ঢাকা, মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ১০ ১৪৩১

শুভ জন্মদিন মাস্টারদা সূর্য সেন

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১১:১৫ এএম, ২২ মার্চ ২০১৯ শুক্রবার

সূর্য সেন ভারতবর্ষের ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নেতা, একজন বাঙালি বিপ্লবী। সূর্য সেন বা সূর্যকুমার সেনের ডাকনাম কালু, তবে তিনি মাস্টারদা নামে সমধিক পরিচিত। আজ সূর্য সেনের শুভ জন্মদিন। ১৮৯৪ সালের ২২ মার্চ চট্টগ্রামের রাউজান থানার নোয়াপাড়ায় অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছল পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।

সূর্য সেন ছেলেবেলা থেকে খুব মনোযোগী ভালো ছাত্র এবং ধর্মভাবাপন্ন গম্ভীর প্রকৃতির ছিলেন। ১৯১২ সালে চট্টগ্রামের নন্দনকাননে অবস্থিত হরিশদত্তের ন্যাশনাল স্কুল থেকে প্রবেশিকা (এন্ট্রান্স) পাস করে চট্টগ্রাম কলেজ হতে এফ এ (এইচএসসি) পাস করেন এবং বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে বিএ পাস করেন।

পড়াশোনা শেষ করে চট্টগ্রামে ফিরে এসে আচার্য্য হরিশদত্তের জাতীয় স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। অসহযোগ আন্দোলনের সময় বিদ্যালয়টি বন্ধ হয়ে গেলে তিনি দেওয়ানবাজারে বিশিষ্ট উকিল অন্নদা চৌধুরী প্রতিষ্ঠিত অধুনালুপ্ত ‘উমাতারা উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে’ অঙ্কের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। এ সময় বিপ্লবী দলের সঙ্গে তার সম্পর্ক গভীরতর হয়ে ওঠে এবং শিক্ষকতা করার কারণে তিনি ‘মাস্টারদা’ হিসেবে পরিচিত হন।

বিদ্রোহ চলাকালে ১৯২৬ সালে সূর্য সেন পলাতক অবস্থায় কলকাতার আমহার্স্ট স্ট্রিটের এক মেসে পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। সেখান থেকে তাকে মুম্বাইয়ের রত্নগিরি জেলে পাঠানো হয়।

১৯১৬ সালে বহররমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজের ছাত্র থাকাকালীন সময়ে সূর্য সেন সরাসরি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত হন। তিনি ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবী সংগঠন ‘যুগান্তর’ এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে সূর্য সেন তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী অম্বিকা চক্রবর্তীর সঙ্গে চট্টগ্রাম শহরের দেওয়ানবাজার দেওয়ানজী পুকুরপাড়ে ‘সাম্য আশ্রম’ প্রতিষ্ঠা করে গোপনে বিপ্লবী কার্যক্রম চালাতে থাকেন।

মহাত্মা গান্ধী ১৯২২ সালে অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করলে বিপ্লবী দলগুলো আবার সক্রিয় হয়ে উঠে। তখন চট্টগ্রাম কোর্টের ট্রেজারি থেকে পাহাড়তলীতে অবস্থিত আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে কারখানার শ্রমিক ও কর্মচারীদের বেতন নিয়ে যাওয়া হতো।

১৯২৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর টাইগার পাস-এর মোড়ে সূর্য সেনের গুপ্ত সমিতির সদস্যরা প্রকাশ্য দিবালোকে বেতন বাবদ নিয়ে যাওয়া ১৭,০০০ টাকার বস্তা ছিনতাই করে। ছিনতাইয়ের প্রায় দুই সপ্তাহ পর গোপন বৈঠক চলাকালীন অবস্থায় পুলিশ বিপ্লবীদের আস্তানায় হানা দিলে পুলিশের সঙ্গে বিপ্লবীদের খণ্ডযুদ্ধ হয় যা ‘নাগরখানা পাহাড় খণ্ডযুদ্ধ’ নামে পরিচিত।

