ঢাকা, শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

ভারতবর্ষের প্রথম নারী শাসক সুলতানা রাজিয়ার বীরত্ব কি জানেন? 

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৫:২৬ পিএম, ৮ মার্চ ২০১৯ শুক্রবার | আপডেট: ০৬:৪২ পিএম, ৮ মার্চ ২০১৯ শুক্রবার

শিল্পীর চোখে সুলতানা রাজিয়া (সংগৃহীত)

শিল্পীর চোখে সুলতানা রাজিয়া (সংগৃহীত)

ইতিহাসে আলোড়ন সৃষ্টিকারী একটি নাম সুলতানা রাজিয়া। তিনি ছিলেন ভারতবর্ষের প্রথম নারী শাসক। যুদ্ধক্ষেত্রে একজন দক্ষ সৈনিক হিসেবে তার ছিল সুখ্যাতি। সুলতানা রাজিয়া জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১২০৫ সালে। দৃপ্ত কঠিন ক্ষণজন্মা এই নারীর জীবন প্রদীপ নিভে গিয়েছিল ১২৪০ সালে। রাজকার্য পরিচালনার জন্য নামের আগে সুলতানা না হয়ে সুলতান হওয়াই হয়তো যুক্তিযুক্ত ছিল। সুলতানা রাজিয়ার বাবা শামস-উদ-দীন ইলতুিমশ ছিলেন দিল্লির সুলতান। ১২১০ সাল থেকে ১২৩৬ সাল পর্যন্ত সুলতানি আমলে ইলতুিমশ নিজেও একজন দক্ষ শাসকের খ্যাতি অর্জন করেন। বিভিন্ন অঞ্চলের বিক্ষোভ, বিদ্রোহ দমন করা ছিল তার কাজ। মৃত্যুর আগে নিজের উত্তরাধিকারী মনোনয়নের বিষয়ে সুলতান ইলতুিমশ চিন্তায় পড়ে যান। কারণ ইতিমধ্যে তার বড় ছেলে নাসিরুদ্দিন মাহমুদ মারা গেছেন। সুলতান নিজ সন্তানদের মধ্যে নাসিরুদ্দিনের ওপর বেশি ভরসা করতেন। বাকি যে দুই ছেলে আছেন তাদের কেউই সিংহাসনে বসার যোগ্য ছিলেন না। এমন অবস্থায় চিন্তায় পড়ে গেলেন সুলতান। এরই মধ্যে তার জ্যেষ্ঠ মেয়ে রাজিয়া বেশ বুদ্ধিমতী, চৌকস, প্রজাপ্রীতি ও যুদ্ধকৌশল শিখে গেছেন। তখন রাজ্য চালানোর দায়িত্ব মেয়ে সুলতানার ওপর দিয়ে নির্ভার হন।

ইলতুৎমিশের মৃত্যুর পর নারীবিদ্বেষী আমির-ওমরাহগণ রাজিয়ার বিরোধিতা শুরু করেন। তাদের যুক্তি হলো, ইলতুৎমিশের পুত্র থাকার কারণে কন্যা উত্তরাধিকারী হতে পারে না। উত্তরাধিকারসূত্রে জেষ্ঠ্য পুত্র সিংহাসনে স্থলাভিষিক্ত হন। কিন্তু সুলতান ইলতুৎমিশ উইলে রাজিয়াকে উত্তরাধিকারী মনোনীত করায় তার ভাইয়েরা কোন আপত্তি করতে পারেননি। কিন্তু নারী শাসনের বিরোধী আমির-ওমরাহগণ প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেন। ফলে রাজিয়া তার অধিকার ছেড়ে দেন। তার সৎভাই রুকুনুদ্দিনকে সুলতান হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। রুকুনুদ্দিন রাজকার্যে অবহেলা করে বিলাসিতায় দিন যাপন করতে থাকেন। রাজনৈতিক পরিস্থিতির অবনতি হলে আমির-ওমরাহগণ রাজিয়াকে সুলতানা হিসেবে মেনে নিতে রাজি হলেন। কিন্তু প্রাসাদ ষড়যন্ত্র করে রুকুনুদ্দিনের মা রাজিয়াকে হত্যা করার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু এই ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়। এই ষড়যন্ত্রের কথা জানার পর সভাসদেরা রাজিয়া সুলতানার প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশ করেন।

