ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৫ ১৪৩০

শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতি পাঠাগারের ৩০ বছর

ঝড়ের মুখে দীপশিখা

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১০:২৪ পিএম, ১০ মার্চ ২০১৯ রবিবার | আপডেট: ০২:০৫ পিএম, ১৯ মার্চ ২০১৯ মঙ্গলবার

ঝড়ের মুখে প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখা নিঃসন্দেহে কঠিন কাজ। সে রকমই একটি কঠিন কাজ করে চলেছে ঢাকার তেজগাঁয়ের নাখালপাড়ায় শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতি পাঠাগার। ১৯৮৯ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠার পর নানা সংকট মোকাবেলা করে চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে পাঠাগারটি ৩০ বছর অতিক্রম করেছে। 

বর্তমানে এ পাঠাগারের সদস্য সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৫ হাজার এবং সদস্য সংখ্যা আড়াইশ। এ সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। সপ্তাহে প্রতিদিন বিকাল ৪টায় পাঠাগার খোলা হয় এবং রাত ৮টা পর্যন্ত পাঠাগারের কার্যক্রম চলে। নিয়মিত উপস্থিতি ৪০ থেকে ৪৫ জন।
মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদ বুদ্ধিজীবীরা যে শোষণ-বৈষম্যমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন সেই স্বপ্ন ও চেতনা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়েই “শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতি পাঠাগার”-এর প্রতিষ্ঠা। ১৯৮৮ সালে ভয়াবহ বন্যায় দুর্গতদের মধ্যে ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে নাখালপাড়া-লিচুবাগান-শাহীনবাগ এলাকার যে সমাজ ও রাজনীতি-সচেতন ছাত্র-যুবক ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন তারা এলাকায় একটি পাঠাগার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। ১৯৮৯ সালের ৩ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে পাঠাগারের উদ্বোধন করা হয়। উদ্বোধক ছিলেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। এছাড়া উপস্থিত ছিলেন প্রখ্যাত সাংবাদিক সন্তোষ গুপ্ত, শাহরিয়ার কবির, নাখালপাড়া হোসেন আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের তৎকালীন সহকারী প্রধান শিক্ষক আব্দুস সাহীদ ভূঁইয়া।

প্রথমে পাঠাগারের নাম রাখা হয়েছিল শহীদ শহীদুল্লা কায়সার স্মৃতি পাঠাগার। ২৭২, পূর্ব নাখালপাড়ায় পাঠাগারের কার্যক্রম শুরু হয়। কিছুদিন পর পাঠাগারের নাম পরিবর্তন করে বর্তমান নামকরণ শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতি পাঠাগার করা হয়। গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর কর্তৃক আমাদের নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে, তালিকাভুক্তি নম্বর : ঢাকা-৭১ (১৯.০৯.২০১৬)।
১৯৯০ সালে এরশাদ সরকারের পতনের পর অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ও শাহরিয়ার কবীর প্রমুখদের লেখা নিয়ে প্রকাশিত হয় অঙ্গীকার নামে একটি প্রকাশনা। যার প্রচ্ছদ এঁকে দিয়েছিলেন প্রখ্যাত শিল্পী ও কার্টুনিস্ট রফিকুন্নবী (রণবী)। এ পর্যন্ত পাঠাগারের মোট ৯টি প্রকাশনা রয়েছে। সর্বশেষ ২০১৯ সালের বইমেলায় পাঠাগারের ৩০ বছর পূর্তিকে স্মরণীয় করে রাখার লক্ষ্যে প্রকাশিত হয়েছে শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ (প্রকাশক আগামী প্রকাশন)। যাতে ৩২৯ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর জীবন (১৬২ জনের ছবিসহ), মুক্তিযুদ্ধে তাঁদের ভূমিকা এবং শহীদ হওয়ার ঘটনা।

