ঢাকা, শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

কিডনি সংযোজনে সফলতা ও প্রতিবন্ধকতা

ডা. হারুন আর রশিদ

প্রকাশিত : ০৯:১১ এএম, ১৪ মার্চ ২০১৯ বৃহস্পতিবার

১৯৮২ সালে অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে ৩২ বছরের এক যুবক ভর্তি হয় তৎকালীন পিজি হাসপাতাল, বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে। কয়েকদিনের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ধরা পড়ে তার কিডনি রোগ এবং দুটো কিডনিই সম্পূর্ণ নষ্ট। তখনও দেশে হেমোডায়ালাইসিস চিকিৎসা শুরু হয়নি।


সুতরাং পেরিটোনিয়াল ডায়ালাইসিসের মাধ্যমে তাকে বাঁচিয়ে রাখা হয়। পেরিটোনিয়াল ডায়ালাইসিস করে তখন বেশিদিন রোগীকে বাঁচানো যেত না, তাই রোগীর নিকটাত্মীয়কে কিডনি দেয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়।

রোগীর বোন কিডনি দিতে এগিয়ে আসে এবং তার রক্তের গ্রুপ ও টিস্যু টাইপ করে ৫০ ভাগ মিল পাওয়া যায়। তখনকার বিখ্যাত ইউরোলজিস্টদের সহায়তায় কিডনি স্পেশালিস্টদের সঙ্গে নিয়ে সেই প্রথম এ দেশে কিডনি প্রতিস্থাপনের দুর্লভ চিকিৎসার সূচনা করা হয়। টানটান উত্তেজনার ভেতরে সারাটি রাত জেগে অপেক্ষা করা হয়- নতুন প্রতিস্থাপিত কিডনি কখন কাজ শুরু করবে।

রোগীর বন্ধ থাকা প্রস্রাব শুরু হয় পরদিন সকাল থেকে এবং রোগী দ্রুত সুস্থ হয় ২ সপ্তাহের ভেতর। কিন্তু দুর্ভাগ্য অপেক্ষা করছিল আমাদের জন্য। ৬-৮ সপ্তাহ পর রোগীর নিউমোনিয়া হয় এবং রোগীকে আর বাঁচানো সম্ভব হয়নি।

এর পর থেকে শুরু হয় কিডনি সংযোজনের মতো দুর্লভ চিকিৎসা। ১৯৮৩ সালে আরও একটি কিডনি সাফল্যজনকভাবে প্রতিস্থাপন করা হয়, রোগী বেঁচেছিলেন ৯ মাস। তবে ১৯৮৮ সালে এর কার্যক্রম গতি লাভ করে। এ সময় আমরা লক্ষ করি, বেশকিছু রোগী কিডনি সংযোজনের জন্য বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে এবং কিডনিদাতাকেও সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে।

লাখ লাখ বৈদিশিক মুদ্রা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। বাংলাদেশ রেনাল অ্যাসোসিয়েশন এবং বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইউরোলজিক্যাল সার্জন্সের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় Organ Act Law, 1999 সরকারের সহযোগিতায় জাতীয় সংসদে পাস করা হয়।

কী আছে এ আইনে

এই আইনে বলা আছে, একজন ব্যক্তি জীবিতাবস্থায় প্রাপ্ত বয়সে তার একটি কিডনি নিকটাত্মীয়কে দান করতে পারবে। নিকটাত্মীয় বলতে বোঝাবে বাবা-মা, ভাই-বোন, ছেলে-মেয়ে, স্বামী-স্ত্রী এবং আপন চাচা, মামা, ফুফু ও খালা।

তবে জানুয়ারি ২০১৮ সালে নতুন আইনে নিকটাত্মীয়ের পরিধি বাড়ানো হয়েছে। উপরোক্ত আত্মীয় ছাড়াও চাচাতো ভাই, মামাতো ভাই, ফুফাতো ভাই, খালাতো ভাই এবং নানা-নানি, দাদা-দাদিকে নিকটাত্মীয় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

