ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৪ ১৪৩০

বাংলাদেশের ৬ ছাত্রের নাসা জয়ের গল্প

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১১:২৫ পিএম, ২৫ এপ্রিল ২০১৯ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ১১:৪৮ পিএম, ২৫ এপ্রিল ২০১৯ বৃহস্পতিবার

মঙ্গলগ্রহে গবেষণা বা চলাফেরার জন্য প্রয়োজন যানবাহন। যানবাহনে জ্বালানি ব্যবহার করলে একটি নির্দিষ্ট সময় পর তা শেষ হয়ে যায়। তাই জ্বালানি ব্যবহার না করে মানুষের উপযোগী যানবাহনের সন্ধান পেতে ‘নাসা হিউম্যান এক্সপ্লোরেশন রোভার চ্যালেঞ্জ’ নামের প্রতিযোগিতার আয়োজন করে আসছে নাসা। প্রতিবছরই এ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয় ইউএস স্পেস অ্যান্ড রকেট সেন্টারে। এবছরও ১২ থেকে ১৪ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হয় এ প্রতিযোগিতাটি।

বাংলাদেশ থেকে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে অধ্যয়নরত ছয় সদস্যের একটি দল (EXCELR8) এ বছর কলেজ বা ইউনিভার্সিটি দল হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের হান্টসভিল, আলাবামাতে অনুষ্ঠিত ‘হিউম্যান এক্সপ্লোরেশন রোভার চ্যালেঞ্জ’ নামক এ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে। অংশগ্রহণকারী সদস্যরা হলেন- তৌহিদ রহমান, মোঃ তানজিল শাহরিয়া, শামুন আহেমদ, আইমান রহমান, ফারহাত তাসনিম প্রজ্ঞা ও মোহাম্মদ রিদওয়ান হোসাইন পাটোয়ারি।

এর আগে গত বছর বাংলাদেশের সর্বপ্রথম কলেজ/ইউনিভার্সিটি দল হিসেবে এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে এই দল। যুক্তরাষ্ট্রের স্পেস ও রকেট সেন্টারে তিনদিনব্যাপী (১২-১৪ এপ্রিল) অনুষ্ঠিত প্রতিযোগিতাটি নাসার অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ বাৎসরিক আয়োজন।

এক্সেল-আর-৮ এই টিমের নানা সমস্যা সমাধানে পাশে ছিলেন দলের পরামর্শদাতা ডক্টর সাজ্জাদ হোসেন, স. ম. তৌহিদুজ্জামান, মো:রায়হান সহ আরো অনেকে।

দলনেতা তৌহিদ রহমান এ প্রসঙ্গে একুশে টেলিভিশন অনলাইনকে বলেন, নভেম্বর ২০১৮ থেকে রোভার এর নকশা, উপকরন জোগাড় করা, রোভার তৈরি এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর পুনরায় পরিবর্তন সহ মোট ৩ মাসের মাঝে আমরা প্রতিযোগিতার উপযোগী রোভার এর কাজ সম্পন্ন করি।

অংশগ্রহনের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তৌহিদ রহমান বলেন, প্রথমেই বিচারকমণ্ডলী আমাদের নিরাপত্তা, রোভারের ওজনসীমা, ৫ ঘন ফুট বক্সে রোভার নেয়া যাবে কিনা তার পর্যালোচনা করেছেন যা আমরা সফলভাবে অতিক্রম করতে পেরেছি। প্রতিযোগিতায় সাত মিনিটের মাঝে মোট ১৪ টি বাঁধা অতিক্রম এবং ৫ টি কাজ সম্পন্ন করার জন্য ০.৫ মাইলের একটি পথ সাজানো হয়েছিলো, পাথর, বালু, উঁচু-নিচু পার্বত্য পথ। পাথুরে, ঢাল, গর্ত দিয়ে তৈরি লাল ভূখণ্ডে রোভারটি চালাতে হয়েছে দু`জন আরোহীকে (একজন মেয়ে, একজন ছেলে)। বেশিরভাগ বাঁধা অতিক্রমেই বাইপাস এর সুযোগ ছিল। দলগুলোর জন্য পূর্বপরিকল্পনার পাশাপাশি তাৎক্ষনিক নির্ধারণের চ্যালেঞ্জ ছিল, যাতে একটি বাঁধা অতিক্রমে আটকে গেলে/ রোভার কোন একটি বাঁধার জন্য উপযোগী না হলেও সময়ের সম্পূর্ণ ব্যবহার করা যায়। আমরা সেভাবেই পূর্বপরিকল্পনা এবং তাৎক্ষনিকতার সামাঞ্জস্যতা রেখে রোভার টি চালিয়েছি। ৬ মিনিটের মাঝে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে সপ্তম মিনিট রাখতে হয়েছে রোভার টি পুনরায় সূচনাস্থানে ফিরিয়ে আনতে।

