ঢাকা, শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ৬ ১৪৩১

সমাজের অসঙ্গতি তুলে ধরছেন ব্যারিস্টার সুমন

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১০:৫৫ পিএম, ২৮ এপ্রিল ২০১৯ রবিবার

ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন। একটি আলোচিত নাম এই সময়ে। পেশায় একজন আইনজীবী। যিনি ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে সমাজের অসঙ্গতিগুলো তুলে ধরছেন। তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা হবিগঞ্জের চুনারঘাট উপজেলায়। তিনি ২০০৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ সম্পন্ন করার পর ২০০৯ সালে যুক্তরাজ্যের লন্ডনে চলে যান। সেখানে সিটি ইউনিভার্সিটি থেকে বার অ্যাট ল’ করেন তিনি।

লন্ডনে থাকা অবস্থায় হঠাৎ তার বাবা মারা যাওয়ার খবর শুনেও যখন সামান্য অর্থের অভাবে বাবাকে শেষবারের মতো দেখেতে আসতে পারেননি। সেদিন নিজেকে খুব অসহায় লাগছিল তার। সেই শোক সুমনকে যতটা ভেঙে দিয়েছিল ঠিক ততটাই ভীত গড়তে সহায়তা করেছিল মানুষের হয়ে মানবতার তরে নিজেকে বিলিয়ে দিতে। এরপর থেকে তিনি মানবতার কাজে ব্রতী হন।

লন্ডনে বার অ্যাট ল’ সম্পন্ন করার পর অনেকেই সুমনকে সেখানেই থেকে যেতে বলেছিলেন। কিন্তু দেশের প্রতি টান অনুভব করেন তিনি। সুমনের মনে হতো, লন্ডনে অনেক ব্যারিস্টার আছেন সেখানে কাজ করার জন্য। কিন্তু তার মাতৃভূমিতে যদি আরেকজন ব্যারিস্টার ফিরে ন্যূনতম হলেও কিছু করতে পারেন, তাতে দেশ উপকৃত হবে। সুমন মনে করেন, বার অ্যাট ল’ করা পর্যন্ত তিনি দেশ-জাতি-সমাজ থেকে নিয়েছেন। এরপর বিশেষ করে চার দশক পর দেশ-জাতিকে তার দেওয়ার পালা। সেই দৃষ্টিভঙ্গিই তিনি ছড়িয়ে দিতে চান। মানুষ হয়তো হবে ‘মহত্তম সম্পদ’, নতুবা ‘বৃহত্তম দায়’।

দেশে ফিরে এক সময় ঢাকা হাইকোর্টে যোগদান করেন একজন আইনজীবী এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের প্রসিকিউটর হিসেবে। সেই সঙ্গে চলতে থাকে সমাজের মানুষের হয়ে কাজ করার প্রবল ইচ্ছার বাস্তবায়ন। এর জন্য বেছে নেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক লাইভ। যার মাধ্যমে তিনি চারপাশে কিংবা পথে ঘাটে ঘটে চলা অনিয়ম এবং অসংগতিগুলোকে যথাযথ কর্তৃপক্ষের নজরে এনে সমাধান করে চলেছেন।

সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে তিনি ইদানিং সমাজ বদলের লক্ষে ‘ফেসবুক লাইভকে বেঁছে নিয়েছেন। কারণ তিনি বিশ্বাস করেন মানুষকে জাগাতে হলে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা প্রয়োজন।

এজন্য বেশ কিছু ফেসবুকে লাইভ ভিডিও করেছেন। যেখানে তিনি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন অনিয়ম অসংগতির বিষয়গুলো ফেসবুক লাইভ এসে দেশবাসীর সামনে তুলে ধরছেন এবং সেই সঙ্গে যথাযথ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন। ফলে কর্তৃপক্ষ সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ নিয়েছেন।

তিনি ফেসবুক ব্যবহারকারীদের নিয়ে রীতিমত সামাজিক আন্দোলন শুরু করেছেন। যেখানেই অনিয়ম, সেখানেই ফেসবুক খুলে লাইভে আওয়াজ তুলছেন। শত শত ব্যবহারকারী সেই ফেসবুক লাইভ শেয়ার করে ছড়িয়ে দিচ্ছেন, আর হাজার হাজার দর্শক সেই ভিডিও নজরে নিতে বাধ্য হচ্ছে কর্তৃপক্ষ।