যুদ্ধের পর গ্রেফতার হন সূর্য সেন এবং অম্বিকা চক্রবর্তী। সূর্য সেন এবং অম্বিকা চক্রবর্তী এ মামলা থেকে ছাড়া পেয়ে যান। গ্রেফতার করার পর বিপ্লবীদের উপর নির্যাতনের কারণে কলকাতা পুলিশ কমিশনার টেগার্টকে হত্যা করার পরিকল্পনা করে বিপ্লবীরা। এই পরিকল্পনার কারণে ১৯২৬ সালের ৮ অক্টোবর সূর্য সেন কলকাতার ওয়েলিংটন স্ট্রিটে গ্রেফতার হন।

বন্দি হওয়ার পর তাকে মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেলে রাখা হয়। ১৯২৮ সালের শেষভাগে সূর্য সেন ও গণেশ ঘোষ জেল থেকে ছাড়া পান।

বিপ্লবী সংগঠনে মেয়েদের সদস্য করার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা ছিল। বিপ্লবীদের প্রতি মা, নিজের বোন এবং অন্যান্য নিকট আত্নীয় ছাড়া অন্য মেয়েদের সঙ্গে মেলামেশা না করার নির্দেশ ছিল মাস্টারদা সূর্য সেনের। পরে তিনি এই নির্দেশ শিথিল করেন। এতে পরবর্তীতে কল্পনা দত্ত ও প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার বিপ্লবী সংগঠনে যোগ দেন।

১৯২৯ সালে বিপ্লবী সূর্য সেন যথাক্রমে চট্টগ্রাম জেলা কংগ্রেসের সভাপতি এবং সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৩০ সালে আইরিশ রিপাবলিকান আর্মির বিপ্লবের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে সূর্য সেন নিজেদের দলের নাম পরিবর্তন করে ‘ভারতীয় প্রজাতান্ত্রিক বাহিনী, চট্টগ্রাম শাখা’ রাখেন।এ দল অস্ত্র সংগ্রহ এবং বোমা তৈরির কাজ করতে থাকে।

১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল। শুক্রবার রাত ১০টায় সূর্যসেন তার সব বিদ্রোহী বাহিনী নিয়ে ধুম রেলস্টেশনে ফিসপ্লেট খুলে একটা মালবহনকারী ট্রেন লাইনচ্যুত করে দেন। এর ফলে চট্টগ্রাম সমগ্র বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

বিদ্রোহীরা চট্টগ্রামের নন্দনকাননে টেলিফোন এবং টেলিগ্রাফ অফিস আক্রমণ করে হাতুড়ি দিয়ে সব যন্ত্রপাতি ভেঙ্গে দেয় এবং পেট্রল ঢেলে সেখানে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হয়।

পাহাড়তলীতে অবস্থিত চট্টগ্রাম রেলওয়ে অস্ত্রাগার দখল করে নেয়। উন্নতমানের রিভলবার ও রাইফেল গাড়িতে নিয়ে অস্ত্রাগারটি পেট্রল ঢেলে আগুন লাগানো হয়।

সর্বশেষ পরিকল্পনা অনুযায়ী বিপ্লবীরা দামপাড়ায় পুলিশ রিজার্ভ ব্যারাক দখল করে নেয়। এই আক্রমণে অংশ নেয়া বিপ্পবীরা দামপাড়া পুলিশ লাইনে সমবেত হয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। মিলিটারি কায়দায় কুচকাওয়াজ করে সূর্য সেনকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়।

সূর্য সেন অস্থায়ী বিপ্লবী সরকার গঠনের ঘোষণা দেন।

তিনি তার ঘোষণায় বলেন: ‘ভারতীয় বিপ্লবের মহান কাজটি সমাপ্ত করেছে ভারতীয় প্রজাতান্ত্রিক বাহিনী। আমরা চট্টগ্রামের বিপ্লবীরা গর্বিত যে এমন দেশপ্রেমের কাজটি করতে পেরেছি। নিপীড়িত বিদেশি সরকারের অস্তিত্ব ধ্বংস হতে যাচ্ছে। আমাদের জাতীয় পতাকা স্বগৌরবে উড়ছে, নিজের জীবন ও রক্ত দিয়ে এ পতাকা রক্ষা করা আমাদের কর্তব্য।’