তৌহিদ রহমান বলেন, বাংলাদেশের হয়ে দ্বিতীয় বারের মতো আমরা অংশগ্রহণ করায় আমাদের প্রতি অনেকের আগ্রহ ছিল। বিশ্বের আনাচে-কানাচে থেকে প্রায় ১১৫ টি দল এসেছিল। খুব গর্ব বোধ হয়েছিল যখন দেখি বাংলাদেশের পতাকা দেখে অন্য দল গুলো এবং অনেক বাঙালি আমাদের কাছে এসে আমাদের সঙ্গে একের পর এক ছবি তুলে যাচ্ছিলো। আমাদের টিমের রোভারটি ছিল সম্পূর্ণ মডুলার, যার প্রত্যেকটি পার্টস আলাদা ছিল, যেটি আমাদের পরে এসেমব্লি (জয়েন্ট) করতে হয়েছে। আমাদের এই মডুলার ডিজাইন সবার নজর কেড়েছে এবং প্রশংসিত হয়েছে। আমাদের ডিজাইন অন্য অনেক দেশের ডিজাইন থেকে আলাদা থাকায় আমেরিকা, পুয়ের্তো রিকো, পেরু সহ অনেক দেশের দল আমাদের সঙ্গে তাদের ডিজাইন এর ধারণা শেয়ার করার জন্য আমাদের অনুরোধ করে এবং ২০২০ সালে আমাদের অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানায়। গত বছর বাংলাদেশ থেকে সর্বপ্রথম দল হিসেবে আমরা নাসাতে গেলেও এই বছর রুয়েট দল ও নাসা তে আমাদের সঙ্গে অংশগ্রহন করে এবং বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করে।

প্রতিবছর নাসা হিউমান এক্সপ্লোরেশন রোভার চ্যালেঞ্জ এর মাধ্যমে মহাকাশে মানব পরিসরের অনুসন্ধানের পরবর্তী পর্যায়ে বিশ্বব্যাপী ছাত্রদের নিয়োজিত করার জন্য একটি অভিনব ইঞ্জিনিয়ারিং অভিসন্ধান চ্যালেঞ্জ প্রদান করে। মার্স (মঙ্গল) অভিযানের উপযোগী সম্পূর্ণ অভিনব এবং নতুন নকশা তৈরি করে রিপোর্ট জমা দেয়ার পর নাসা এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের উপযোগী দল হিসেবে “NSU EXCELR8” কে মনোনীত করে।

প্রতিযোগিতাটি স্কুল-কলেজ এবং ইউনিভার্সিটির ছাত্র-ছাত্রীদের অন্য একটি গ্রহের প্রেক্ষাপটে উপযোগী পৃষ্ঠে চলাচলে সক্ষম একটি গাড়ি তৈরি করার পরিকল্পনা`র চ্যালেঞ্জ করে। মঙ্গল গ্রহের ভবিষ্যৎ অনুসন্ধান ও গবেষণার পরিপ্রেক্ষিতে নাসার এই আয়োজন। বিশ্বের দূর-দূরান্ত থেকে বিভিন্ন দলকে তারা আমন্ত্রিত করে তাদের অভিনব ইঞ্জিনিয়ারিং কৌশল প্রতিবেদনের জন্য যা কিনা মঙ্গলের উঁচু-নিচু বন্ধুর পথ ও অন্যান্য বাধা বিপত্তি পাড়ি দিয়ে সীমিত সময়ে নভোচারীদের গবেষণা কাজে ব্যাবহারের সক্ষম।