প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রতি বছর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। বিভিন্ন বছর এসব কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন প্রয়াত বুদ্ধিজীবী আহমদ শরীফ, কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এবং অভিনেতা গোলাম মোস্তফা। পাঠাগারের অনুষ্ঠানে আরও অংশ নিয়েছেন বাংলা একাডেমির সাবেক পরিচালক রশীদ হায়দার, আখতার হুসেন, সাহিত্যিক সেলিনা হোসেন, পান্না কায়সার, অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, সলিমুল্লাহ খান, প্রখ্যাত কার্টুনিস্ট আহসান হাবিব, অধ্যাপক আজফার হোসেন, আবৃত্তি শিল্পী শিমুল মুস্তাফা ও মাহিদুল ইসলাম মাহী। এছাড়া শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পরিবারের সন্তানরাও আমাদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন।

নামমাত্র ১০ টাকা ভর্তি ফির বিনিময়ে এখানে স্কুল শিক্ষার্থীদের সদস্যপদ দেওয়া হয়। মাসিক চাঁদা ১০ টাকা। দরিদ্র বা অসমর্থ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কোনো সদস্য ফি বা চাঁদা নেওয়া হয় না। কলেজগামীদের জন্য চাঁদার হার ২০ টাকা, বিশ্ববিদ্যালয়গামী ও চাকরিজীবী-পেশাজীবীদের জন্য মাসিক চাঁদা ৩০ টাকা। ঘর ভাড়া, বিদ্যুৎ বিলসহ মাসে খরচ ১০ হাজার টাকা। পাঠাগারের সাবেক সদস্য এবং শুভানুধ্যায়ীরা চাঁদা দিয়ে এ খরচ বহন করেন। এছাড়া প্রতিবছর ডিসেম্বর মাসে এলাকায় বাসাবাড়ি ও দোকানপাটে পাঠাগারের পক্ষ থেকে অর্থ ও বই সংগ্রহ করা হয়। এছাড়া একুশের বইমেলা থেকেও বই সংগ্রহ করা হয়।

নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও পাঠাগারের পক্ষ থেকে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের শিক্ষা সহায়তা, মেডিকেল ক্যাম্প, বন্যা দুর্গতদের জন্য ত্রাণ সংগ্রহ, মেয়েদের খালিহাতে আত্মরক্ষার প্রশিক্ষণ, ক্রিকেট-ফুটবল খেলার আয়োজন, শিক্ষাসফর, দেয়ালপত্রিকা প্রকাশ, চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, হাতের লেখা প্রতিযোগিতা, রচনা লেখা প্রতিযোগিতা, সাধারণজ্ঞান প্রতিযোগিতা, গান শেখা, কবিতা আবৃত্তি, বিতর্ক, রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী, বাংলা নববর্ষ, বিভিন্ন জাতীয় দিবস পালন করা হয়। পাঠাগারের কাজকর্মের তথ্য ও ছবি ফেসবুক পেজে দেওয়া হয় (www.facebook.com/শহীদ-বুদ্ধজিীবী-স্মৃত-িপাঠাগার- Shaheed-Buddhijibi-Smrity-Pathagar-1574398436148310/)

পাঠাগারের নিজস্ব কোনো ঘর না থাকায় দোকান ভাড়া নিয়ে পাঠাগার চালাতে হয়। কখনও কখনও অর্থের অভাবে পাঠাগার বন্ধ রাখতে হয়েছে। এছাড়া বারবার স্থান বদল হওয়ায় বহু মূল্যবান বই ও সামগ্রী নষ্ট হয়েছে, কিংবা খোয়া গেছে।


কমপিউটার-মোবাইল আসক্তির এ যুগে শিশু-কিশোরদের মধ্যে পাঠাভ্যাস গড়ে তোলা এবং পাঠাগার সচল রাখার কাজটি ঝড়ের মুখে প্রদীপ জ্বালানোর মতোই। সে কাজে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতি পাঠাগার উত্তীর্ণ হয়েছে। এখন দরকার পাঠাগারটিকে স্থায়ী ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো। আশা করা যায়, সমাজের সহৃদয় মানুষদের সহায়তায় সে কাজেও সফল হতে পারবে।

এসএইচ/