মৃত ব্যক্তির (Brain death) কিডনি আত্মীয়-অনাত্মীয় সবাইকে দান করা যাবে। জীবিত ব্যক্তি সুস্বাস্থ্যের অধিকারী এবং তার ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনিতে কোনো রোগ থাকা যাবে না। তার শরীর Hepatitis B.C, HIV থেকে মুক্ত থাকতে হবে। কিডনিদাতা সম্পূর্ণ নিজ ইচ্ছায় কিডনি দান করতে পারবে। কিডনিদাতার বয়স ১৮ থেকে ৬৫ বছরের ভেতর হতে হবে।

আর Cadaveric বা Deceased কিডনি সংযোজনের ক্ষেত্রে বয়স ২ থেকে ৬৫ বছর হলে চলবে এবং মৃত্যুর আগে তাকে সম্মতিপত্র অথবা মৃত্যুর পর নিকটাত্মীয়ের সম্মতিতে তার দুটো কিডনি, লিভার, হার্ট, ফুসফুস অপারেশনের মাধ্যমে Brain death ঘোষণার পর বিযুক্ত করা যাবে। পরিশেষে বলা আছে, এ আইনের ব্যত্যয় ঘটলে অর্থাৎ অনাত্মীয় কিডনি ক্রয়-বিক্রয়ে কেউ সহায়তা করলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে।

বাংলাদেশে কিডনি সংযোজনের সাফল্য কতটুকু

বিগত ২০ বছরে নিকটাত্মীয়ের কিডনি নিয়ে কিডনি সংযোজন ব্যাপক সাফল্য লাভ করেছে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৮৮ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ৫১৫, কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতাল ও রিসার্চ ইন্সটিটিউটে ২০০৬ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ৪২৫, বারডেম হাসপাতালে ২০০৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ১২৭, ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব কিডনি ডিজিজ ও ইউরোলজিতে ২০০৭ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ৩৫, ঢাকা মেডিকেল কলেজে ৪, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ২ এবং সেন্টার ফর কিডনি ডিজিজে ২০০৭ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ৫২০, ইউনাইটেড হাসপাতালে ৩৯, পপুলার মেডিকেল কলেজে ৮০ এবং অ্যাপোলো হাসপাতালে ১৫টি কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়েছে।

মোট ১ হাজার ৭৯১টি কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা হয়েছে। এখানে উল্লেখ করা যায়, শতকরা ৯০ ভাগ কিডনি সংযোজন হয়েছে সরকারি ও অলাভজনক প্রতিষ্ঠানে এবং মাত্র ১০ ভাগ কিডনি সংযোজন হয়েছে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে।

কিডনি সংযোজন কীভাবে করা হয়

প্রথমেই বলে রাখা ভালো, কিডনি সংযোজন বিংশ শতাব্দীর একটি অতি উচ্চপর্যায়ের চিকিৎসাব্যবস্থা। এ চিকিৎসার সাফল্য নির্ভর করে হাসপাতালের দক্ষ চিকিৎসক, বিশেষ ট্রেনিংপ্রাপ্ত আইসিইউ নার্স এবং নিয়মিত ও নিয়ন্ত্রিত ওষুধ ব্যবহারের ওপর। অপারেশনের জন্য দরকার হয় দুটি অত্যাধুনিক অপারেশন থিয়েটার, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশ এবং জীবাণুমুক্ত আইসিইউ।

একজন কিডনি অকেজো রোগী, যার বয়স ১০ থেকে ৬৫-এর ভেতরে, যার লিভার ও হার্ট সুস্থ এবং শরীরের কোনো সংক্রামক ব্যাধি নেই এবং রোগী ডায়ালাইসিসে সুস্থ থাকে, তাকেই কিডনি সংযোজনের জন্য মনোনীত করা হয়।

এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আইন অনুযায়ী নিকটাত্মীয়কে ‘কিডনিদাতা’ হিসেবে উপস্থাপন করার অনুরোধ করা হয়। কিডনিদাতা ও গ্রহীতার সম্পর্ক নিশ্চিত হওয়ার পর তার রক্তের গ্রুপ ও টিস্যু টাইপিংয়ের মিল পরিলক্ষিত হলে প্রাথমিকভাবে কিডনিদাতা মনোনীত করা হয়।

এরপর কিডনিদাতা শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ কিনা তা বিভিন্ন পরীক্ষা করে নিশ্চিত করা হয়। যখন দেখা হয় তার দুটো কিডনি সম্পূর্ণ সুস্থ ও স্বাভাবিক এবং একটি কিডনি দিয়ে সে বাকি জীবন স্বাভাবিকভাবে কাটাতে পারবে, শারীরিক পরিশ্রমে কোনো অসুবিধা হবে না, কেবল তখনই তাকে কিডনিদাতা হিসেবে মনোনীত করা হয়।

এরপর রোগীকে ও কিডনিদাতাকে আইন অনুযায়ী নিকটাত্মীয় কিনা তার প্রামাণিক দলিল দাখিল করতে নির্দেশ দেয়া হয়। এর মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট প্রমাণ ডিএনএ টেস্ট এবং স্বামী-স্ত্রীর ক্ষেত্রে বিবাহের কাবিননামা।

শতকরা ৮০ ভাগ ক্ষেত্রে সাধারণত বাবা-মা, ছেলে-মেয়ে এবং ভাই-বোন একে অপরকে কিডনিদান করে থাকেন। শতকরা ২০ ভাগ ক্ষেত্রে যেখানে বাবা-মা বৃদ্ধ বা শারীরিকভাবে অসুস্থ কেবল সেক্ষেত্রেই আপন চাচা, মামা, ফুফু ও খালাকে কিডনিদাতা হিসেবে নির্ধারণ করা হয়।

এছাড়া কিডনি রোগী ও কিডনিদাতাকে একটি নির্ধারিত সময়ে আত্মীয়তা যাচাই-বাছাই কমিটির কাছে হাজির হতে হয়। যাচাই-বাছাই কমিটি কর্তৃক রোগী ও দাতার সম্পর্ক আইন অনুযায়ী সঠিক কিনা তা নির্ধারণের পরই কিডনি সংযোজন করার জন্য অনুমতি প্রদান করা হয়।

এরপর মেডিকেল বোর্ড যখন নিশ্চিত হয় কিডনিদাতা ও গ্রহীতা অপারেশনের জন্য উপযুক্ত কেবল তখনই অপারেশনের তারিখ দেয়া হয়।

হাসপাতালে ভর্তি

কিডনি রোগী ও কিডনিদাতাকে ১-২ সপ্তাহ আগেই হাসপাতালে ভর্তি করে তাদের আত্মীয়তা সম্পর্ক পর্যবেক্ষণ করা হয়। এ সময়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও সার্জন এবং এনেস্থেসিওলোজিস্ট রোগী ও কিডনিদাতার সর্বশেষ স্বাস্থ্য সমন্ধে অবহিত হন। কিডনি সংযোজনের জন্য দুটি ওটি পাশাপাশি বরাদ্দ থাকে এবং আগের দিন ওটি জীবাণুমুক্ত করা হয়।

এখানে উল্লেখযোগ্য, ট্রান্সপ্ল্যান্ট ওটিতে অন্য কোনো অপারেশন করা হয় না। ১৫ জনের একটি চিকিৎসক দল দুই ওটিতে বিভক্ত হয়ে প্রায় ৫-৬ ঘণ্টা এই অপারেশন করে থাকে।