এভাবে চট্টগ্রাম সম্পূর্ণরূপে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত ছিল চার দিন। কিন্তু এর মধ্যে বিপ্লবীদের খাদ্যসংকট দেখা দেয় এবং সূর্য সেনসহ ছয়জন শীর্ষস্থানীয় বিপ্লবীকে ধরার জন্য ইংরেজ সরকার ৫০০০ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে।

১৯৩০ সালের ২২ এপ্রিল বিপ্লবীরা যখন জালালাবাদ পাহাড়ে (চট্টগ্রাম সেনানিবাসের পাহাড়) অবস্থান করছিল সে সময় সশস্ত্র ইংরেজ সৈন্যরা তাদের আক্রমণ করে। দুই ঘণ্টার প্রচণ্ড যুদ্ধে ব্রিটিশ বাহিনীর ৭০ থেকে ১০০ জন এবং বিপ্লবী বাহিনীর ১২ জন শহীদ হন।

ব্রিটিশ বাহিনী সূর্যসেনকে গ্রেফতার করতে ব্যর্থ হয়। সরকার ৫০০০ টাকার পরিবর্তে ১০,০০০ পুরস্কার ঘোষণা করে।

১৯৩২ সালের ১৩ জুন রাত ৯টায় পটিয়ার ধলঘাট গ্রামে সাবিত্রী চক্রবর্তীর বাড়িতে তাকে ধরার চেষ্টা ব্যর্থ হয়। ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন ক্যামেরনকে গুলি করে সূর্য সেন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার এবং কল্পনা দত্ত পালিয়ে যেতে সক্ষম হন।

১৯৩২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর রাতে প্রীতিলতা সূর্য সেন-এর নির্দেশে ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ করেন। হামলায় ৫৩ জন ইংরেজ হতাহত হয়েছিল। গুলিতে আহত প্রীতিলতা দৈহিকভাবে অত্যাচারিত হওয়ার চাইতে থেকে স্বেচ্ছামৃত্যুকে বেছে নিলেন। তিনি পটাসিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন।

ইংরেজ প্রশাসন সূর্য সেনকে জীবিত অথবা মৃত অবস্থায় ধরার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা অব্যাহত রাখে। ১৯৩৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি রাতে গোপন বৈঠকে ছিলেন সূর্যসেন। ব্রজেন সেনের সহোদর নেত্র সেন সূর্য সেনের উপস্থিতির খবর পুলিশকে জানিয়ে দেয়। রাত ১০টা থেকে ২টা পর্যন্ত তুমুল যুদ্বের পর ২টার দিকে অস্ত্রসহ সূর্য সেন এবং ব্রজেন সেন ধরা পড়েন।

১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি মধ্যরাতে সূর্য সেন ও তারকেশ্বর দস্তিদারের ফাঁসি কার্যকর হওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়।

সূর্য সেনকে ব্রিটিশ সেনারা নির্মমভাবে অত্যাচার করে। ব্রিটিশরা হাতুড়ি দিয়ে তার দাঁত ও হাড় ভেঙ্গে দেয়। তিনি অজ্ঞান হয়ে যান। নিষ্ঠুরভাবে সূর্য সেন ও তারকেশ্বর দস্তিদারের অর্ধমৃতদেহ দুটি ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়।

সূর্য সেন ও তারকেশ্বর দস্তিদারের লাশ আত্মীয়দের হাতে হস্তান্তর করা হয়নি এবং হিন্দু সংস্কার অনুযায়ী পোড়ানো হয়নি।

ফাঁসির পর লাশ দুটো জেলখানা থেকে ট্রাকে করে নিয়ে বুকে লোহার টুকরা বেঁধে বঙ্গোপসাগর আর ভারত মহাসাগরসংলগ্ন একটা জায়গায় ফেলে দেয়া হয়।

 

টিআর/