তিনি কখনও রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা বিদ্যুতের খুটি নিয়ে লাইভে আসছেন তুলে ধরছেন এর ভয়াবহতার বিষয়গুলো, আবার কখনো রাস্তাঘাট, ফ্লাইওভার কিংবা নদীর ওপর কোটি কোটি টাকার ব্রিজের ওপর আলোহীন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ল্যাম্পপোস্ট অথবা ফুটপাতের ওপর নির্মাণ সামগ্রী রেখে জনসাধারণের চলার পথে ব্যাঘাত ঘটানো বিষয়গুলো নিয়ে। আর সেই ভিডিওগুলো যেই না ভাইরাল হতে শুরু করে দেশের হাজার হাজার ফেসবুক ব্যবহারকারীর ওয়ালে।

যেখানে দিনের পর দিন এসব অসঙ্গতি নিরসন হচ্ছে না অথচ মাত্র কয়েক ঘণ্টা পার হতে না হতেই রাস্তার ওপর থেকে বিদ্যুতের খুটি সরে যাচ্ছে রাস্তার পাশে, ফুটপাতের ওপর বছরের পর বছর পরে থাকা ইট, বালি উধাও হয়ে যাচ্ছে রাতের অন্ধকারে, ব্রিজ ফ্লাইওভারের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা ল্যাম্পপোস্টগুলো জ্বলজ্বল করে উঠছে কম সময়ের ব্যবধানে।

সুমন জানান, হবিগঞ্জের চুনুরঘাট উপজেলার লালচান গ্রামের নদীর ওপর দিয়ে কাঠের সেতু তৈরি করেন। আর এতে ব্যয় হয় আশি থেকে নব্বই হাজার টাকা। যার সবটাই বহন করেন তিনি।

সুমনের কিছু উল্লেখযোগ্য কাজ-

নরসিংদীর শিবপুরে রাস্তার প্রায় মধ্যখানে পল্লী বিদ্যুতের একটি খুঁটি। স্থানীয়দের ভাষ্যে, এই খুঁটির কারণে একাধিক দুর্ঘটনা ঘটলেও টনক নড়ছিল না কর্তৃপক্ষের। সুমন এই খুঁটি দেখেই তার ‘ফেসবুক লাইভ’ শুরু করেন। এর এক দিনের মধ্যেই সেটি অপসারণ করা হয়। তবে সুমন সেখানেই থেমে যাননি। সড়কে এই ধরনের খুঁটি সরাতে আদালতের দ্বারস্থ হন। এরই প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ঝুঁকিপূর্ণ বৈদ্যুতিক খুঁটি অপসারণের নির্দেশও জারি করেছেন। ফেসবুক লাইভে সোচ্চার তিনি এই ঘটনার আগে পুরান ঢাকার (কেরানীগঞ্জ থেকে রাজধানীর প্রবেশপথ) বাবু বাজার ব্রিজ (বুড়িগঙ্গা দ্বিতীয় সেতু) দিয়ে যাওয়ার সময় দেখেন, লাখ লাখ লোকের চলাচলের এতো গুরুত্বপূর্ণ সেতুটির ওপর বাতি প্রায় ছিলই না, যেজন্য অন্ধকারেই চলাচল করতে হতো যানবাহন এবং লোকজনকে। তাতে অনেক ছিনতাইয়ের পাশাপাশি দুর্ঘটনাও ঘটতে বলে ভাষ্য স্থানীয়দের। সুমন বিষয়টি ফেসবুক লাইভে তুলে ধরলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই বাতি বাতিতে জ্বলে ওঠে এই ব্রিজ।

এরপর রাজধানীর কাঁটাবন মোড়ে বালু ও ময়লা-আবর্জনার স্তূপ করে ফুটপাত দখল করে রেখেছিল একটি মহল। এতে জনচলাচলে দুর্ভোগ সৃষ্টির পাশাপাশি পরিবেশও দূষিত হচ্ছিল। সুমন সেটি তার ফেসবুক লাইভে প্রচার করলে দ্রুতই অপসারণ করা হয়। পুরান ঢাকার হাজীর বিরিয়ানির দোকানের সামনেই ছিল ময়লা-আবর্জনার স্তূপ। সুমনের ফেসবুক লাইভের পর অপসারণ হয় সেটাও।