দাতার কিডনি বিযুক্ত করার কয়েক সেকেন্ডের ভেতর তা বিশেষ ধরনের জীবাণুমুক্ত পারফিউশন ফ্লুইড দ্বারা কিডনি পরিষ্কার করে তা বরফের ভেতর ডুবিয়ে রাখা হয় এবং ২-৩ মিনিটের ভেতর কিডনি গ্রহীতার পেটের ডান বা বামদিকে নিচের অংশে জোড়া লাগানোর ব্যবস্থা করা হয় এবং ৩৫-৪৫ মিনিটের ভেতর তা সম্পূর্ণ করা হয়।

যত তাড়াতাড়ি কিডনি রোগীর দেহে লাগানো যাবে, তত তাড়াতাড়ি কিডনি তার কার্যকারিতা শুরু করবে এবং রোগী ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠবে। এই সময়ে গ্রহীতার কিডনি যাতে শরীর থেকে জবলবপঃ না করে, তার জন্য বিশেষ ধরনের Injection দেয়া হয়। এখানে মনে রাখা উচিত কিডনি খুবই স্পর্শকাতর অঙ্গ এবং শরীরের বাইরে বেশিক্ষণ সচল থাকে না।

কয়েক বছর আগে কোনো কোনো দৈনিক কাগজে খবর বেরিয়েছিল, কোনো এক রোগীর এপেনডিক্স অপারেশনের সময় তার কিডনি কেটে নেয়া হয়েছে এবং তার কিডনি অন্যত্র পাচার করার জন্য করা হয়েছে।

এর কিছুদিন পর আরও একটি খবরে প্রকাশ করা হয়- একজন শিশুকে অপহরণ করে তার দুটো কিডনি কেটে স্যালাইন ব্যাগে নিয়ে পাচার করা হয়েছে। এ ধরনের উদ্ভট খবর একেবারেই ভিত্তিহীন। কিডনি কেটে কিডনি সংযোজন করতে হলে অত্যাধুনিক অপারেশন থিয়েটার যেমন প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন বিশেষজ্ঞ ট্রান্সপ্ল্যান্ট সার্জন।

কিডনি কেটে নেয়ার ২-৩ মিনিটের ভেতর কিডনির কাযকারিতা সম্পূর্ণ লোপ পেতে থাকে, যদি তা বৈজ্ঞানিক উপায়ে সংরক্ষণ করা না হয়। অতি উন্নত অপারেশন থিয়েটার ছাড়া এবং প্রতিষ্ঠিত সার্জন ছাড়া কিডনি বিযুক্ত করা যায় না।

এবং তা বৈজ্ঞানিক উপায়ে সংরক্ষণ না করলে ওই কিডনি কয়েক মিনিটের ভেতর অকার্যকার হয়ে যায় এবং সেই কিডনি কোনো মানুষের শরীরে প্রতিস্থাপন করা সম্ভব না। এ ধরনের কিডনি প্রতিস্থাপন করলে কিডনি রোগী জীবাণুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে।

যেসব ব্যক্তি আইসিইউতে মৃত্যুর সঙ্গে লড়েছে এবং ভেন্টিলেটর থাকা অবস্থায় ব্রেইনডেথ বা মৃত ঘোষিত হয়েছে কেবল সেসব ক্ষেত্রে নিকটাত্মীয়র অনুমতিসাপেক্ষে মৃতব্যক্তির অঙ্গ-প্রতঙ্গ বিযুক্ত করে তা বিশেষ ব্যবস্থায় ৬-৮ ঘণ্টা সংরক্ষণ করা যেতে পারে।

জীবিত অবস্থায় কিডনি লাগানোর পর কিডনি গ্রহীতা ও কিডনিদাতা দুজনকেই আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয় এবং নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। প্রতি ঘণ্টায় প্রস্রাব, রক্তচাপ, শরীরের তাপ ও হৃৎপিণ্ডের গতি পর্যবেক্ষণ করা হয়।

রোগী যাতে সংক্রমিত না হয় সেজন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়। কয়েকদিনের ভেতর কিডনিদাতা দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠে এবং তাকে ৭-৮ দিন পর হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেয়া হয়।