১২৩৬ খ্রিষ্টাব্দে রাজিয়া সুলতানা সিংহাসনে বসেন। রাজিয়া একজন বিচক্ষণ ও দক্ষ শাসক ছিলেন। তার সময়ে দাসবংশের শাসনকাল খুব সুদৃঢ় হয় এবং রাজ্যের সর্বত্র শান্তি ও নিরাপত্তা বিরাজ করে। তার সময়ে ব্যবসা-বাণিজ্যে উন্নতি সাধিত হয়। তিনি যাতায়াতের সুবিধার্থে রাস্তা-ঘাট নির্মাণ করেন। রাস্তার দুই পাশে বৃক্ষ লাগানো হয় এবং পানি সরবরাহের জন্য অসংখ্য কুয়ো খনন করা হয়। তিনি সাহিত্যিক, শিল্পী ও কারিগরদের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। তার শাসনামলে সঙ্গীত ও চিত্রকলারও প্রভূত বিকাশ সাধিত হয়। রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি বিদ্যোৎসাহী ছিলেন এবং নারীদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের লক্ষে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তিনি কবি ছিলেন এবং কুরআন পাঠ করতে পারতেন।

রাজিয়া সুলতানা অন্তঃপুরিকা ছিলেন না। তিনি প্রকাশ্য দরবারে রাজকীয় পোশাক পরিধান করে সিংহাসনে আরোহন করতেন। তিনি কোন ঘোমটা ব্যবহার করতেন না। পুরুষের বেশে তিনি আলখাল্লা এবং পাগড়ি পরে জনসম্মুখে আসতেন। তিনি সভাসদ, আমির-ওমরাহদের রাজ্য শাসন প্রসঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করতেন এবং তাদের পরামর্শ গ্রহণ করে আইন বা নির্দেশ জারি করতেন। তিনি দক্ষ অশ্বারোহী ছিলেন এবং বর্ম ও শিরস্ত্রাণ পরে যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করতেন। দুর্ভাগ্যবশত রাজিয়া সুলতানার খোলামেলা রাজকীয় আচার-আচরণ রক্ষণশীল আমিরগণ মোটেই পছন্দ করতেন না। তিনি খুবই উদার ও জনদরদি শাসক ছিলেন। তিনি হিন্দুদের ওপর অর্পিত বর্ধিত কর বিলোপ করেন; কিন্তু তার এই পদক্ষেপ অনেক আমির মোটেও পছন্দ করেননি।

রাজিয়া সুলতানা জামালুদ্দিন ইয়াকুত নামের অতুর্কি বংশোদ্ভুত এক ব্যক্তিকে পছন্দ করতেন এবং তাকে আস্তাবলের প্রধান নিযুক্ত করেন। এই পদটি তুর্কি বংশোদ্ভূত কোন প্রভাবশালী ব্যক্তির জন্য নির্দিষ্ট ছিল। ঐতিহাসিকগণ বলেন যে, জামালুদ্দিনের প্রতি রাজিয়ার এমন দুর্বলতা ছিল যে, তিনি শাসনকার্য পরিচালনায় কেবলই তার পরামর্শ গ্রহণ করতেন। অনেকে তাকে রাজিয়া সুলতানার প্রেমিক বলে অভিহিত করেন। জামালুদ্দিন ইয়াকুতের প্রতি মাত্রাধিক দুর্বলতা ও তাকে অধিক সুযোগ-সুবিধা দানের জন্য আলতুনিয়া নামের একজন গভর্নর রাজিয়ার বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেন। জামালুদ্দিনকে সঙ্গে নিয়ে রাজিয়া সুলতানা অশ্বপৃষ্ঠে চেপে যুদ্ধযাত্রা করেন। কিন্তু বিদ্রোহী দলে অধিকসংখ্যক সৈন্য জামালুদ্দিন ও রাজিয়া পরাজিত হন। জামালুদ্দিন যুদ্ধে নিহত হন এবং রাজিয়া আলতুনির হাতে বন্ধি হন। দিল্লিতে আমির-ওমরাহগণ রাজিয়ার এই বিপর্যয়ের সংবাদ পেয়ে তার সৎভাইকে সুলতান হিসেবে ঘোষণা দেন। এদিকে বন্ধি অবস্থায় রাজিয়া আলতুনিয়াকে বিয়ে করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। ১২৪০ খ্রিষ্টাব্দে নিজের এবং আলতুনিয়ার সৈন্যবাহিনীসহ রাজকীয় বাহিনী দিল্লি অভিমুখে যাত্রা করেন। কিন্তু দিল্লির উপকণ্ঠে নতুন সুলতানের বাহিনীর সঙ্গে আলতুনিয়া ও রাজিয়ার বাহিনীর সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষে রাজিয়া পরাজিত ও নিহত হন। এজন্য রাজিয়াকে বীর রানী বলা যায়। দিল্লির উপকণ্ঠে একটি সমাধি নির্মাণ করে সুলতানা রাজিয়াকে সমাহিত করা হয়।