মহাসড়কে গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাখা, ফুটপাত দখলসহ এমন আরও অনেক অনিয়মের বিরুদ্ধে ফেসবুক লাইভে আওয়াজ তুলে সমাধান এনেছেন তিনি। তিনি এসব লাইভে বারবারই বলে চলেছেন, সবাইকেই অনিয়মের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে, দেশকে গড়তে হলে সবারই সদিচ্ছা লাগবে।

‘ফেসবুক লাইভ আন্দোলন’র বাইরে সুমন নিজ অর্থ-শ্রম দিয়েও করে চলেছেন অনেক কাজ। তার এলাকা হবিগঞ্জের চুনারুঘাটে চা বাগানের বিভিন্ন ছড়া-খালের ওপর বানিয়েছেন ২১টি সেতু। নির্মাণ করেছেন অন্তত ৪০টি রাস্তা। এতে যেমন হাজার হাজার মানুষের দুর্ভোগ লাঘব হয়েছে, অজস্র মানুষের মধ্যে তৈরি হয়েছে সমাজ সচেতনতাবোধ।

নিজের সমাজকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ড ফেসবুকে প্রচার নিয়ে এক-আধটা কটূ কথাও শুনতে হয় তাকে। এই লাইভগুলো ফলোয়ার সংযুক্ত করার উদ্দেশে নয়। আমি সমাজ এবং দেশের জন্য অনেক বেশি কিছু করে ফেলেছি তা-ও কিন্তু নয়। তবে একেকটা কাজ করার মধ্য দিয়ে আমি একেকটা মেসেজ ছড়িয়ে দিতে চাই- আমার ছোট একটা কাজে কিছু আসে যায় না। একজনের পক্ষে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব না। আমি অনেক সময় নিজ হাতে এলাকার রাস্তার ময়লা পরিচ্ছন্ন করে বোঝাতে চাই- নিজের জন্মস্থানের জন্য কেউ ভিআইপি নন। এই মেসেজটা পেয়ে আমার মতো যদি হাজার হাজার মানুষ কাজ করেন, তাহলে সমস্যা বলে কোনো কিছু দেশে থাকবে না।

তিনি তার জায়গা থেকে যেভাবে সমাজের জন্য, দেশের জন্য কাজ করছেন, তারুণ্যও একইভাবে কাজ করুক। সমাজের সব অসঙ্গতি ফেসবুকসহ অন্যান্য মাধ্যম ব্যবহার করে তুলে ধরুক কর্তৃপক্ষের সামনে। দেশের জন্য এই সামাজিক আন্দোলনটা সবার মধ্যে ছড়িয়ে যাক। নতুন প্রজন্ম যদি একতাবদ্ধ হয়ে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে জাতির জন্য কাজ শুরু করে, তাহলে হতাশার কোনো জায়গা থাকবে না।

এরপর বিভিন্ন এলাকায় একে একে যখন ২১টা কাঠের ব্রিজ করে ফেলি, তখন যেন মানুষের মনে সন্দেহটা দূর হতে থাকল এবং সেই সঙ্গে কর্তৃপক্ষেরও সাড়া মিলতে থাকল ক্রমান্বয়ে।

তিনি আরও বলেন, ‘আমার কাজের সার্থকতা তো তখনই খুঁজে পাই, যখন দেখি আমার এই লাইভ ভিডিওর কাজ দেখে কেউ আমার মতো লাইভে এসে তার এলাকার বিভিন্ন সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করছেন। অর্থাৎ যখন দেখি ব্যারিস্টার সুমন দেশের আর দশটা সচেতন যুবকের মাঝে জেগে উঠতে শুরু করেছে তখনই আমার সবচেয়ে বড় সফলতা খুঁজে পাই। আসলে আমরা যদি সবাই সবার জায়গা থেকে এই দেশটাকে নিয়ে ভাবি তাহলে খুব দ্রুতই এই দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনা সম্ভব। আর তাই তো আমি লাইভে এসে সব সময় একটা কথা বলি, চলুন, সবাই মিলে দেশটাকে বদলে দিই।’

 কেআই/