট্টগ্রামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আসন কোতোয়ালী (চট্টগ্রাম- ৯) থেকে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। চলতি বছরের ৬ জানুয়ারি তিনি নতুন সরকারের শিক্ষা উপমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন।

মহিউদ্দিন চৌধুরী ও আক্তারুজ্জামান চৌধুরী বাবু’র ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহযোদ্ধা (বয়সে খানিকটা বড়) আতাউর রহমান খান কায়সার। পূর্ব পাকিস্থান জাতীয় পরিষদের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসা আতাউর রহমান খান কায়সার আমৃত্যু বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের প্রেসেডিয়াম সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭০ সালে তিনি চট্টগ্রামের (আনোয়ারা- বাঁশখালী) থেকে এমএনএ নির্বাচিত হন। চট্টগ্রামের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও আতাউর রহমান খান কায়সারের জীবন অনেকটা এক সূত্রে গাঁথা। ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত তিনি চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে হলে পাল্টে যায় দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। তখন মোশতাক- জিয়া সরকার বিভিন্ন রাজনৈতিক মামলায় আতাউর রহমান খান কায়সারকে দীর্ঘদিন কারাগারে বন্দী রাখে। ১৯৮৭ সালে তিনি কেন্দ্রীয় আওয়ামীলীগের অর্থ সম্পাদকের দায়িত্ব পান। ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামের লালদিঘী ময়দানে এরশাদ সরকারের পুলিশ - বিডিআর শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা চালায়। সেই হামলায় আহত হন তিনি। ১৯৯৬ সালে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় এলে তাকে কোরিয়ায় রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করা হয়। আতাউর রহমান খান কায়সারের স্ত্রী নিলোফার কায়সার চট্টগ্রাম মহানগর মহিলা আওয়ামীলীগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

এ বিজ্ঞ রাজনীতিবিদ ২০১০ সালের ৯ নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। তার স্ত্রী নিলুফা কায়সার ও আজীবন রাজনীতিতে ভূমিকা রেখেছেন।

কায়সার দম্পতির কোনও পুত্র সন্তান ছিল না। সেই জায়গা থেকে আতাউর রহমান খান কায়সার সময়ের ব্যবধানে বিস্মৃত হয়ে যাবেন কি না তা নিয়ে অনেক পুরোনো রাজনীতিবিদদের মধ্যে মনোকষ্ট ছিল।

সেই কষ্টটি হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১৪ সালের ৯ মার্চ কায়সার দম্পতির সন্তান ওয়াসিকা আয়েশা খান সংসদ সদস্য হিসেবে (আসন- ৩৩১, মহিলা আসন-৩১) শপথ নেন। দশম সংসদে তিনি সরকারি হিসাব সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি এবং অনুমিত হিসাব সংক্রান্ত কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পাশাপাশি বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি, ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের ব্যুরো অব উইমেন পার্লামেন্টারিয়ানসের সদস্য এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য হিসেবেও কাজ করেছেন।

একাদশ জাতীয় সংসদেও নারী সংসদ সদস্যদের সংরক্ষিত আসনে ওয়াসিকা আয়েশা খান সংসদ সদস্য হিসেবে মনোনয়ন পেয়েছেন। কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় নির্দিষ্ট সময়ের আগেই নির্বাচন কমিশন মনোনয়ন পাওয়া প্রার্থীদের নির্বাচিত ঘোষণা করার সম্ভাবনা রয়েছে। সেই দিক থেকে ওয়াসিকা আয়েশা খান দ্বিতীয় বারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন। দশম সংসদে যারা আওয়ামীলীগের মনোনয়নে নারী সাংসদ হয়েছিলেন তাদের দু’জন ব্যতীত অন্যকেউ এবার আওয়ামীলীগের মনোনয়ন পাননি।  দু’জনের একজন ওয়াসিকা আয়েশা খান। বলার অপেক্ষা রাখে না, এ থেকে বুঝা যায় দশম সংসদের ইনিংসে ওয়াসিকা আয়েশা খান- এর পারফর্মেন্স বেশ ভালই ছিল।

একুশে টেলিভিশন অনলাইনের পক্ষ থেকে কথা বলেছিলাম ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ- এর সঙ্গে। তিনি বলেন, আমি আক্তারুজ্জামান চৌধুরী বাবু’র সন্তান। ফলে আমার দায়বদ্ধতাটা বেশি। আমার কাজগুলোকে মানুষ আমার বাবার কাজের সঙ্গে তুলনা করছে। ফলে আমি যদি কোথাও হেরে যাই তখন নেতিবাচক প্রতিক্রিয়াটা বেশি হবে। তাই আমাকে সব সময় মাথায় রাখতে হয়, কোথাও হারা যাবে না। প্রধানমন্ত্রীর অর্পিত দায়িত্ব আমি সঠিকভাবে পালন করতে চাই।

একই আত্মবিশ্বাসের সুর দেখা গেল ব্যারিস্টার নওফেলের কণ্ঠেও। একুশে টেলিভিশন অনলাইনকে তিনি বলেন, মানুষ আমার ভেতরে মহিউদ্দিন চৌধুরীকে খোঁজে। এটা আমার জন্য একটা বড় পরীক্ষা। বাবা সারা জীবন মানুষের জন্য কাজ করেছেন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে শত প্রতিকূলতার মাঝেও অবিচল ছিলেন। আমিও প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে আজীবন মানুষের জন্য কাজ করতে চাই।

বাবার কথা স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কিছুটা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন সংসদ সদস্য ওয়াসিকা আয়েশা খান। তিনি বলেন, বাবার যে বিশাল অর্জন তার কিছুই আমরা পাইনি। এরপরও বাবার দেখানো পথে আজীবন হাঁটতে চাই। ওয়াসিকা আয়েশা খান বলেন, প্রধানমন্ত্রী আমাকে দ্বিতীয় বারের মতো সংসদ সদস্য হিসেবে মনোনয়ন দিল। ফলে আমার দায়বদ্ধতা আরো অনেক বেড়ে গেল।

রাজনৈতিক উত্তরাধিকারের জায়গা থেকে উঠে আসা এ তরুন রাজনীতিবিদদের নিয়ে আশাবাদী চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক এমএ সালাম। একুশে টেলিভিশন অনলাইনকে তিনি বলেন, এ তরুণ রাজনীতিবিদরা দুই দিক থেকে শিখেছেন। একদিকে যেমন প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনায় তারা সফল তেমনি ছোটবেলা থেকে রাজনীতি দেখেছেন। মানুষের সঙ্গে কীভাবে মিশতে হয় তা দেখেছেন তা আয়ত্ত করেছেন। ফলে আমার বিশ্বাস তারা চট্টগ্রামবাসীর জন্য ভাল কাজ করতে পারবেন।

মহিউদ্দিন চৌধুরী, আতাউর রহমান খান কায়সার, আক্তারুজ্জামান চৌধুরী বাবু গণমানুষের রাজনীতিতে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। দলীয় সংকীর্ণতার বাইরে গিয়ে তারা হয়ে উঠেছিলেন গণমানুষের নেতা। তাদের সন্তানরা সে তালিকায় নিজেদের নিতে পারবেন কি না তা সময় বলে দিবে।