১২৩৬ সাল থেকে ১২৪০ সাল পর্যন্ত মোট চার অথবা সাড়ে চার বছর রাজিয়া ভারতবর্ষ শাসন করেছিলেন। ভারতবর্ষের সমৃদ্ধ ইতিহাসের ভিড়ে এই সময়টুকুর কথা হয়তো তেমন আলোচনাতেই আসতো না। কিন্তু সম্রাজ্ঞী রাজিয়া সুলতানা নিজ যোগ্যতাবলেই এই সময়টুকুকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে পেরেছিলেন। ভারতবর্ষের প্রথম নারী সুলতান হিসেবে অবশ্যই তিনি নিজেকে ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করছেন। কারণ একজন নারী হিসেবে তিনি যে সময় সিংহাসনে বসেছিলেন, সে সময় তা কল্পনাও করা যেতো না। ইসলাম ও ভারতবর্ষের ইতিহাসে যে কয়জন নারী খুব বেশি আলোচিত হন, রাজিয়া সুলতানা তাদের মধ্যে অন্যতম, যিনি শুধুমাত্র নিজ যোগ্যতাবলে ভারতবর্ষের পরাক্রমশালী সব রাজা, মহারাজা, বাদশাহ আর সম্রাটদের পাশে নিজের অবস্থান গড়ে নিতে পেরেছিলেন। আর তাই ভারতবর্ষের শাসকদের তালিকায় আজও তার নামটি নক্ষত্রের মতই জ্বলজ্বল করছে।

শাসক হিসেবে কেমন ছিলেন রাজিয়া? এ প্রশ্নের উত্তরে দ্বিধাহীনভাবে বলা যায়, তিনি একাধারে একজন দক্ষ প্রশাসক আর সেনাপতি হিসেবে নিজের গুরুত্ব তুলে ধরতে পেয়েছিলেন। তিনি ছিলেন মেধাবী, বুদ্ধিমতী, রূপবতী এবং পরিশ্রমী। পিতা ইলতুৎমিশ যখন যুদ্ধের জন্য রাজধানী ত্যাগ করতেন, তখন মূলত রাজ্য পরিচালনা করতেন তার কন্যা এই রাজিয়াই। সত্যিকার অর্থে রাজপরিবারে সেই সময় রাজিয়ার চেয়ে যোগ্য আর দক্ষ কেউ ছিলেন না। তিনি যুদ্ধক্ষেত্রেও নিজের সাহসিকতা প্রদর্শন করতে পেরেছিলেন। যুদ্ধক্ষেত্রে হাতির পিঠে চড়ে একেবারে সামনে থেকে তিনি যুদ্ধের নেতৃত্ব দিতেন।

তার মৃত্যু নিয়ে বেশ কয়েকটি কথা রয়েছে। একটি পক্ষ দাবি করেছেন, ১২৪০ পলায়নকালে তার একজন ভৃত্য যে কিনা এই চক্রের অন্তর্ভুক্ত ছিল, তাকে খাদ্যে বিষ দিয়ে হত্যা করে। এই ভৃত্যই তাকে আশ্রয় দিয়েছিল।

আরেকটি পক্ষ দাবি করেছেন, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে ক্লান্ত আর ক্ষুধার্ত অবস্থায় রাজিয়া এক কৃষকের বাড়িতে আশ্রয় নেন। খাওয়া-দাওয়ার পর তিনি ঘুমালে কৃষক তার শরীরে রাজকীয় পোশাক দেখতে পায়। পোষাকে প্রচুর রত্ন লাগানো ছিলো। কৃষক সহজেই বুঝে যায় তাঁর সামনে ঘুমিয়ে থাকা নারী সাধারণ কেউ নন। কৃষকটি ধন-সম্পদের লোভে পড়ে ঘুমন্ত রাজিয়াকে হত্যা করে এবং রত্ন নিয়ে পালিয়ে যায়।

 

এসএইচ/