ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৮ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৪ ১৪৩০

নারী ও শিশু নির্যাতন: প্রয়োজন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৩:১৩ পিএম, ১২ এপ্রিল ২০১৯ শুক্রবার | আপডেট: ০৮:৪১ পিএম, ২৪ এপ্রিল ২০১৯ বুধবার

নারী ও শিশুদের বিরুদ্ধে নির্যাতন মানবাধিকারের সর্বাধিক লঙ্ঘন। গত বছর সারা দেশে এক হাজারের বেশি ধর্ষণ-গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া ঘটেছে নারীর প্রতি সাড়ে চার হাজারেরও বেশি সহিংসতার ঘটনা। সম্প্রতি ফেনীর সোনাগাজীতে মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির দেহে কেরোসিন ঢেলে তাকে হত্যা করা হয়েছে। এই ঘটনার জন্য কে বা কারা দায়ী তাদের খুঁজে বের করার জন্য পুলিশ ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)- এর একটি বিশেষ টিম ইতোমধ্যেই তৎপর হয়েছে।

নুসরাত হত্যাকাণ্ড বিষয়ে দেশের বিশিষ্ট নাগরিকরা বলেন, পরিকল্পিতভাবে নুসরাত জাহান রাফির শরীরে আগুন দেওয়া হয়েছে। কারণ একটা পরীক্ষা কেন্দ্র সাধারণত নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার মধ্যে থাকে। তাই অধ্যক্ষ এবং কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্তদের যোগসাজশ ছাড়া সেখানে কেরোসিন বা পেট্রল নিয়ে ঢোকা সম্ভব নয়।

সমাজ বিশ্লেষকরা বলছেন, ঘরের বাইরে সাধারণত প্রভাবশালীরাই নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনাগুলো জন্ম দিচ্ছে। এ কারণে প্রায় প্রতিটি নির্যাতনের ঘটনার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংশ্লিষ্ট সদস্যদের জন্য ওই অপরাধীর বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া অনেকটাই কঠিন হয়ে পড়ে।

সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, একজন অপরাধী যে শ্রেণি বা পেশারই হোক, অপরাধকাণ্ডের ক্ষেত্রে তার পরিচয় ‘অপরাধী’। অন্যসব প্রভাব-পরিচয়কে গুরুত্ব না দিয়ে বরং অপরাধী হিসেবেই তার বিরুদ্ধে দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা করা গেলে নিরাপদ সমাজ বিনির্মাণের পথ সুগম হবে। নারীরা যেন ঘরে-বাইরে সর্বত্র পুরুষের পাশাপাশি স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে, সমাজের বিবেকবান প্রতিটি মানুষেরই প্রত্যাশা। নুসরাতের মৃত্যুর পর অনেকেই বলেছেন, এভাবে আর একটি মৃত্যুও চাই না। আর কোনও নুসরাতকে যেন যৌন নিগ্রহের শিকার হতে না হয়, মানবতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এভাবে চিরতরে চলে যেতে না হয়।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়শা খানম বলেন, নারী নির্যাতনের প্রতিটি ঘটনার সঙ্গে স্থানীয় অপরাধীচক্র, রাজনৈতিক আশ্রয় ও প্রশাসনের সহযোগিতা বরাবরই লক্ষ করা গেছে। আর রাফির ঘটনাটিও এ চক্রের বাইরে নয়। সেখানে স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিকচক্র, প্রশাসনের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা দিবালোকের মতো স্পষ্ট।

আয়শা খানম মনে করেন, নারী নির্যাতন প্রতিরোধে শুধু জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করলেই চলবে না, রাজনৈতিকভাবে জোরালো ভূমিকা নিতে হবে। তাই রাফি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা অতি দ্রুত সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে জড়িতদের কঠোরতম আইনানুগ শাস্তি প্রদান করে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করারও জোর দাবি জানান বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, রাফি দুটি জিনিস চেয়েছিল। এক. বাঁচতে চেয়েছিল, দুই. বিচার। আমরা তাকে বাঁচাতে পারিনি। এখন বিচারটা যেন হয়। যদি রাফির পরিবার ন্যায়বিচার না পায়, তাহলে এভাবে কেউ আর প্রতিবাদ করতে এগিয়ে আসবে না। সে ক্ষেত্রে সমাজটা অন্যায়কারীতে ভরে যাবে। আমাদের ভেবে দেখতে হবে যে, আমরা সে রকম সমাজ চাই কি না।

সিনিয়র আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, আইনে আসলে বিচার বিভাগীয় তদন্ত বলতে কিছু নেই। তদন্ত কাজ হচ্ছে পুলিশ বিভাগের। পুলিশ ইচ্ছে করলে আসল ঘটনা উদ্ঘাটন করতে পারে। আর এ ঘটনার মূল বিষয় তো এরই মধ্যে বেরিয়ে গেছে। মোটামুটি স্পষ্ট। অতএব, রাজনৈতিক বাধা না থাকলে সুষ্ঠু বিচার হওয়া উচিত বলে মনে করি।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক মনে করেন, নুসরাত ছিল একজন প্রতিবাদী মানুষ। অন্যায়ের কাছে, কারও যৌন লালসার কাছে নত হয়নি সে। রাফি জীবন দিয়ে প্রতিবাদ করে গেছে। অনেকেই নত শিকার করে, সায় দেয়। কিন্তু রাফি সেটা করেনি। তার প্রতিবাদ আমাদের সবার কাছে শিক্ষণীয় বলে মনে করেন কাজী রিয়াজুল হক।

নুসরাত হত্যা বিষয়ে মামলা বিষয়ে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, এই মামলাটি যেন তাড়াতাড়ি শেষ করা হয়। সে জন্য মামলাটি দ্রুত তদন্ত শেষে চার্জশিট দিতে হবে। চার্জশিট যাতে দ্রুত হয়, সে জন্য সরকার পক্ষের আইনজীবীদের জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে।

সিনিয়র এই আইনজীবী বলেন, এ সব মামলার ক্ষেত্রে সাক্ষী হাজির করা এবং পুলিশ অফিসার, যারা তদন্তে নিয়োজিত ছিলেন, তাদের হাজির করা প্রয়োজন আছে। কোনও ধরনের মুলতবি না দিয়ে মামলার বিচার কাজ শেষ করতে হবে। তবে জরুরি কোনও কারণ থাকলে আদালত দু-একটি মুলতবি দেওয়া যেতে পরে।

নুসরাত রাফি জীবন দিয়ে প্রতিবাদ করে গেছে। আর এ প্রতিবাদ যেন কোনোভাবেই বৃথা না যায়। অন্যায় আর নিপীড়নের বিপরীতে ন্যায়বিচার পাওয়ার সাংবিধানিক ও মৌলিক মানবাধিকার দাবি করতে গিয়ে আর কাউকেই যেন এমন বর্বরতার শিকার না হতে হয়। তাই দায়মুক্তির অপসংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে একটি বসবাসযোগ্য নিরাপদ, ন্যায়পরায়ণ ও মানবিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে প্রশাসনের সব স্তরে দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের অঙ্গীকার ও তার বাস্তব প্রতিফলন এখন সময়ের দাবি।