ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৪ ১৪৩০

ডিগ্রি পাস করে ফুটপাতে বই বিক্রি করেন মধুমণ্ডল

আলী আদনান

প্রকাশিত : ০৭:৫৯ পিএম, ২ এপ্রিল ২০১৯ মঙ্গলবার | আপডেট: ০৮:২৮ পিএম, ২ এপ্রিল ২০১৯ মঙ্গলবার

মধুমণ্ডল

মধুমণ্ডল

পড়ালেখা শেষ করে যুবকরা যখন সার্টিফিকেট নিয়ে বিভিন্ন অফিসের দ্বারে দ্বারে ঘুরছে, বেকারত্বের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে অনেকে বেছে নিচ্ছে নানা অপরাধমূলক কাজ, ঠিক তখনই মধুমণ্ডল নামে এক যুবক স্থাপন করেছেন ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত। ডিগ্রি পাস করে তিনি ফুটপাতে বসে বই বিক্রি করছেন। পাশাপাশি নিজে বই পড়েন অন্যকে বই পাঠে উৎসাহিত করেন।

রাজধানীর শাহবাগের মোড় থেকে টিএসসি`র দিকে যেতে ঠিক কবি নজরুলের মাজারের সামনে চোখে পড়বে ফুটপাতে ভ্যানের উপর একটি বইয়ের দোকান। কম্পিউটার কম্পোজ কাগজে লেখা `বইপোকা`। যা লেমেনেটিং করে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে ভ্যানের উপর। দোকানটির মালিক মধুমণ্ডল। মুখ ভর্তি দাড়ি গোফের এই যুবক ২০১৩ সাল থেকে এখানে বই বিক্রী করছেন।

ভ্যান ভর্তি নানা রকম বই। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ, সাহিত্য, সংস্কৃতি, দর্শন, জীবনী- সব ধরনের বই পাওয়া যায় মধুমণ্ডলের এই ভ্যানে। ক্রেতাদের অধিকাংশই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী। আসা যাওয়ার পথে অনেকেই কয়েক মিনিটের জন্য হলেও `বইপোকা` নামক এই দোকানটির সামনে দাঁড়ায়। নেড়ে চেড়ে বই দেখে। পছন্দ ও সামর্থ্য মিলে গেলে বই কেনে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রী, শিক্ষক, ছাত্রনেতা, প্রক্টরিয়াল বডির অনেকে মধুমণ্ডলকে নামেই চেনেন। এভাবেই বইপোকা`র কর্ণধার মধুমণ্ডল এখন দেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের একজন অলিখিত সদস্য।

পৃথিবী যদি একটি বড় পাঠশালা হয় প্রতিটি মানুষ এক একটি বই। বা প্রতিটা জীবনই এক একটা পান্ডুলিপি। জীবনের প্রতিটা দিন সেই পান্ডুলিপির এক একটা পৃষ্ঠা। মধুমণ্ডল- এর জীবন ও এর ব্যতিক্রম নয়। জীবনে চলার পথে নানা সংগ্রাম ও লড়াই মধুমণ্ডলকে এনে দাঁড় করিয়েছে ফুটপাতে বই বিক্রীর জীবনে। অনেকের চোখে মধুমণ্ডল এখন উদাহরণ হলেও তার গ্রামের মানুষের চোখে সে সফল হতে না পারা এক যুবক।

মধুমণ্ডলের গ্রামের বাড়ী চুয়াডাঙ্গার সদাবরী গ্রামে। তারা বাবা সিরাজমণ্ডল ছিলেন যাত্রাশিল্পী। এখন যাত্রার সেই সুদিন নেই। ফলে সিরাজ মণ্ডলদেরও নেই কদর। কৃষিকাজ করে কোন রকমে জীবন যাপন করেন তিনি। মধুমণ্ডল গ্রামের ওদূদ শাহ ডিগ্রী কলেজ থেকে ডিগ্রী পাস করেন। এরপর ঢাকায় আসেন আইন পড়ার জন্য। মধুমণ্ডলের ভাষায়, "ছোট বেলা থেকেই আমি স্বাধীনচেতা মানুষ। নিজে কিছু করার স্বপ্ন ছিল"।

সেই স্বপ্ন থেকে ২০০৭ সালে ঢাকায় আসেন মধুমণ্ডল। ধানমন্ডি ল` কলেজে ভর্তি হন। একটি ছোট বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেন। মাস তিনেক কাজ করার পর সেই প্রতিষ্ঠান প্রধান তার (মধুমণ্ডল) সঙ্গে অসদাচরণ করলে মধুমণ্ডল রাগারাগি করে চাকরি ছেড়ে দেন। সবে ধন নীলমণি চাকরিটা হারানোর পর অন্য কেউ হলে হয়তো ভেঙ্গে পড়ত। কিন্তু মধুমণ্ডলের ধাঁচটা ভিন্ন। তিনি ঢাকার অলি গলি ফুটপাতে ঘুরেন আর ভাবেন। ভাবেন আর ঘোরেন।