মঙ্গল পরিভ্রমণের সবগুলো চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে “এক্সেল-আর-৮” মানব যানটি তৈরি করতে হয়েছে নাসা প্রদত্ত গাইডবুকের শর্তাদি মাথায় রেখে। কাঁকর-কঙ্করের উঁচু-নিচু, অসমতল পথ অতিক্রম করতে সক্ষম চার চাকার একটি বাহন তৈরি করা হয়েছে যা সম্পূর্ণ মানবচালিত। বাহনটির সবকিছু তৈরি করা হয়েছিল দেশি প্রযুক্তিতে, মরিচা রোধক লোহা দিয়ে। মঙ্গলে কোনো জ্বালানি ছাড়াই পরিচালনা করতে হবে মাথায় রেখে এটি চালাতে ব্যবহৃত হয়েছে চেইন আর প্যাডেল। কার্যকরী ড্রাইভট্রেনের জন্য বাইসাইকেল-ড্রাইভট্রেন ব্যবহৃত হয়েছে সামনে-পিছনের চাকায়। সবচেয়ে কঠিন অংশ ছিল, বাহনটিকে চেইন খুলে যাবার আশঙ্কা ছাড়া সম্পূর্ণ ভাঁজ করে রাখার উপযোগী করে তৈরি করা যা মাত্র ৫ ঘন ফুট আকারে (চার কোনা বক্সসদৃশ) ভাঁজ করা যাবে, যা নাসার গাইড-লাইনের অন্যতম শর্ত ছিল। চাকা গুলো তৈরি করা হয়েছে যাতে রুক্ষ এবং পাথুরে পৃষ্ঠে চলাচলে সক্ষম পাশাপাশি নিরাপত্তা এবং কর্মক্ষমতায় দক্ষ হয়। সামনে-পেছনে আছে দু`জনের আসন। আরোহী দু`জনের কাছেই থাকবে প্যাডেল।

নাসার নিয়ম অনুযায়ী প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী দলের শিক্ষার্থীদের আরোহী দু`জনের একজন ছেলে একজন মেয়ে ছিল, কেননা একটা ছেলে ও একটা মেয়ে মঙ্গলের মাটিতে এই মানবযানটি চালাবে। রোভারটির ওজন ছিল ৯৩ কেজি।

প্রতিযোগিতায় রোভারের (বাহন) কিছু নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য রয়েছে। রোভারকে পাঠানো হয় একটি রকেটের সাহায্যে। রকেটের ভেতরে রোভারের জন্য রাখা বাক্সের দৈর্ঘ্য ৫ ফুট, প্রস্থ ৫ ফুট ও উচ্চতা ৫ ফুট। এ বক্সের ভেতরে রাখার উপযোগী করে রোভারটি তৈরি করতে হয়। প্রয়োজনে রোভারকে ভাঁজ করা যাবে। রোভারটি মঙ্গলগ্রহে দুজন নভোচারী পরিচালনা করবে। সে উপযোগী করে প্রতিযোগিতায় একজন ছাত্র ও একজন ছাত্রী রোভারটি পরিচালনা করবেন। শুধু ধারণা দিলেই হবে না, প্রতিযোগিতায় রোভারটিকে আধা মাইল পথ পাড়ি দিতে হবে। তাও গতানুগতিক পিচঢালা মসৃণ রাস্তা নয়। মঙ্গলগ্রহের ভূমির আদলে তৈরি বিশেষ পথ পাড়ি দিতে হবে। এ জন্য ইউএস স্পেস অ্যান্ড রকেট সেন্টারে গড়ে তোলা হয়েছে মঙ্গলগ্রহের উপযোগী ভূমি, সেখানকার আবহাওয়া, গর্ত এমনকি পাহাড়ও। রোভারটিকে প্রয়োজনে সে পাহাড়গুলো গুঁড়িয়ে দিতে হবে। গর্তগুলো ভরাট করতে হবে।

এসি