কিডনি গ্রহীতা বা রোগীকে ১৪ দিন পর ছেড়ে দেয়া হয় এবং প্রতি ৭ দিন পরপর ৩ মাস, ১৪ দিন পরপর ৩ মাস, পরবর্তীকালে প্রতি ২-৩ মাস অন্তর পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। আর কিডনিদাতাকে বছরে একবার দেখা করলে চলে।

অপারেশন থিয়েটারে কিডনি সংযোজনে রোগীর কী অসুবিধা হতে পারে

কিডনি সংযোজনের সবচেয়ে বড় বাধা কিডনি গ্রহীতার শরীর কিডনি গ্রহণ না করা এবং শরীরে বিভিন্ন ধরনের সংক্রমণ আক্রমণ। প্রথম ৬ মাস রোগীকে বিভিন্ন বিধিনিষেধের আওতায় রাখা হয়। ৬ মাস পেরিয়ে গেলে সাধারণত আর কোনো অসুবিধা হয় না।

শতকরা ৩০-৪০ ভাগ ক্ষেত্রে কিডনি গ্রহীতার শরীর দাতার কিডনি রিজেকশন করে যা ওষুধ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ২০ ভাগ ক্ষেত্রে নতুন করে ডায়াবেটিস হতে পারে। এছাড়া যক্ষ্মা, নিউমোনিয়া, উচ্চ রক্তচাপ এবং নতুন করে ডায়াবেটিস হতে পারে।

এতসব সত্ত্বেও একজন রোগী কিডনি সংযোজনের পর নবজীবন লাভ করে এবং রোগী নিজেকে সম্পূর্ণ সুস্থ ও স্বাভাবিক মনে করে এবং সে তার কর্মক্ষেত্রে ফিরে যায়। কিডনি সংযোজনের ২ বছর পর অবিবাহিত মহিলা বা পুরুষ বিয়ে, সংসার, ছেলেমেয়ে সব ঝুঁকিই নির্বিঘ্নে নিতে পারে।

কিডনি সংযোজনের খরচ

কিডনি সংযোজন একটি ব্যয়বহুল চিকিৎসাব্যবস্থা। বেশিরভাগ রোগী এই খরচ বহন করতে অক্ষম। তবে সুখের বিষয়, বাংলাদেশে যেসব হাসপাতালে এ চিকিৎসার ব্যবস্থা চালু আছে তার বেশির ভাগই অলাভজনক প্রতিষ্ঠান, যেমন- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে কিডনি সংযোজনে খরচ হয় ১ লাখ টাকা, কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতাল ও রিসার্চ ইন্সটিটিউটে খরচ হয় ২ লাখ ৬০ হাজার টাকা এবং বারডেম হাসপাতালে ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা।

এসব হাসপাতালে কিডনি সংযোজনে রোগীদের ভর্তুকির মাধ্যমে চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকে। সংশ্লিষ্ট ডাক্তাররা রোগীর কাছ থেকে কোনো ফি নেন না। শুধু ইনভেস্টিগেশন, ওটি এবং আইসিইউ বাবদ উপরোক্ত খরচ হয়ে থাকে।

কিডনি সংযোজনের সাফল্য

বাংলাদেশে কিডনি সংযোজনের সাফল্যের হার শতকরা ৯০-৯৫ ভাগ। কিডনি সংযোজন করার ৫ বছর পর বেঁচে থাকে শতকরা ৮০ ভাগ রোগী এবং ১০-১৫ বছর বেঁচে থাকে শতকরা ৭০-৭৫ ভাগ রোগী।

অনেক দরিদ্র রোগী দামি ওষুধ নিয়মিত সেবন করে না, ফলে তাদের কিডনির কার্যকারিতা লোপ পায় এবং তা রিজেকশন হয়ে যায়। কিছু রোগী ২-৩ বছর পর না জেনে ওষুধ বন্ধ করে দেয়, ফলে সংযোজিত কিডনি নষ্ট হয়ে যায়।