এই প্রতিবেদকের সাথে আলাপ করতে গিয়ে মধুমণ্ডল বলেন, একদিন ঘুরতে ঘুরতে আমি এখানে (কবি নজরুলের মাজারের সামনে) এসে দেখি একজন ফুটপাতে বই বিছিয়ে বই বিক্রী করছেন। পরিচয় হলো। জানলাম তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। বঙ্গবন্ধু হলে থাকেন। তার সাথে আলাপ করে কিছু বই নিয়ে আমি হেঁটে হেঁটে বিক্রী শুরু করি। বেশির ভাগ বইয়ের দাম তখন দশ টাকা বিশ টাকা। দিন শেষে হিসাব করে দেখতাম, আমার একশ-দেড়শ টাকা লাভ হতো। এর মধ্যে আইন (প্রিলিমিনারী) পরীক্ষার রেজাল্ট বের হলে দেখি আমি ফেল করেছি।

দোকানের সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়ালে দেখা যায়, নানা বয়সি মানুষ বই কিনতে আসছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী শ্রাবনী দত্ত একটি বই কিনলেন। বইটির নাম `যে গল্পের শেষ নেই`। লেখক দেবী প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়। মধুমণ্ডল জানালেন সরাসরি প্রকাশকের কাছ থেকে বই কিনেন তিনি। বিক্রী করেন ২৫% ছাড়ে। কখনো কখনো ৫০% ছাড় দিয়ে থাকেন।

অতীত হাতড়ে মধুমণ্ডল বলেন, আইনে ফেল করার পর আমি গ্রামে ফিরে যাই। ছোটবেলা থেকেই বইপোকা ছিলাম। সেখানে একটি স্কুল সংলগ্ন কক্ষ নিয়ে শিশু কিশোরদের বই দিয়ে একটি ছোট খাট লাইব্রেরী শুরু করি। সেখানে ছেলে মেয়েরা এসে বই পড়তে পারত। আবার ইচ্ছে করলে কেউ বই কিনতেও পারত। ইতোমধ্যে গ্রামে জানাজানি হয়ে যায় আমি আইনে পাস করতে পারিনি। সেটা নিয়ে পরিবারে শুরু হয় অশান্তি। বাবা মায়ের বড় ছেলে। সবার স্বপ্ন ছিল আমি আইনজীবী হব। কিন্তু তাদের সে স্বপ্ন পূরণ করতে না পারায় পরিবারেও আমাকে নিয়ে অশান্তি দেখা দেয়। ছোট ভাই বোনরাও নানা কথা শোনায়।

এরপর মধুমণ্ডল ২০১৩ সালে আবার ঢাকায় ফিরে আসেন। যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় বাতিল করে মৃত্যুদণ্ড করার দাবিতে শাহবাগে বসেছে গণজাগরন মঞ্চ। উত্তাল ঢাকা। সেই উত্তালময় পরিস্থিতিতে মধুমণ্ডল ভ্যানে বই নিয়ে ঘুরে ঘুরে বিক্রী শুরু করেন। ভাল বিক্রী হয়। লাভও ভাল। থাকার জায়গা ছিলনা। রাতে কবি নজরুলের মাজারের ভেতর একটি কক্ষে থাকেন (এখন অবশ্য সেই সুযোগ নেই)। ভ্যানটি তাকে কিনে দিয়েছিলেন তার এক বড় ভাই রিপন। যাকে দেখে মধুমণ্ডল বই বিক্রীতে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।

মধুমণ্ডল এখনো বই বিক্রী করে যাচ্ছেন। এক সময় বিশ্ববিদ্যালয় ও আশে পাশের এলাকায় ঘুরে ঘুরে বই বিক্রী করতেন। গত কয়েকবছর তিনি থিতু হয়েছেন সেই পুরনো জায়গায়। কবি নজরুলের মাজারের সামনে।

নিজে যতো বই বিক্রী করেন তার চেয়ে বেশি বই মধুমণ্ডল পড়েন। আলাপকালে মধুমণ্ডল বলেন, বই বিক্রীর আগে আমি নিজে সেই বইটি পড়ি। এতে দুইটি লাভ। আমার নিজের পড়া হয়। দ্বিতীয়ত পাঠকরা যখন সেই বই সম্পর্কে জানতে চায় তাদেরকে বিস্তারিত বলতে পারি।

একুশে টেলিভিশন অনলাইনের সঙ্গে আলাপকালে মধুমণ্ডল বলেন, আমি স্বাধীনভাবে ব্যবসা করছি। এটা বড় আত্মতৃপ্তির। চাকরি করলে সে তৃপ্তি পেতাম না। তবে খারাপ লাগে তখন যখন দেখি আমি বই বিক্রী করি এটা নিয়ে আমার পরিবার আত্মীয় স্বজন সবাই বিরক্ত। ফুটপাতে বই বিক্রী করি, তাই তারা অনেক সময় আমার পরিচয় দিতে লজ্জা পায়। তাদের ধারণা, আমি ডিগ্রী পাস করেছি এটা অর্থহীন। আমার সার্টিফিকেট নাকি কোন কাজে লাগেনি। আমি বই বিক্রী করে আনন্দ পাই। এই আনন্দের কী কোন মূল্য নেই?

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। টিএসসি থেকে শাহবাগের মোড়- তরুণ তরুণীদের ভীড় বাড়ছে। মধুমণ্ডলের ছোট `বইপোকা` দোকানটিতে ক্রেতার সংখ্যাও বাড়ছে। ক্রেতার সঙ্গে কথা বলতে বলতে মধুমণ্ডলের চোখে মুখে যে আত্মতৃপ্তি দেখা যায়- তা কী সে চাকরি করলে পেত?

আআ/এসি