কিডনি সংযোজনের প্রতিবন্ধকতা

বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে উপযুক্ত কিডনি দাতার অভাব রয়েছে। বাংলাদেশে পরিবার সাধারণত একান্নবর্তী। সুতরাং যেসব ক্ষেত্রে মা-বাবা বৃদ্ধ, ছেলেমেয়ের সংখ্যা কম বা রক্তের গ্রুপে মিল নেই, সেসব ক্ষেত্রে আপন চাচা, মামা, ফুফু ও খালা বেশি এগিয়ে আসতে পারেন।

আর বর্তমানে চাচাতো ভাই, মামাতো ভাই, ফুফাতো ভাই, খালাতো ভাই, এমনকি নানা-নানি, দাদা-দাদিরাও দাতা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত। মনে রাখা দরকার, একজন সুস্থ মানুষের জন্য একটি সুস্থ কিডনিই যথেষ্ট, দুটো কিডনির প্রয়োজন হয় না।

চিকিৎসা বিজ্ঞানে কিডনি দাতাদের বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে এটা প্রমাণিত যে, তারা একটি কিডনি দানের জন্য বাড়তি কোনো অসুবিধা ভোগ করে না। বছরের পর বছর ধরে কিডনি দাতাদের পরীক্ষা করে তাদের সম্পূর্ণ শারীরিক ও মানসিক সুস্থ ও কর্মক্ষম পাওয়া গেছে।

এটা প্রমাণিত হওয়ার পরই সারা বিশ্বেই জীবিত কিডনি দাতাকে কিডনি দানে উৎসাহিত করা হয়েছে। বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশেও কিডনি অকেজো রোগীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে।

সুতরাং শুধু নিকটাত্মীয়ের কিডনি দিয়ে সব কিডনি অকেজো রোগীকে বাঁচানো সম্ভব হচ্ছে না। ফলে বেশিসংখ্যক কিডনি অকেজো রোগীকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য মৃত ব্যক্তির কিডনি, যিনি আইসিইউতে চিকিৎসাধীন, তার Brain death ঘোষণার পর নিকটাত্মীয়ের সম্মতিক্রমে তার শরীর থেকে দুটো কিডনি বিযুক্ত করে তা তাৎক্ষণিকভাবে দুটো কিডনি অকেজো রোগীর দেহে সংযোজন করা যায় অর্থাৎ একজন মৃত ব্যক্তি দু’জন কিডনি অকেজো রোগীকে নতুন জীবনদান করতে পারে।

কোনো ব্যক্তির মৃত্যু আইসিইউ বাদে ঘরে বা হাসপাতালে ঘটলে ওই ধরনের রোগীর কিডনি কোনো কাজে আসে না। মৃত ব্যক্তির কিডনি বলতে শুধু আইসিইউতে চিকিৎসাধীন থাকাবস্থায় Brain death ঘোষণার পরই তার দুটো কিডনি বিযুক্ত করা যায়।

এ ব্যাপারের গণসচেতনতা বৃদ্ধি করা দরকার। প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হওয়াসহ বহু রোগীর আইসিইউতে অকাল মৃত্যু ঘটছে। মানবিক কারণে ওইসব রোগীর কিডনি ও লিভার, হার্ট বিযুক্ত করে কিডনি, লিভার ও হার্ট অকেজো রোগীদের দেহে প্রতিস্থাপন করা গেলে বহু রোগী নতুন জীবন ফিরে পেতে পারে।

আপনি আপনার মৃত্যুর পর আরও ছয়জন মানুষকে নতুন জীবন দান করে মহানুভবতার উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারেন। আর এ কাজের জন্য আপনি আপনার আত্মীয়-স্বজন এবং রাষ্ট্রের কাছে অতি সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

ডা. হারুন আর রশিদ : কিডনি বিশেষজ্ঞ; প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, কিডনি ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ


টিআর/